বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


খামার সিতাই বুড়া শিবমন্দির।

উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ কামরূপ-কামতা অঞ্চল যে শৈব ধর্মস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান ছিল, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এমনকি এই অংশের শৈব ধর্মস্থানের জনপ্রিয়তা পাশ্ববর্তী বৃহৎ ভূ-ভাগ পুন্ড্রবর্ধনেও বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। এ নিয়ে গবেষকদের গবেষণায় অনেক তথ্য উঠে এসেছে। এই কোচ-কামতা অঞ্চলের শাসন কেন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যশালী দেবায়তন হল খামার সিতাই শিবমন্দির। তবে এটি বুড়া শিবের মন্দির নামেই বেশি জনপ্রিয়।
দেবায়তনটি কোচবিহার শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে দিনহাটা মহকুমার সিতাই ব্লকে অবস্থিত। সিতাই বাজার এলাকা থেকে পশ্চিমদিকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বে খামার সিতাই গ্রামে মন্দিরটি রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এটি বুড়া শিববাড়ি নামে খ্যাত। মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত রতনকুমার বাগচীর মতানুযায়ী, এই অঞ্চলের খামার সিতাই নামকরণের পিছনে মূল কারণ হল, এটি কোচ রাজাদের রাজকীয় কৃষি খামারের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৫: অনন্যসাধারণ হরিপুরের হরিহর শিবমন্দির

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

মন্দিরটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে প্রায় ১১ফুট x ১০ফুট ও ২২ ফুট। বর্গাকার মূল দেবায়তনটি পশ্চিমমুখী ও প্রদক্ষিণপথযুক্ত, যা হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। স্থাপত্যগত দিক থেকে সৌধটি এই অঞ্চলের মন্দির স্থাপত্যের দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিরণ্যগর্ভ ও অনাথনাথ শিব মন্দিরের ন্যায় বাংলার চিরাচরিত চারচালা স্থাপত্যশৈলীর শীর্ষে পেয়াঁজাকৃতির গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত। এর শীর্ষদেশ আবার ত্রিশূল ও ধ্বজা দ্বারা শোভিত। অর্থাৎ কোচ-কামতা অঞ্চলের অপরাপর দেবায়তনের ন্যায় এখানেও ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব লক্ষিত হয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে

মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রায় ২ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট যে সর্পশোভিত শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সেটিই জনারণ্যে বুড়া শিবলিঙ্গ নামে খ্যাত ও পূজিত। মূল আরাধ্য বিগ্রহটি চতুর্দিকে চারটি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পূজিত বিগ্রহ (নন্দী, গণেশ, লক্ষ্মী ও বিষ্ণু) দ্বারা বেষ্টিত। প্রসঙ্গত এরূপ চতুর্দিকে অপরাপর দেব-দেবী পরিবেষ্টিত শিবলিঙ্গ সচরাচর কোচ-কামতা অঞ্চলের অন্যান্য দেবায়তনে খুব একটা তেমন লক্ষিত হয় না (ব্যতিক্রম অনাথনাথ শিবমন্দির)। হরিহর শিবমন্দিরের ন্যায় এখানেও গর্ভগৃহের দেওয়ালে অর্ধবৃত্তাকার কুলুঙ্গির অস্তিত্ব রয়েছে। পাশাপাশি গর্ভগৃহের পূর্বদিকের দেওয়ালগাত্রে কুলুঙ্গিতে একটি হনুমান মূর্তিও খোদিত আছে। জনশ্রুতি, বুড়া শিবমন্দিরটি সর্বপ্রথম বিখ্যাত কোচ মহারাজা প্রাণনারায়ণের উদ্যোগে (১৬২৫-১৬৬৫ সালে) নির্মীত হয়, যে সময় তিনি বাণেশ্বর মন্দির সংস্কার করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২১: এ-কালের মতো সেই পুরোনো আমল থেকেই রাজনৈতিক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য নিষিদ্ধ প্রণয়-ফাঁদ পাতা হত

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৯: রাজবাড়ির সান্নিধ্যে নারীর উড়ান

তবে দীর্ঘদিন বয়সের ভারে জীর্ণ এই দেবায়তন যথাযথ সংস্কারের অভাবে ধুঁকছিল। অবশেষে ২০০৭ সালে তৎকালীন সিতাইয়ের বিডিও অশ্বিনীকুমার রায়, স্থানীয় সমাজসেবী হরিপদ মণ্ডল ও স্থানীয় ব্যবসায়ী হনুমানপ্রসাদ প্রমুখের উদ্যোগে বুড়া শিবমন্দিরের পুনঃসংস্কারের মাধ্যমে পূর্ববর্তী গঠনশৈলীর আদলেই বর্তমান সৌধের নির্মাণ ঘটে। সেই সঙ্গে মূল মন্দিরের পাশেই প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পিরামিডাকার আচ্ছাদনশৈলীর একটি কালিমন্দিরও সে-সময় নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটির পাশেই একটি বহু পুরাতন দীঘি রয়েছে, যা মন্দিরের বাস্তুশাস্ত্রের মূল নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

খামার সিতাই শিবলিঙ্গ।

কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালনাধীন এই অনুপম স্থাপত্যের নয়নাভিরাম মন্দিরের বাস্তুশাস্ত্র আলাদা আকর্ষণের দাবি রাখে। কোচবিহারের অন্যান্য শৈবমন্দিরের ন্যায় বুড়াশিবের মন্দিরেও শিবরাত্রি উপলক্ষে প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে। পাশাপাশি মন্দির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পরবর্তী সময় থেকে একে স্মরণীয় করে রাখতে বাৎসরিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলাতেও প্রচুর লোক সমাগম হয়।

আমার মনে হয়েছে, এই সৌধটি প্রায় সমসাময়িক অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কোচ স্থাপত্যের (বাণেশ্বর শিব মন্দির, গোসানিমারির কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির) পাশাপাশি নবউদ্ভাবিত গঠনশৈলী সমন্বিত কোচস্থাপত্যের অগ্রগমনকে সূচিত করে, যা শৈলীগত দিক থেকে বিমিশ্র শৈলীর অন্তর্ভুক্ত কিন্তু স্থাপত্য নিরিখে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধশালী। —চলবে।

ছবি: লেখক
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’

Skip to content