শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁ দিকে) বাণেশ্বর শিব মন্দির। সুবিখ্যাত বাণাসুরের মূর্তি? (ডান দিকে)।

কোচবিহারের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম হল বাণেশ্বর শিব মন্দির। এই অনুপম স্থাপত্য কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বে কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার প্রধান সড়কের মধ্যবর্তী বাণেশ্বর গ্রামে অবস্থিত। বাণেশ্বর নামক পবিত্র শৈবধামের নামেই এই ক্ষুদ্র জনপদটির নামকরণ হয়েছে। খান চৌধুরী আমানতউল্লাহ আহমদের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, বাণাসুর নামক এক দৈত্যের হাতে প্রথম এখানকার শিবলিঙ্গটি প্রতিস্থাপিত হয় ও খেনরাজ নীলাম্বর এস্থলে মন্দির নির্মাণ করেন। কালিকাপুরাণ, যোগিনীতন্ত্র ও লিঙ্গপুরাণেও বাণেশ্বর শিবের উল্লেখ রয়েছে।

হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মতে, বর্তমান মন্দির কাঠামোটি কোচ মহারাজা প্রাণনারায়ণের সক্রিয় উদ্যোগে ১৬৬৫ সালে নির্মীত হয়, যা পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার পুনঃসংস্কার করা হয়। ১৮৯৭ এর ভয়াবহ ভূমিকম্পে এই মন্দিরটির স্থাপত্যগত দিক থেকে প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়, মূল গম্বুজাকৃতি চূড়াটিতে ফাটল ধরে এবং মূল শিবলিঙ্গসহ গর্ভগৃহের দেওয়াল ও মেঝে পূর্বদিকে হেলে পড়ে।
মন্দিরটি বর্গাকার, পশ্চিমমুখী এবং কামতেশ্বরী মন্দিরের ন্যায় প্রায় ২ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এক নাতিউচ্চ প্ল্যাটফর্মের ওপর প্রতিস্থাপিত। স্থাপত্য শব্দকোষ অনুযায়ী যাকে জাগাতি (Jagati) বলা হয়। এই অঞ্চলের সৌধগুলিতে এই বিশেষ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের বহুল প্রয়োগের উত্তরোত্তর গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পরিচায়ক বলেই আমার মনে হয়। বর্তমান মন্দিরটি প্রায় ৪০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট যেটির মস্তক অংশটি অর্ধচন্দ্রাকৃতির গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত ও তার শীর্ষে যথাক্রমে আমলক, কলস ও ত্রিশূল স্থাপিত। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান, প্রায় ৩১.৫ ফুট এবং ৮ ফুট সমন্বিত দেওয়ালের পুরূতা। সৌধটির কর্ণিশ অনেকটা বাঁকানো বাঁশের ন্যায়।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১০: জটিলেশ্বর শিবমন্দিরের স্থাপত্যশৈলী আমাদের আকৃষ্ট করবে/২

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর

মূল মন্দিরটির দক্ষিণে একটি সরোবর এখন যেটি মহারাজা প্রাণনারায়ণ কর্তৃক নির্মীত, যা মোহনদিঘী নামে খ্যাত। সরোবরটি বহু প্রাচীন কচ্ছপে পরিপূর্ণ ভক্তগণ যেগুলিকে মোহন নামে অভিহিত করেন। মন্দিরটির গর্ভগৃহ প্রবেশদ্বার থেকে প্রায় ১০ ফুট নীচে অবস্থিত যেখানে কৃষ্ণবর্ণীয় ব্যাসল্ট শিলাজাত গৌরিপট্ট-সহ শিবলিঙ্গ বাণেশ্বর শিবরূপে পূজিত ও আরাধ্য। মূল আরাধ্য শিবলিঙ্গের পাশাপাশি এই দেবায়তনে লক্ষ্মী-সরস্বতী-গঙ্গা-যমুনা ও ধ্যানী শিবমূর্তী এবং অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও পূজিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি মূল মন্দির সংলগ্ন একটি পৃথক কক্ষে কালীমূর্তিও বিরাজমান, যা নিত্য পূজিত হয়। প্রতি অমাবস্যা, সংক্রান্তি ও বাৎসরিক কালীপূজার সময় ধূমধাম সহকারে বিশেষভাবে পুজো হয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

আরেকটি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণকারী বিষয় হল, মূল বাণেশ্বর শিবলিঙ্গের পিছনের দেওয়ালের একটি স্ল্যাবের উপরে রক্ষিত একটি অষ্টধাতুর মূর্তি। কিছুটা বেবুনের মুখসদৃশ এই মূর্তিটি সাধারণ্যে বাণাসুরের মূর্তি নামে খ্যাত। কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালনাধীন এই বিখ্যাত অনুপম সৌধটির নয়নাভিরাম মন্দির বাস্তুশাস্ত্র আলাদা আকর্ষণের দাবি রাখে। এটি জেলার সবথেকে জনপ্রিয় শিব মন্দিররূপেও খ্যাত। কোচবিহারের অন্যান্য শৈবমন্দিরের ন্যায় আলোচ্য দেবায়তনেও শিবরাত্রি পর্বকে উপলক্ষ্য করে এখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে। একটি ছোটখাট মিলনমেলাও বসে।
আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে, এই ভূতুড়ে দ্বীপে তিনিই একমাত্র মহিলা, দিন কাটে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে, ‘দ্বীপের রানি’র কেন এমন সিদ্ধান্ত?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৫: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়

সুপ্রাচীন প্রথার সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে অন্যান্য বেশ কিছু কোচস্থাপত্যের ন্যায় এখানেও বলিপ্রথার প্রচলন রয়েছে। রাজ আমল থেকেই বিভিন্ন বিশেষ তিথিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রাণীর (যেমন পাঁঠা, পায়রা, খাসি, মোরগ ইত্যাদি) বলিপ্রথা সাড়ম্বরে পালিত হয় ও সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জনজোয়ারও ঘটে।

বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ।

কোচবিহারের বহুমন্দিরের ন্যায় এই দেবায়তনটিতেও নিত্যপূজার দায়িত্বে রয়েছেন কামরূপী পুরোহিতগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত পুরোহিতরা। নিজস্ব পরিচালিত সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আমার অনুমান করা যায় যে, সৌধটি অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কোচ স্থাপত্যের (সিদ্ধনাথ শিব মন্দির, গোসানিমারির কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির) পাশাপাশি নবউদ্ভাবিত গঠনশৈলী সমন্বিত কোচস্থাপত্যের অগ্রগমনকে সূচিত করে, যা শৈলীগত দিক থেকে বিমিশ্র শৈলীর অন্তর্ভুক্ত কিন্ত স্থাপত্য পরিলেখে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধশালী। বিখ্যাত মন্দিরস্থাপত্য বিশেষজ্ঞ বিমলকুমার দত্ত-র মতে, অর্ধচন্দ্রাকৃতি গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত দেবায়তনটি এই অঞ্চলে ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যশৈলীর এক বিশিষ্ট উদাহরণরূপে বিদ্যমান।

ছবি: লেখক
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’

Skip to content