শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ কবিতায় ‘কেষ্টা’কে অমরত্ব দিয়েছেন। বাস্তবে অবশ্য তেমন ‘কেষ্টা’ নামে কোনও ‘পুরাতন ভৃত্য’-র অস্তিত্ব ছিল না। আমরা জানি, ছেলেবেলায় তাঁর শ্যাম ছিল, ঈশ্বর ছিল। এই দুই ভৃত্যের কথা ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে।‌‌ দু’জনের কথা আমাদের সুবিদিত, দু’জনেই পরিচিত। শ্যামের কথা‌ অধিক পরিচিত, যে সীতাহরণের গল্প শুনিয়ে শিশু রবীন্দ্রনাথকে খড়ির গণ্ডিতে বন্দি করে রাখত। ‘ঈশ্বর‌’ নামের ভৃত্যটি ছিল ভারি মজার, কথা বলত বিশুদ্ধ সাধু ভাষায়! ‘বরানগর’ না বলে তার মুখে শোনা যেত ‘বরাহনগর’। ঈশ্বরের সাধু ভাষায় কথা বলা নিয়ে বাড়ির বড়রা যে হাসাহাসি করত, তা বালক রবীন্দ্রনাথের নজর এড়িয়ে যেত না। ছোটদের জলখাবার কিনে দেওয়ার জন্য ঈশ্বরকে প্রতিদিন পয়সা‌ দেওয়া হত। সস্তাদরের খাবার ফরমাশ করলেই খুশি হত। বাড়তি পয়সা নিজের পকেটস্থ করত সে।

পরিণত বয়সে কবির বিশ্বস্ত ভৃত্য ছিল বনমালী। বনমালী কবির নিত্যদিনের সঙ্গী । কবি কাছে-দূরে ভ্রমণে বের হলেও বনমালীকে সঙ্গে নিতেন। একবার নিয়ে গিয়েছিলেন শিলং-পাহাড়ে। কবির আরেক ভৃত্য ছিল সাধুচরণ। সাধুচরণও কখনও কখনও কবির যাত্রাসঙ্গী হয়েছে। তাদের ঘিরে কবির নির্ভরতা ছিল, আবার অন্তর উৎসারিত স্নেহসুধাও ছিল। রবীন্দ্রনাথ যে তাদের সত্যিই ভালোবাসতেন, তা বারবার নানা ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে!

ঠাকুরবাড়ির কেউই মনুষ্যত্বের অবমাননা করেননি। বাড়ির ভৃত্য বা কাজের লোককে কখনও ‘ছোট’ করে দেখা হয়নি। ভালোবাসায়, প্রশ্রয়ে তারাও ‘আপনার জন’ হয়ে উঠেছিল। ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বাড়তি ভালোবাসা ছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রাণিত না করলে রং-তুলির পাশাপাশি হাতে কলম তুলে নিতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে! ভাগ্যিস, রবীন্দ্রনাথ উৎসাহিত করেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথ কলম ধরেছিলেন, লিখেছিলেন চমৎকার সব বই!‌ সেসব বই বাঙালির শৈশব-বাল্যকে বর্ণময় করে তুলেছে। হাসিতে খুশিতে ভরিয়ে দিয়েছে। কবির প্রত্যক্ষ প্রেরণায় ‘শকুন্তলা’ রচনার মধ্য দিয়ে সে-যাত্রাপথের শুভ সূচনা হয়েছিল।

কবির পরম স্নেহভাজন অবনীন্দ্রনাথও বাড়ির কাজের লোকদের কতখানি স্নেহ করতেন, তা বললে গল্পকথার মতো শোনাবে! স্নেহ করতেন পরিণত বয়েসে, স্নেহ পেয়েছেন ছেলেবেলায়। সে-স্নেহ আত্মীয়স্বজনের থেকে কোনও অংশে কম নয়। শৈশবে‌-বাল্যে পদ্মদাসী শুনিয়েছে কত না গল্প-ছড়া! সমাজজীবনে ছড়িয়ে থাকা লোকায়ত ছড়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনিও সংগ্ৰহ করেছেন। তাঁর সাহিত্যে, গদ্যভাষায় যে লোকায়ত গল্প-ছড়ার প্রভাব, আগ্ৰহ-ভালোবাসা, তার শুরু ওই শৈশব-বাল্যে! এই ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছিল পদ্মদাসী।

