শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির।

কোচবিহারে মন্দির নির্মাণ মূলত দু’ ভাবে হয়েছিল—এক. রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং দুই, ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দির নির্মাণকরণ এই দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। মন্দিরটি কোচবিহারের দিনহাটা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সাবেক কোচবিহার-রংপুর প্রধান সড়কের মধ্যবর্তী ভিতরকুঠি ছিটে অবস্থিত। এই অনুপম স্থাপত্যটির নির্মাণকাল খুব সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের প্রথম পর্বে (আনুমানিক ১৭২৫-১৭৩৫ সাল)। কোচ মহারাজা মোদনারায়ণের আমলে (১৬৬৫-১৬৮০ খ্রিঃ) রাঢ়ীয় শ্রেণির ব্রাহ্মণ রূপচন্দ্র মজুমদার ভাগ্যান্বেষণে এই রাজ্যে এসে উপস্থিত হন এবং নিজস্ব প্রতিভাবলে রাজকর্মীরূপে মহারাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং মুস্তাফিউপাধি ও পদপ্রাপ্ত হন।

স্থাপত্যটির নির্মাণ প্রমাণগতভাবে রূপচন্দ্রের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ গৌরিনন্দন মুস্তাফির উদ্যোগে হয়েছিল। যিনি কোচ মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণের আমলে (১৭১৪-১৭৬৩ সাল) রাজ্যের খাসনবিশ পদেও পরবর্তীতে মহারাজা দেবেন্দ্রনারায়ণের সময় (১৭৬৩-১৭৬৫ সাল) মহামন্ত্রীপদে নিযুক্ত ছিলেন। তাই দীর্ঘদিনব্যাপী রাজ্যের এক প্রধান আমলা থাকায় তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই অনন্যসাধারণ স্থাপত্য তৈরি সম্ভবপর হয়েছিল। প্রসঙ্গত বলে রাখা আবশ্যক, মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণের আমলেই কোচবিহারের আরেকটি বিখ্যাত টেরাকোটার বিমিশ্র শৈলীর মন্দির সিদ্ধনাথ শিব মন্দির নির্মাণের সূত্রপাত হয়েছিল। খুব সম্ভবত ১৭৩৬ সালে মুঘল ফৌজদার সৈয়দ আহমদের কোচরাজ্য আক্রমণের পূর্বে তা অনেকাংশে সমাপ্ত হয়েও যায়।
গৌরীনন্দন ছিলেন মহারাজার অতি বিশ্বাসভাজন ও কাছের মানুষদের মধ্যে অন্যতম। মুঘল আক্রমণকালে মহারাজের ঝাড় সিংহেশ্বরে আত্মগোপন পর্বে তিনি তাঁর সর্বদা পাশে ছিলেন। তাই দুটি টেরাকোটা মন্দিরের নির্মাণকাল প্রায় একই সময়ে শুরু হয়। টেরাকোটা মন্দিরটির নির্মাণকালপর্ব আনুমানিকভাবে ১৭২৫-১৭৩৫ সালের মধ্যেই বলে গবেষকদের অভিমত। অর্থাৎ মুঘল আক্রমণের ঠিক পূর্বেই এটিরও নির্মাণ সমাপ্ত হয়।

মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৫ ফুট X ১০ ফুট। ৫ ফুট দেওয়ালের পুরূত্ব। যে ইঁটগুলি নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয়েছিল সেগুলির নির্দিষ্ট আয়তন ৫ X ৩ X ২। ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এই মন্দিরটি স্থাপত্যশৈলীগত দিক থেকে বিমিশ্র স্থাপত্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। কারণ এটিতে বাংলার চিরাচরিত চারচালা স্থাপত্যশৈলীর শীর্ষে অষ্টভুজাকার গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত। এর শীর্ষদেশে আবার কলস ও ত্রিশূলে শোভিত। নিঃসন্দেহে যা ইন্দো-ইসলামীয় বিমিশ্র নির্মাণকৌশলকে নির্দেশিত করে। এই ধরনের অত্যদ্ভূত আকৃতির গম্বুজ এই অঞ্চলে বিরল। মন্দিরের অভ্যন্তরে গর্ভগৃহে একটি শিবলিঙ্গ (কৃষ্ণবর্ণ প্রায় ৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এবং গণেশ ও নন্দীদ্বারা বেষ্টিত) নিজ হস্তে গৌরীনন্দন মুস্তাফি স্বয়ং প্রতিষ্ঠা করেন।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

মন্দিরটির নির্মাণকাল পর্ব থেকেই বাস্তুশাস্ত্রে উল্লেখিত মন্দিরের বাস্তুশাস্ত্র (Temple Ecology) এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কারণ প্রথমত, মন্দিরের পূর্বদিকে অনতিদূরেই এক সরোবর লক্ষিত হয়। যাকে স্থানীয়ভাবে কুণ্ড বলা হয়। মন্দিরের নিকটবর্তী অংশে জলাশয় নির্মাণ মন্দিরের বাস্তুশাস্ত্রের মূল নীতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

দ্বিতীয়ত আলোচ্য মন্দিরে মন্দিরের বাস্তুশাস্ত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য চৈত্য বৃক্ষ (গাছকে পবিত্রজ্ঞানে দেবস্থলরূপে কল্পনা করে উপাসনা) ধারণারও সফল প্রয়োগ ঘটতে দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণে স্থিত একটি পুরাতন বৃহৎ গাছকে কেন্দ্র করে যেটিকে শক্তিস্থল রূপে ভক্তি ও উপাসনা করা হয়। এ সবের পাশাপাশি দেবালয়টির আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য সন্ধান করতে সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫০: আমার সোনার হরিণ চাই—সীতার চাওয়া কি সত্যি হবে?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১১: দাদা অঙ্ক কী কঠিন!

