শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


দ্বারকানাথ ঠাকুর।

জনহিতকর কাজ দ্বারকানাথ ঠাকুর কম করেননি। ডাক্তারি-পড়ুয়াদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বছরে দু’হাজার টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। ভালো করে চিকিৎসা-বিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য দু’জন ছাত্রকে নিজের খরচে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় শব-ব্যবচ্ছেদ যতই জরুরি হোক না কেন, অনেক ছাত্রই কাটাছেঁড়ায় রাজি ছিল না। তাদের উৎসাহিত করতে দ্বারকানাথের তৎপরতার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার কথা তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন। তাঁর ভালো কাজের তালিকা করতে বসলে ক্রমেই তা দীর্ঘ হয়ে যাবে। সে সব আড়াল করে রাখতে, জল মিশিয়ে কেতাব লিখতে কেউ কেউ অভ্যস্ত। দ্বারকানাথ নৃত্যগীতির আসর বসাতেন, মদ্যপানের ফোয়ারা ছোটাতেন। এসব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখে যত আনন্দ! বলে রাখা ভালো, এসব তিনি করতেন নিজের ব্যবসা বাঁচাতে। ব্যবসার গতি অব্যাহত রাখতে। ইংরেজদের খুশি করে চলা ছাড়া তাঁর কাছে অন্য কোনও পথ ছিল না। নিতান্তই নিরুপায় হয়ে দ্বারকানাথ সাহবসুবোদের সঙ্গ করতেন। আয়োজন করতেন নৃত্য-গীতির, সঙ্গে থাকত মদ্যপানের দেদার ব্যবস্থা। জনহিতকর কাজের নয়, বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে সুরা নারীর মচ্ছব, দ্বারকানাথের ভ্রষ্টাচার—এসব নিয়ে সেকালে কত কথা চালাচালি, চলত রকমারি আলোচনা! এখনও কি সেসব থেমেছে, বরং এখন মাত্রাতিরিক্ত বিকৃত আলোচনারই বাড়বাড়ন্ত। দ্বারকানাথের জনহিতকর কাজ আড়ালে রেখে আমোদ-আয়োজনের এমনতরো প্রচার তাঁর পরিবারজীবনেও সংকট দেখা দিয়েছিল। দ্বারকানাথের পত্নী দিগম্বরী দেবী ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। বাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তাঁর মুখের আদলে তৈরি হত। গৃহদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের নিত্যসেবা নিজের হাতে করতেন তিনি। স্বামীর বিলাসব্যসন দিগম্বরী দেবীকে এতখানিই আহত ও রুষ্ট করেছিল যে তিনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে শাস্ত্রমতে বিধান কী, তাও জানতে গিয়েছিলেন। এক শয্যায় শয়ন তো দূরের কথা, স্বামীর ছোঁয়া লাগলেই তিনি স্নান করতেন। দ্বারকানাথ শেষে নিরুপায় হয়েই গৃহত্যাগী হয়েছিলেন। থাকতেন বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে।

বিলাসী-জীবনে রং চড়িয়ে যাঁরা আলোচনায় ব্যস্ত, তাঁরা প্রিন্স দ্বারকানাথের কৃতিত্ব-মহত্ত্ব আড়াল করেই রাখতে চান। শুধু রামমোহনের নয়, সতীদাহপ্রথা নিবারণে দ্বারকানাথেরও যে উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে, তা ছাত্রপাঠ্য ইতিহাস বইতে যথাযথভাবে লেখা নেই। দ্বারকানাথ না থাকলে রামমোহন লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে এত সহজে পৌঁছতে পারতেন কি না, পৌঁছলেও তাঁর কথা মান্যতা পেত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়! চিন্তায় চেতনায় প্রগতিশীল, যাবতীয় কুসংস্কার-বিরোধী দ্বারকানাথ রামমোহনকে লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সতীদাহ কতখানি ভয়ংকর, তা বেন্টিঙ্ককে বোঝাতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথের পুত্র, দ্বারকানাথের প্রপৌত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে লিখেছেন, ‘আমরা যত দূর জানিয়াছি, তাহাতে বলিতে পারি যে লর্ড বেন্টিঙ্কের সহিত দ্বারকানাথ ঠাকুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। বেন্টিঙ্ক দ্বারকানাথ ঠাকুরের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও প্রীতি সহকারে শ্রবণ করিতেন। দ্বারকানাথ বেন্টিঙ্কের সহিত প্রায়ই সাক্ষাৎ করিতে লাটভবন যাইতেন। বেন্টিঙ্ক রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর উভয়কেই যখন সতীদাহের বিরুদ্ধে একমত দেখিলেন, তখন তাহা উঠাইয়া দিতে দ্বিধা করলেন না।’

