বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
হুগলির বাঁশবেড়িয়াতে থাকতেন হরদেব চট্টোপাধ্যায়। হরদেবের সঙ্গে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছিল ভালোবাসার বন্ধন, গভীর বন্ধুত্ব। মহর্ষি বাঁশবেড়িয়াতে বেড়াতেও গিয়েছিলেন। ব্যান্ডেল ছাড়িয়ে গঙ্গার পার্শ্ববর্তী এক মনোরম গ্ৰাম বাঁশবেড়িয়া। চারদিকে সবুজের সমারোহ। ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে পেলেন এক দুঃসংবাদ। বন্ধু হরদেবের পিতৃদেব প্রয়াত হয়েছেন। হরদেবকে সান্ত্বনা দিয়ে ভ্রমণ সেরে ফিরে আসেননি, প্রকৃত বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কর্তব্যপালন করেছেন। জোড়াসাঁকোয় ফিরেও সদ্য পিতৃহারা হরদেবের মলিন-মুখটি মহর্ষিদেবের বারবারই মনে পড়ে গেছে। ভালোভাবে যাতে তাঁর বন্ধুটি পিতৃদেবের শ্রাদ্ধাদি করতে পারে, সেজন্য আর্থিক সাহায্যও পাঠিয়েছিলেন।
পিতৃদেবের মৃত্যুর পর স্মৃতি-বিজড়িত বাঁশবেড়েতে হরদেব আর থাকেননি। চলে এসেছিলেন কলকাতায়। শাঁখারিটোলা-বৌবাজারে ভাড়াবাড়িতে থাকার পর হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে একটি ছোট বাড়ি কিনেছিলেন।
হরদেব তিনবার বিবাহ করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর দুই কন্যা। দ্বিতীয়জন নিঃসন্তান। তৃতীয়জনের সঙ্গেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তৃতীয় পক্ষের আট কন্যা ও তিন পুত্র। দুই কন্যা নৃপময়ী ও প্রফুল্লময়ীর বিবাহ হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। নৃপময়ীর সঙ্গে বিবাহ হয় মহর্ষি-পুত্র হেমেন্দ্রনাথের, প্রফুল্লময়ীর সঙ্গে বীরেন্দ্রনাথের। নৃপময়ীর বিবাহসূত্রে প্রফুল্লময়ী মাঝেমধ্যেই মায়ের সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় যেতেন। স্বর্ণকুমারী-শরৎকুমারীদের মনে ধরেছিল তাঁকে, বধূ হিসেবে বাড়িতে আনতে তৎপর হয়েছিলেন। প্রফুল্লময়ী জোড়াসাঁকোয় এলে তাঁকে নিজের হাতে সাজাতেন তাঁরা। বীরেন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। বীরেন্দ্রনাথ হয়তো-বা তখন বাড়ির বারান্দায়, প্রফুল্লময়ী কিছুতেই যেতে রাজি হতেন না। তেমনই একটি দিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, তখন লজ্জাই বেশী ছিল। কাজেই আমি কিছুতেই বাহিরে তাঁর সামনে যাইতে রাজী হইলাম না, বাড়ির ভিতরে চলিয়া আসিলাম।’ প্রফুল্লময়ী প্রকাশ্যে আসতে যতই দ্বিধা করুন না কেন, অচিরেই বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিবাহ-আয়োজন হয়েছে। তখন তিনি সবে সাড়ে বারোতে পড়েছেন। বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বয়েসের ব্যবধান অনেকখানি। বিবাহকালে বীরেন্দ্রনাথের বয়েস ছিল একত্রিশ।
