সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


হরিপুরের হরিহর শিবমন্দির।

কোচ সাম্রাজ্যের সূচনা থেকেই শৈব ও শক্তি এই অঞ্চলের প্রধান দুই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মস্থান বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু কামরূপ কামতা সাম্রাজ্যের মহারাজা নরনারায়ণের শাসনকালে (১৫৩৩-১৫৮৭ সাল) মূলত শঙ্করদেবের একক প্রচেষ্টায় এই অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্ম ধীরে ধীরে প্রভাব ও জনপ্রিয়তা বিস্তার করতে শুরু করে। শঙ্করদেব প্রথমে অহোম রাজ্যে নিজের মতাদর্শ ও পন্থা প্রচারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্ত দুঃখজনকভাবে তৎকালীন অহোম শাসক ও কামাক্ষ্যা মন্দিরের ব্রাহ্মণ পুরোহিত গোষ্ঠী যারা শক্তি ধর্মের গোঁড়া সমর্থক ছিলেন তাঁদের সম্মিলিত সক্রিয় বিরোধীতায় নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে বরপেটা অঞ্চলে চলে আসতে বাধ্য হন। সেখানে পরধর্মসহিষ্ণু মহান কোচশাসক মহারাজা নরনারায়ণের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর নতুন মতাদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন। এই দেবায়তনটির হরিহর নামটি ধর্মপন্থার মেলবন্ধনের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্তরূপে নিঃসন্দেহে গণ্য করা যায়।
হরিহর শিবমন্দির কোচবিহার শহর থেকে উত্তরে ১০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত হরিপুর গ্রামে তোর্ষা নদীর গা ঘেঁষে প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমমুখী ইষ্টকনির্মীত এই মন্দিরের প্রথম স্থাপত্যগত দৃষ্টি আকর্ষণকারী বৈশিষ্ট্য হল এই অঞ্চলের স্থাপত্যের অন্যান্য দৃষ্টান্তের বিপরীত মন্দিরশীর্ষে বিবিধ আকৃতির গম্বুজশৈলীর আচ্ছাদনের পরিবর্তে ক্রমহ্রাসমান পিরামিডাকার আচ্ছাদনশৈলীর প্রকাশ। মন্দিররের উচ্চতা প্রায় ১৪ ফুট। দেওয়াল প্রায় ৫ ফুট পুরু। বাণেশ্বর শিব মন্দিরের ন্যায় এই শিবমন্দিরের গর্ভগৃহ মূল সমতল প্রবেশদ্বার থেকে প্রায় ৮ ফুট নীচে অবস্থিত।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৪: ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোচস্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি দেওতাপাড়া শিব মন্দির

পরিযায়ী মন: বিদেশ ভ্রমণে বিভ্রাট

১৮৯৭ এর বিধ্বংসী ভূমিকম্পে কোচবিহারের অন্যান্য দেবায়তনের মতো এটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কারণ মন্দিরটি এর ফলে মাটিতে একদিকে হেলে বসে যায়। ফলস্বরূপ, এর উচ্চতারও কমে যায়। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে যে শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেটিই হরিহর শিবলিঙ্গ নামে খ্যাত ও পূজিত। মূল শিবলিঙ্গের পাশাপাশি গর্ভগৃহে প্রবেশের পথে সিঁড়ির বাঁদিকে আরেকটি নাতিক্ষুদ্র শিবলিঙ্গ রয়েছে যেটিকে মূল শিবলিঙ্গের প্রতিরূপরূপে উপাসনা করা হয়। মূলত বর্ষাকালে করা হয়, কারণ সে-সময় গর্ভগৃহে জলসমাগম বেড়ে যাওয়ায় ভক্ত কর্তৃক মূল শিবলিঙ্গের উপাসনা দুরুহ হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭১: ছোট মাছকে অবাঞ্ছিত না ভেবে প্রতিপালন করলে বিকল্প আয়ের দিশা পাওয়া যাবে

আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, মন্দিরের গর্ভগৃহের দেওয়ালে বিভিন্ন আকৃতির কুলুঙ্গির অস্তিত্ব [যেমন ওগি খিলান (ogee arch), অর্ধ বৃত্তাকার আকৃতির], যা নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলের স্থাপত্যকলায় ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর গভীর প্রভাবকে নির্দেশিত করে। সেই সঙ্গে মন্দিরের পূর্বদিকস্থ বহির্দেওয়াল গাত্রে একটি ত্রিকোণাকৃতি কুলুঙ্গি দেখা যায় (এই অঞ্চলের বেশ কিছু স্থাপত্যে যা লক্ষিত হয়), যা মূলত করা হয়ে থাকে মন্দির অভ্যন্তরে স্বাভাবিক আলো-বায়ুর সরবরাহের জন্য। এটি হিন্দুমন্দির স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২২: অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে

 

মন্দিররের নির্মাণকাল

নির্মাণকাল নিয়ে গবেষক মহলে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী, এটি হয় মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণের সময় (১৭১৪-১৭৬৩ সালে) অথবা মহারাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণের সময় (১৭৬৫-১৭৭০ সালে) নির্মীত হয়েছিল। যদিও হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মত, দেবায়তনটি প্রায় বাণেশ্বর মন্দিরের সমসাময়িক। বস্তুতপক্ষে বাণেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে এই মন্দিরের স্থাপত্যগত কিছু সাদৃশ্য (যেমন: দেওয়ালের পুরুত্ব বা গর্ভগৃহের অবস্থান ইত্যাদি) এই অনুমানকেই আরও দৃঢ় করে। শুধু তাই নয়, দেবায়তনটি আঞ্চলিক স্থাপত্যশৈলীগত দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তরূপেও উল্লেখযোগ্য। কারণ, এই অঞ্চলের সমসাময়িক একাধিক মন্দির স্থাপত্যশৈলী সমূহের মধ্যে ছাদের গঠনাকৃতির দিক থেকে এটিই একমাত্র সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

হরিহর শিবলিঙ্গ।

কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালনাধীন এই অনুপম স্থাপত্যের নয়নাভিরাম মন্দিরের বাস্তুতন্ত্র আলাদা আকর্ষণের দাবি রাখে। কোচবিহারের অন্যান্য শৈবমন্দিরের ন্যায় এই দেবায়তনেও শিবরাত্রি পর্বকে উপলক্ষ করে প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে। পরিশেষে বলা যায়, দুঃখজনক হলেও এই অনুপম অন্ত-মধ্যযুগীয় মন্দিরস্থাপত্যটিকে কেন্দ্র করে গবেষক মহলে যথার্থ আলোচনা তথা ব্যাখ্যাকরণের আগ্রহের অভাব দেখা গিয়েছে। মন্দিরটি তার অপরিসীম অত্ত্যুৎকৃষ্ট স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে কিছুটা লোকচক্ষুর আড়ালেই অবস্থান করছে। তবে এটা নিঃসন্দে বলা যায় যে, হরিহর শিব মন্দির কামতা অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী মন্দিরসমূহের মধ্যে গঠনগত বিভিন্নতার দিক থেকে অন্যতম ও উল্লেখযোগ্য।—চলবে।
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’

Skip to content