পরিণত বয়েসে অবনীন্দ্রনাথের ‘খাস খানসামা’ ছিল রাধু। তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন অবনীন্দ্রনাথ। রাধু পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছিল। বালক-বয়েস থেকে সারাক্ষণ অবনীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকতে থাকতে রাধুর চোখ খুলে গিয়েছিল। ছবির ভালো-মন্দ বুঝত, অন্তত অবনীন্দ্রনাথ তেমনই মনে করতেন। কোনও ছবি আঁকার পর অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখাতেন। মতামত চাইতেন। রাধুর মতামত গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন, আলোচনা করতেন।

সেই রাধু একদিন অবনীন্দ্রনাথের কাছে এসে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়াল। অবনীন্দ্রনাথের তখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। রোজই তাঁকে যেতে হয়‌ ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টসে। অনেক দায়দায়িত্ব। নিষ্ঠার সঙ্গে সেসব পালন করতে‌ গিয়ে দিন কাবার। চলেছে বাৎসরিক প্রদর্শনীর তোড়জোড়। সারাদিন খাটাখাটনির পর বাড়ি ফিরে অবনীন্দ্রনাথ রোজের মতো একটু বসেছিলেন সুহাসিনী দেবীর কাছে। দিনের ক্লান্তি ভুলতে দুটো সাংসারিক কথাবার্তা, গল্পগাছা। ঠিক তখনই রাধু এল। হাতে অবনীন্দ্রনাথের জন্য জল ও পান। ফেরার পর এসব এনে মনিবের হাতে তুলে দেয় প্রতিদিন। সেদিনও তুলে দিল। অন্যদিনের মতো খুশি-খুশি নয়, খানিক মলিন ও শুষ্ক। ব্যাজার মুখ দেখে অবনীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, কী হয়েছে!

রাধুর মুখে আলতো হাসি খেলে গেলেও মুখে কিছু বলল না। বললেন সুহাসিনী দেবী। হাসতে হাসতে প্রবল উচ্ছ্বাসে অবনীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি জানো না? রাধুর যে আবার বিয়ের ঠিক হয়েছে!’

খোলসা করলেন সুহাসিনী। দেশ থেকে চিঠি এসেছে। মাসখানেকের মধ্যেই বিয়ে।
রাধুর একবার বিয়ে হয়েছিল। সে বউ মারা গিয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ মনমরা হয়ে না থেকে তাকে আবার বিয়ে করতে বলেছিলেন! এমনও বলেছেন, ‘জানিস তো, ভাগ্যবানের বউ মরে আর অভাগার ঘোড়া মরে।’
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রাধু বিয়ে করতে পারছিল না। কারণ বিয়ে করা তো কম ঝকমারির নয়! কনের বাপকেও পণ দিতে হয়। এত টাকা পাবে কোথায়?

আসল সমস্যা স্পষ্ট করলেন সুহাসিনী। বিয়ে তো ঠিক হয়েছে! বিয়ে করতে খরচ অনেক। খরচাপাতির টাকা কোথায়, কীভাবেই বা পাবে সে !

পত্নী সুহাসিনী, ছবিটি অবনীন্দ্রনাথের আঁকা।

অবনীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন কত টাকা খরচা হতে পারে! রাধু জানাল, কনের বাবাকে একশো টাকা পণ দিতে হবে। বউকে একখানা সোনার হার দিতে হবে, সেও শ’খানেক টাকার কম নয় ! এর ওপর আছে বিয়ের খরচা, খাওয়ানোর খরচা!

অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘হোক খরচা! বিয়ে-শাদি না করে তা বলে রাধু সন্ন্যাসী হয়ে থাকবে!’
সমস্যা যে গুরুতর, তা অবনীন্দ্রনাথের বুঝতে বাকি রইল না। দু’দণ্ড চিন্তা করে অবশ্য মুশকিল-আসান করে ফেললেন। আশ্বস্ত করলেন রাধুকে। বললেন, চিঠি লিখে দিতে দেশে। বিয়ে হবে। টাকার অসুবিধা হবে না।