দ্বারকানাথের জন্ম গোঁড়া বৈষ্ণব-পরিবারে। নিরামিষাশী, রান্নাঘরে পেঁয়াজও ঢুকত না। দ্বারকানাথ ব্রাহ্মণপরিবারের আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি কঠোরভাবে মেনে চলতেন। রামমোহন ছিলেন একেবারেই উলটোপিঠ। প্রতিমাপুজোর ঘোরতর বিরোধী। হিন্দুদের পৌত্তলিকতাপ্রথার প্রকাশ্যে তীব্র ভাষায় নিন্দা করতেন। অন্তঃসারশূন্যতার কথা বলতেন। এই বৈপরীত্য বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠেনি। কীভাবে এই সম্পর্কের সূত্রপাত, ক্রমে গভীরতা, সে-প্রসঙ্গে ঠাকুরবাড়ির আত্মজন ও ‘রবীন্দ্রকথা’-র রচনাকার খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন। দ্বারকানাথ ও দিগম্বরীর প্রথম-সন্তান জন্মগ্ৰহণের কিছুকাল পরই মারা যায়। শোকে মুহ্যমান তাঁরা। সে-সময় এক দৈবজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, দিগম্বরীর কোনও সন্তানই দীর্ঘজীবী হবে না।

শোকধ্বস্ত ও প্রবলভাবে বিচলিত দ্বারকানাথ সঠিক পরামর্শের প্রত্যাশায় ছুটে গিয়েছিলেন রামমোহনের কাছে। জানিয়েছিলেন বিপন্নতার কথা। সব শুনে রামমোহনের পরামর্শমতো এক তন্ত্রসাধকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। বয়সের ব্যবধান বন্ধুত্বে বাধা হয়ে ওঠেনি। দ্বারকানাথের জীবনীকার ক্ষিতীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘লৌহ ও চুম্বক যেমন পরস্পরকে আকর্ষণ করিয়া থাকে, সেইরূপ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বৎসরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রৌঢ় এবং কুড়ি-বাইশ বৎসরের যুবক পরস্পরকে আকর্ষণ করিয়াছিলেন।’

ঠাকুরবাড়ির জামাতা কৃষ্ণ কৃপালনী দ্বারকানাথকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। সে-বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন আশ্রমিক ক্ষিতীশ রায়। বইটিতে কৃষ্ণ কৃপালনী বিশ্লেষণ করেছেন নানা বৈপরীত্য সত্ত্বেও কী কারণে এই নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাঁর লেখায় আছে, ‘দ্বারকানাথ রামমোহনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর চারিত্র্যগুণে। প্রবল সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মধ্যে ছিল অসাধারণ তেজস্বিতা৷… সমাজ-সংস্কারে তাঁর উৎসাহ ছিল অদম্য। যুক্তি বিচারে অনুরাগ ছিল প্রবল। উপরন্তু স্বদেশের ও স্বজাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতে তাঁর গভীর আস্থা ছিল। এইসব গুণের একত্র সমাবেশ নিশ্চয় দ্বারকানাথকে মুগ্ধ করে থাকবে।’