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৪: রিমঝিম ঘিরে শাওন…আবার লতা, কিশোর ও পঞ্চমের সেই জাদু

এই মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হল, মন্দিরের গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে গম্বুজটির অন্তর্দেশীয় শীর্ষে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক পদ্মের অলঙ্করণ, যা নিঃসন্দেহে দেবালয়টির অনন্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। এই অনুপম দেবায়তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বিশেষজ্ঞদের আবিষ্কার, যা হল গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালে জালিযুক্ত জানালার (latticed window) উপস্থিতি, যেটির কাজ হল মন্দিরের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক আলো-বাতাসের যোগান সুনিশ্চিত করা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এই অঞ্চলের অন্যান্য শৈবমন্দিরের ন্যায় এটিতেও গর্ভগৃহের আভ্যন্তরীণ দেওয়ালগাত্রে অর্ধবৃত্তাকার কুলুঙ্গির অস্তিত্ব ও তার সঙ্গে মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রবেশের খিলানের মতো (stilted arch type) প্রবেশপথের নিদর্শন।

তবে দেবালয়টির প্রকৃত দৃষ্টিআকর্ষণকারী তথা সৌন্দর্য্যের প্রতীক হল এর ৯৩টি চতুর্ভুজাকার পোড়ামাটির ফলক। যা এই দেবায়তনটিকে এই অঞ্চলে এক বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। এই পোড়ামাটির ফলকগুলিতে ধর্মীয়, কিংবদন্তীমূলক ও আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটতে দেখা যায়। পোড়ামাটির ফলকগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তর সন্ধান করতে সক্ষম হয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, রাধাকৃষ্ণের লীলা, দশমহাভূজা মহিষাষুরমর্দনী, গণেশ, সরস্বতী, শিবলিঙ্গ উপাসনারত ঋষি, গাভীর দুগ্ধদোহনরত গোয়ালা, মহিলা সঙ্গীতজ্ঞ, ফুলের অলঙ্করণ, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম শোভিত শ্রীবিষ্ণু ও তার বিভিন্ন অবতার (ত্রিবিক্রম, বরাহ, পরশুরাম, শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি), রাধা-কৃষ্ণলীলা, হুঁকা বা সটকা পানরত জমিদার, পাল্কিতে গমনকারী অভিজাত দম্পতি ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৫: রাজবাড়ি এবং অভিনব বিবাহপর্ব

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

১৮৯৭-এর ভয়াবহ ভূমিকম্পে এই সৌধটির প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল, যেখানে মন্দিরের মূল রত্ন ব্যতীত বাকি চারটি রত্ন (৩ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট) ভূমিসাৎ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মন্দিরটিও প্রায় ৮ ফুট গভীরে ধ্বসে যায়। ১৯৪৯ সালে থেকে যখন কোচবিহার ভারত ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মন্দিরটি দীর্ঘদিন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য ২০১৫ সালে বিখ্যাত ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় চুক্তির পর বর্তমানে এটি ভারতের অংশভুক্ত হয়েছে। বলা যেতে পারে যে, এই মন্দিরটির অনুপম স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য এটিকে কোচবিহারের বিমিশ্র স্থাপত্যশৈলীর এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তে অধিষ্ঠীত করেছে।

উপরোক্ত এই দীর্ঘ আলোচনা অন্তে এটা সুস্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, কোচ স্থাপত্যের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির তার নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মন্দিরস্থাপত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। মন্দিরটি যে স্থাপত্যগত দিক থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ, বিমিশ্র ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাও তা আমি আমার গবেষণালব্ধ তথ্য ও চিত্রে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেছি।

পালকিতে গমনকারী অভিজাত দম্পতি ও হুঁকা পানরত জমিদার। (পোড়ামাটির ফলক)।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল, বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ঐতিহ্যশালী স্থাপত্যের বিষয়ে আগ্রহপূর্ণ আলোচনা তথা উৎসাহের অভাব পরিলক্ষিত হয়। যেটুকু হয়েছে তার মধ্যেও কিছু ক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধান্তমূলক (Conclusive) প্রমাণ ব্যতীত অনুমান (Hypothetical Assumption) করা হয়েছে। অথচ এই স্থাপত্যে এমন কিছু আঞ্চলিক, বৈদেশিক ও সাধারণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের আত্তিকরণ ও সংমিশ্রণ লক্ষিত হয়, যার ফলে নিঃসন্দেহাতীতভাবে এই মন্দিরটিকে বাংলার মন্দির স্থাপত্যের পুনরূজ্জীবন পর্বে নবউদ্ভাবিত বিমিশ্র বিবিধ শৈলীর শ্রেণিভুক্ত করা যায়। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের স্থাপত্য বাংলা তথা ভারতের স্থাপত্যশৈলীর সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যময়তার ক্ষেত্রে অপরিসীম অবদান রেখেছে।—চলবে।

ছবি: লেখক।
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content