প্রফুল্লময়ীরা খুব অবস্থাপন্ন ছিলেন না। সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। ঠাকুরবাড়ির তরফে সব সময়েই নানাভাবে সাহায্য করা হয়েছে। বিয়ের পরের দিন এক বাক্স গয়না নিয়ে হাজির হয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সেসব গয়না পরিয়ে বধূমাতাকে গৃহে আনা হয়েছিল। ঠিক পালকি নয়, পালকির মতো দেখতে, আনা হয়েছিল তাঞ্জামে চাপিয়ে। বাড়িতে পৌঁছোনো মাত্র শাশুড়িমাতা সারদাসুন্দরী পান-সন্দেশ খাইয়ে বধূমাতাকে বরণ করে নিয়েছিলেন। আটদিন পর বাপের বাড়িতে যাওয়ার সময় সারদাসুন্দরী নিজের হাতে নববধূকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি চুনি-মুক্তোর নথ ছিল। প্রচণ্ড ভারী। সেটি পরাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটে। পরতে খুব কষ্ট হয়, ব্যথা লাগে। চোখ দিয়ে প্রফুল্লময়ীর জল পড়তে থাকে।
বাবা-মাকে ছেড়ে এক নতুন পরিবারে, নতুন পরিবেশে এসে প্রথম-প্রথম খুব কষ্ট হলেও শ্বশুরবাড়ির সকলের আন্তরিক ব্যবহারে সে-কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন প্রফুল্লময়ী। তাঁর লেখায় আছে সেই আনন্দময় পরিবেশের বর্ণনা। তিনি জানিয়েছেন, ‘বিবাহের পর শ্বশুরবাড়িতে আসিয়া ননদ, জা ও আত্মীয়স্বজনদের নিকট হইতে এত আদর-যত্ন পাই যে তাহাতেই অনেকটা বাপমায়ের শোকটা ভুলিতে পারিয়াছিলাম।’
পিতৃদেবের মৃত্যুর পর স্মৃতি-বিজড়িত বাঁশবেড়েতে হরদেব আর থাকেননি। চলে এসেছিলেন কলকাতায়। শাঁখারিটোলা-বৌবাজারে ভাড়াবাড়িতে থাকার পর হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে একটি ছোট বাড়ি কিনেছিলেন।
হরদেব তিনবার বিবাহ করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর দুই কন্যা। দ্বিতীয়জন নিঃসন্তান। তৃতীয়জনের সঙ্গেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তৃতীয় পক্ষের আট কন্যা ও তিন পুত্র। দুই কন্যা নৃপময়ী ও প্রফুল্লময়ীর বিবাহ হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। নৃপময়ীর সঙ্গে বিবাহ হয় মহর্ষি-পুত্র হেমেন্দ্রনাথের, প্রফুল্লময়ীর সঙ্গে বীরেন্দ্রনাথের। নৃপময়ীর বিবাহসূত্রে প্রফুল্লময়ী মাঝেমধ্যেই মায়ের সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় যেতেন। স্বর্ণকুমারী-শরৎকুমারীদের মনে ধরেছিল তাঁকে, বধূ হিসেবে বাড়িতে আনতে তৎপর হয়েছিলেন। প্রফুল্লময়ী জোড়াসাঁকোয় এলে তাঁকে নিজের হাতে সাজাতেন তাঁরা। বীরেন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। বীরেন্দ্রনাথ হয়তো-বা তখন বাড়ির বারান্দায়, প্রফুল্লময়ী কিছুতেই যেতে রাজি হতেন না। তেমনই একটি দিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, তখন লজ্জাই বেশী ছিল। কাজেই আমি কিছুতেই বাহিরে তাঁর সামনে যাইতে রাজী হইলাম না, বাড়ির ভিতরে চলিয়া আসিলাম।’ প্রফুল্লময়ী প্রকাশ্যে আসতে যতই দ্বিধা করুন না কেন, অচিরেই বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিবাহ-আয়োজন হয়েছে। তখন তিনি সবে সাড়ে বারোতে পড়েছেন। বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বয়েসের ব্যবধান অনেকখানি। বিবাহকালে বীরেন্দ্রনাথের বয়েস ছিল একত্রিশ।
