বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দির।

বাংলায় মন্দির স্থাপত্যের ইতিহাস যুগবিভাজন শ্রেণিকরণ অনুযায়ী দু’ ভাগে বিভক্ত—এক. প্রারম্ভিক পর্ব (ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত) এবং দুই. পুনরুজ্জীবন পর্ব (ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত)। এই শ্রেণিকরণ সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন বিখ্যাত মন্দির স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ তথা গবেষক ডেভিড জে ম্যাককাচ্চন। তবে পরবর্তীতে আরও একজন বিখ্যাত গবেষক তারাপদ সাঁতরা এই বিভাগকেই অনুসরণ করেন। প্রথম পর্বে বাংলার মন্দির স্থাপত্যউত্তর ভারতীয় ‘নাগরো শৈলী’র অন্ধ অনুকরণ করতো বলে উপরোক্ত বিশেষজ্ঞেরা মতপ্রকাশ করেছেন। এই পর্বে বাংলার মন্দিরগুলি মূলত পাল ও সেন রাজাদের উদ্যোগে ও অর্থানুকূল্যে নির্মীত হয়েছিল (অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী)।
 

বাংলার মন্দির স্থাপত্য: কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য-সহ পুনরূজ্জীবন পর্ব

বাংলার মন্দির স্থাপত্যে এক নবউদ্দীপনার সঞ্চার ঘটে এর পরবর্তী পর্বে (যা পুনরুজ্জীবন পর্ব নামে খ্যাত)। এই পর্বে বাংলা উত্তর ভারতীয় শৈলীর প্রভাবমুক্ত হয়ে মন্দির স্থাপত্যে নিজস্বতার ছাপ রাখতে শুরু করে আলাদা আলাদা কয়েকটি স্থাপত্যশৈলীর উৎপত্তির মাধ্যমে। বাংলার মন্দির স্থাপত্য আলোচ্য পর্বে কিছু আঞ্চলিক, বৈদেশিক ও সাধারণ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের আত্তিকরণ ও সংমিশ্রণের মাধ্যমে নিজ মৌলিক তথা সংমিশ্রিত স্থাপত্যশৈলী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

বাংলার মন্দিরগুলিকে প্রারম্ভিক থেকে পুনরুজ্জীবন পর্ব পর্যন্ত ছাদের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। সেগুলি হল: রেখ তথা নাগরো তথা লাতিনো শৈলী, পিড়ো বা ফংসনো শৈলী, বলভী বা খাখরো দেউল শৈলী, হাট বা চালা শৈলী, রত্ন শৈলী, গম্বুজসমন্বিত আচ্ছাদন শৈলী, শঙ্কু আকৃতিবিশিষ্ট আচ্ছাদন শৈলী, দালান বা চাঁদনি শৈলী (সমতল ছাদের মন্দির), রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ ও তুলসীমঞ্চ এবং বিবিধ শৈলী।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮: সুন্দরবনের নিশ্চিহ্ন প্রাণী

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৪: রাজ পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ও ব্রাহ্মবাদ

ভৌগোলিকভাবে বাংলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তের সীমান্তবর্তী অংশে অবস্থিত কোচবিহারের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য। স্থাপত্যশৈলীগত দিক থেকে বাংলার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মন্দিরসমূহ অন্তমধ্যযুগ কালপর্ব থেকে বিভিন্ন স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের আত্তিকরণ ও সংমিশ্রণের মাধ্যমে নিজ মৌলিক তথা সংমিশ্রিত স্থাপত্যশৈলী দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছে। গঠনগত দিক থেকে কোচ মন্দিরস্থাপত্য মূলত মিশ্রশৈলীভুক্ত।

তাই কোচ স্থাপত্যশৈলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দিরের আনুপূর্বিক ইতিহাসের বিবরণপ্রদানের পূর্বে কোচবিহারের ভৌগোলিক অবস্থান এবং তৎকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা অত্যন্ত আবশ্যক যা সন্দেহাতীতভাবে বাংলার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনন্য সাধারণ স্থাপত্যশৈলীর উদ্ভবে মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩১: বিড়াল ঘাঁটলেই কি ডিপথেরিয়া হতে পারে?

 

কোচবিহারের ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট

কোচবিহার যে ভৌগোলিক অঞ্চলে অবস্থিত, মধ্যযুগে তা প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ কামরূপের একাংশরূপে অবশ্যই পরিগণিত। সুতরাং কোচবিহারের ইতিহাস আদতে কামরূপের বিস্তৃত ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রাচীন কামরূপ সাম্রাজ্য মূখ্যত চারটি পবিত্র পীঠের সমন্বয়ে গঠিত—কামপীঠ, রত্নপীঠ, সুবর্ণপীঠ ও সৌমারপীঠ। কোচবিহার কামপীঠের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ভৌগোলিকভাবে কোচবিহার উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলা ও অসমপ্রদেশের সীমান্তবর্তী অংশে অবস্থিত। নিঃসন্দেহে ভৌগোলিক দিক থেকে কোচবিহার যে বাংলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এতে কোনও দ্বিমত নেই। রাঢ়বঙ্গের সঙ্গে কোচবিহারের বিস্তৃত দূরত্ব যেখানে মন্দিরনির্মাণের পুনরুজ্জীবন পর্বের মূল শৈলীগুলির উত্থান ঘটেছিল ও পাশাপাশি পাশ্ববর্তী অসমের সঙ্গে ভৌগৌলিক নৈকট্য সুনিশ্চিতভাবে এই অঞ্চলের স্থাপত্যশৈলীর এক নির্দিষ্ট, মিশ্র তথা মৌলিক ঘরানার উত্থান ও বিকাশকে প্রভাবিত করেছিল।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৮: হৃদয়ে আমার দিয়েছে ঢেউ, ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ

 

কোচবিহারের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

বর্তমানকালের কোচবিহারের ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলে সুস্পষ্টভাবে এটা বোঝা যাবে যে, এই অঞ্চলের পূর্বেকার ইতিহাস প্রাগজ্যোতিষপুর তথাকামরূপ—এই আঞ্চলিক বিভাগের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। কারণ বর্তমান কোচবিহারের প্রায় সমগ্র অংশই এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কামরূপের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায় দুই মহাকাব্যে (রামায়ণ ও মহাভারত) যেখানে এই অঞ্চলটিকে একটি পাহাড়ি এলাকা হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটি যে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত তাও উল্লেখিত হয়েছে।

মহাভারতে প্রাগজ্যোতিষ অঞ্চলের একজন রাজা ভগদত্ত-র নাম বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। যাঁর কিরাত, চিনা এবং সমুদ্র উপকূলে বসবাসকারী অপরাপর বিভিন্ন যুদ্ধবাজ উপজাতী সমন্বিত বৃহৎ সেনাবাহিনী ছিল। এই কারণেই প্রাগুক্ত অঞ্চলটি খ্যাত ছিল কিরাতভূমি নামে (অর্থাৎ কিরাতদের ভূমি। এখানে কিরাত অর্থে এই অংশে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রান্তিক জনজাতি ও উপজাতিদের বোঝানো হয়েছে)। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে এই অঞ্চলে প্রাপ্ত বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য এবং অর্থনৈতিক অনুবৃত্তি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক উপাদানে আমরা কামরূপের উল্লেখ পাই, যেটি হল সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি যেখানে কামরূপকে ভারতের একটি সীমান্তবর্তী রাজ্যরূপে বর্ণন করা হয়েছে।

বরাহ ও ত্রিবিক্রম অবতার (পোড়ামাটির ফলক)।

মধ্যযুগের মধ্য পর্বে এই কামরূপের পশ্চিমাংশের পশ্চিম সীমা ছিল করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। সেটি পরে কামতা নামে পরিচিত ও খ্যাত হয়ে ওঠে। কারণ তাকে কেন্দ্র করে পঞ্চদশ শতকে খেনদের উদ্যোগে একটি পৃথক স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। খেন বংশের সক্রিয় সহযোগীতাতেই আলোচ্য সময়ে এঅঞ্চলে স্থাপত্য-ভাস্কর্য্য শিল্পে এক নবপ্রবাহের সূত্রপাত হয়। সেসময় এই অংশ-কোচ, মেচ, গারো, ত্রিপুরি, কাছারি, নেপচা ইত্যাদি বিভিন্ন উপজাতি দ্বারা অধ্যুষিত ছিল যাঁরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির আওতা থেকে বহু দূরে ছিল। এরূপ এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে কান্তনাথ নামক একজন তেজস্বী গোপালক নিজস্ব কর্মোদ্যোগ ও এক ব্রাহ্মণ সহযোগীর সক্রিয় পরামর্শে এই অঞ্চলে এক নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই কান্তনাথ ছিলেন খেন উপজাতিভুক্ত।

খেনরা কোন জাতিভুক্ত ছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, খেনরা ছিলেন মোঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর ভোট-তিব্বত শাখাভুক্ত। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই কান্তনাথনীলধ্বজ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করে ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করেন এবং সহযোগী ব্রাহ্মণকে রাজগুরু পদে বরণ করেন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম তথা সংস্কৃতির ইতিবাচক সূত্রপাতও আলোচ্য সময় থেকে শুরু হয়। আলোচ্য কালপর্ব থেকে প্রথমে স্বল্পস্থায়ী খেন শাসকদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে মন্দির স্থাপত্যের যে সমন্বয়করণ, সংমিশ্রণ ও সংকরায়ণের ব্যাপক প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটেছিল তা পরবর্তী কোচ শাসকদের দীর্ঘকালব্যাপী শাসনে ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতকের মধ্যে তা চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছয়। এই অঞ্চলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াগত দিক থেকে যে মেলবন্ধনের পর্ব চলেছিল তাই-ই একদিক থেকে স্থাপত্যশৈলীগত বিমিশ্রকরণের যথাযথ পটভূমিকা রচনা করেছিল এটা বলা যেতে পারে। —চলবে।
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’

Skip to content