রাজা রামমোহন রায়।

রামমোহনের সঙ্গে দ্বারকানাথের সুসম্পর্ক ও সখ্য হিন্দুরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। রামমোহন ধর্মদ্রোহী, তাঁর সঙ্গে দ্বারকানাথের বন্ধুত্ব হয় কী করে! রামমোহনের সম্পর্কে শুধু নয়, দ্বারকানাথের সম্পর্কেও বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে! অকথা-কুকথা ছড়িয়েছে। তাদের কে বোঝাবে, রামমোহনের গুণাবলিই দ্বারকানাথকে মুগ্ধ করেছিল, গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বে পলকা নয়, ছিল যথেষ্ট জোর, হিন্দুসমাজের বাক্যবাণে সামান্যও ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়নি।

স্বামীর মৃত্যুর পর পত্নীরা সকলেই যে স্বেচ্ছায় সেকালে সতী হতে চাইত, তা নয়। সমাজপতিরা ধর্মকে সামনে রেখে জোর করেই তুলত চিতায়। এই পৈশাচিক-কাণ্ডের আড়ালে থাকত প্রয়াতজনের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার অপচেষ্টাও!
সতীদাহ নিয়ে কত হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে! ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই থেকে জানা যায়, গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টের পত্নীর দিনলিপিতে বর্ণিত একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার কথা। ঘটনাটি এ-রকম, এক যুবকের মৃত্যু হয় কলেরায়। পত্নী সহমরণে যাবে, চলে সে-তোড়জোড়। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শোকধ্বস্ত পত্নীটিকে তোলা হয় চিতায়, শেষে অগ্নিসংযোগ! আগুনের লেলিহান শিখা তাকে সেভাবে তখনও স্পর্শ করেনি। মরণের ইচ্ছা মুহূর্তে কোথায় উবে যায়! চিতা ছেড়ে দৌড়োতে থাকে সে। কাছেই গাছগাছালি, আরণ্যক পরিবেশ। ঢুকে পড়ে সেই জঙ্গলে।

চিতার ধুয়োর আড়ালে এসব ঘটে। কেউ খেয়াল করেনি। খানিক পরে, নজরে আসতেই সকলে স্তম্ভিত! কোথায় গেল সেই চিতায় তোলা কিশোরী, তার দেহ তো চিতায় নেই! সমবেত মানুষ খেপে ওঠে, ছুটতে থাকে অরণ্যের দিকে। শেষ পর্যন্ত ধরে ফেলে তাকে। যেভাবেই হোক মারতে হবে সদ্য স্বামীহারা কিশোরীটিকে! চিতায় পুড়িয়ে মারা তো আর হল না! অবলম্বন করতে হবে ভিন্নতর পথ! একটি ডিঙিনৌকোতে জোর করে তোলা হয় তাকে। তারপর ফেলে দেওয়া হয় নদীর মধ্যস্থলে। এমন কত মর্মান্তিক বর্ণনা, ঘটনার উল্লেখ রয়েছে নানাজনের রচনায়, দিনলিপিতে!

সতীদাহ আইন করে সরকারিভাবে বন্ধ হওয়ার পর লর্ড বেন্টিঙ্কের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন রামমোহন ও দ্বারকানাথ। মুক্তমনের অধিকারী নগরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের একত্রিত করে টাউনহলে লর্ড বেন্টিঙ্ককে অভিনন্দিত করা হয়েছিল। লেখা হয় দু’টি অভিনন্দন-পত্র। একটি বাংলায়, আরেকটি ইংরেজিতে। দু’টি অভিনন্দন-পত্রেই রামমোহনের সঙ্গে দ্বারকানাথও স্বাক্ষর করেছিলেন।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরবাড়িকেই শুধু আধুনিকতার আলোয় আলোকিত করেননি, সেই আলো পড়েছিল সমাজজীবনে। সতীদাহ-রদ হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বারকানাথেরও যে ভূমিকা রয়েছে, তা অবশ্য সেভাবে প্রচারিত হয়নি।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content