শুনে রাধু তো ভারি খুশি! তার আনন্দ আর ধরে না। কালো মুখে আলো জ্বলে ওঠে। প্রথমে মনে হয়েছিল, অবনীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই কিছু টাকা তাঁর ‘পুরাতন ভৃত্য’র হাতে তুলে দিয়ে বলবেন, খরচাপাতি দিলাম, যাও, বিয়ে করে ফিরে এসো।’
না, তেমনভাবে নয়, টাকা দিলেন অন্য উপায়ে। অবনীন্দ্রনাথ পরম যত্নে একটি ছবি আঁকলেন। রাধুর ছবি। সে-ছবি এ-রকম, রাধু বর্ষাদিনে বসে আছে পুকুরপাড়ে। মাথার উপর ছাতা মেলে ধরেছে গাছের ডালপালা।‌ মাথায় তার লাল গামছা। মাছ ধরছে সে। দৃশ্যটি অবনীন্দ্রনাথের রং-তুলিতে জীবন্ত হয়ে উঠল।
অবনীন্দ্রনাথ সেই ছবি বাড়ির সবাইকে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখা যাক, কী হয়! এবার রাধুর কপালের জোর!’

অবনীন্দ্রনাথ ছবিটি দিলেন ইন্ডিয়ান সোসাইটির প্রদর্শনীতে। ছবির তলায় দাম লিখলেন, তিনশো টাকা। অবনীন্দ্রনাথ নতুন ছবি এঁকেছেন, চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল । যাঁরা ছবি নিয়ে চর্চা করেন, ছবি কেনেন, তাঁদের তো কৌতূহলের আর শেষ নেই! নতুন ছবির আকর্ষণেই অনেকে এক্সিবিশন দেখতে গেলেন।

অনেকদিন পর তুলি ধরলেন, দারুণ ছবি এঁকেছেন, বললেন কেউ কেউ। প্রশংসা সঙ্গে একটু অনুযোগ। দু’চারজন বললেন, ‘দামটা একটু বেশি।’ অবনীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তরে হাসলেন। হেসে বললেন, ‘বড্ড যে টাকার দরকার!’

এভাবে দু-একদিন কাটার পরে হঠাৎ এক অচেনা সাহেব ওই প্রদর্শনীতে এলেন। সব ছবি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলেন। নানাজনের নানা রকম ছবি দেখতে দেখতে শেষে অবনীন্দ্রনাথের ছবিটি কিনে ফেললেন। পরে জানা যায়, বেলজিয়ামে তাঁর বাড়ি। নামকরা এক সুরকার তিনি। জানা গেল, ছবিটি‌ ভারি পছন্দ হয়েছে। কিনলেন দেশের মিউজিয়ামে দান করার জন্য।

অবনীন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে ছবি বিক্রির টাকা সুহাসিনীর হাতে তুলে দিলেন । একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, ‘রাধুকে দাও। তাড়াতাড়ি দেশে গিয়ে বিয়ে করে ফিরে আসুক।’
রাধু তো দেশে গেল বিয়ে করতে। দিন যায়, রাধুর ফেরার নাম নেই। অবনীন্দ্রনাথের খুবই অসুবিধা হয়। সুহাসিনী বারবার বলেন, রাধুকে চিঠি লেখো। অনেকদিন তো হল, এবার চলে আসুক।

অবনীন্দ্রনাথ শুনে হাসেন। হেসে বলেন, ‘দ্বিতীয় পক্ষের বউ। এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারে?’ সুহাসিনী ছাড়ার পাত্রী নন! সারাক্ষণ দেখছেন, রাধু না থাকায় অবনীন্দ্রনাথের খুব অসুবিধা হচ্ছে। শেষে অনেক পীড়াপীড়িতে অগত্যা চিঠি লিখতে রাজি হলেন অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্র-কন্যা উমা দেবীর সৌজন্যে চিঠিটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। চিঠিটি ছিল এরকম,

‘কল্যাণবরেষু,
বাবা রাধু, তোমার মাতা ঠাকুরাণীর আদেশ মত এই পত্র লিখিলাম। তোমার বিবাহকার্য সমাধা হইয়া থাকে তো এই পত্রপাঠ মাত্র চলে আসিবে। তোমার পিতাঠাকুরের কার্যে অসুবিধা হইতেছে। তুমি নব বধূমাতাকে আমার আশীর্বাদ দিবে। এই পত্র টেলিগ্রাম বলিয়া জানিবে। ইতি —
তোমার পিতাঠাকুর ‌‌
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’


হ্যাঁ, রাধু ফিরে এসেছিল। রাধুকে ফিরে পেয়ে অবনীন্দ্রনাথের মুখে হাসি ফুটেছিল। রাধুর মুখে অবশ্য হাসি ছিল না, খুশি ছিল না, থাকবেই বা কী করে! নতুন বউ যে দূরে, দেশের বাড়িতে। তার জন্য মন কেমন করা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়!

ছবি : লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content