প্রফুল্লময়ীরা খুব অবস্থাপন্ন ছিলেন না। সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। ঠাকুরবাড়ির তরফে সব সময়েই নানাভাবে সাহায্য করা হয়েছে। বিয়ের পরের দিন এক বাক্স গয়না নিয়ে হাজির হয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সেসব গয়না পরিয়ে বধূমাতাকে গৃহে আনা হয়েছিল। ঠিক পালকি নয়, পালকির মতো দেখতে, আনা হয়েছিল তাঞ্জামে চাপিয়ে। বাড়িতে পৌঁছোনো মাত্র শাশুড়িমাতা সারদাসুন্দরী পান-সন্দেশ খাইয়ে বধূমাতাকে বরণ করে নিয়েছিলেন। আটদিন পর বাপের বাড়িতে যাওয়ার সময় সারদাসুন্দরী নিজের হাতে নববধূকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি চুনি-মুক্তোর নথ ছিল। প্রচণ্ড ভারী। সেটি পরাতে গিয়ে বিপত্তি ঘটে। পরতে খুব কষ্ট হয়, ব্যথা লাগে। চোখ দিয়ে প্রফুল্লময়ীর জল পড়তে থাকে।
বাবা-মাকে ছেড়ে এক নতুন পরিবারে, নতুন পরিবেশে এসে প্রথম-প্রথম খুব কষ্ট হলেও শ্বশুরবাড়ির সকলের আন্তরিক ব্যবহারে সে-কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন প্রফুল্লময়ী। তাঁর লেখায় আছে সেই আনন্দময় পরিবেশের বর্ণনা। তিনি জানিয়েছেন, ‘বিবাহের পর শ্বশুরবাড়িতে আসিয়া ননদ, জা ও আত্মীয়স্বজনদের নিকট হইতে এত আদর-যত্ন পাই যে তাহাতেই অনেকটা বাপমায়ের শোকটা ভুলিতে পারিয়াছিলাম।’
প্রফুল্লময়ী।
দৈনন্দিন জীবনে ঠাকুরবাড়িতে বড় আনন্দ ছিল। মালিনীরা ফুলের মালা গেঁথে দিত। সেই মালা বাড়ির মেয়েবউরা খোঁপায় জড়াত। বড় ননদ চুল বেঁধে দিতেন, খোঁপায় মালা জড়িয়ে দিতেন। বড়-জা নিত্যনতুন শাড়ি কিনে প্রফুল্লময়ীকে পরতে দিতেন, সাজাতেন। বধূমাতার সংগীতে অনুরাগ ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গান শেখারও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
বিয়ের সাত মাসের মাথায় প্রফুল্লময়ীর পিতৃদেব প্রয়াত হন। গৃহে আনন্দময় পরিবেশ থাকায় পিতৃবিয়োগের দুঃখ মনে জাঁকিয়ে বসেনি। বছর চারেক এইভাবে হাসিতে খুশিতে তাঁর কেটেছিল। তারপরই সব আনন্দ কোথায় হারিয়ে যায়! দুঃখের পর দুঃখ, বেদনার পর বেদনা, এত দুঃখ-বেদনা ঠাকুরবাড়ির কোনও বধূমাতাকে সহ্য করতে হয়নি। দুঃখ জর্জরিত সেই জীবনে তিনি কখনও ভেঙে পড়েননি, প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেছেন। হঠাৎই স্বামীর মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটে। ক্রমেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। চেনা বীরেন্দ্রনাথকে অচেনা মনে হয়। যিনি সংসারের আয়-ব্যয়ের তহবিল সামলাতেন, তিনি পরিবারজীবন সম্পর্কে একেবারেই নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। স্নান করা বন্ধ করে দেন, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেন। সারাক্ষণই সন্দেহ-বাতিক, খিটিরমিটির।
শান্তিনিকেতন গেলে বীরেন্দ্রনাথ ভালো থাকবেন, এই ভেবে তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়েও অপরিবর্তিত। চায়ের চামচের এক চামচ ভাত খান, ভাতের সঙ্গে বড়জোর একটা সেদ্ধ পটল। এইভাবে দিন তিনেক কাটে। পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসা। দিনে দিনে চিন্তা দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। শেষে তাঁকে পাগলাগারদে রাখা হয়, চিকিৎসার জন্য। পাগলাগারদ থেকে ফেরার পরে পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর জন্মকাল থেকেই মা প্রফুল্লময়ীর উৎকণ্ঠা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নবজাতক কাঁদেনি। নিস্তেজ অবস্থায় পড়েছিল। শেষে উপযুক্ত চিকিৎসায় নবজাতক খানিক সুস্থ হয়। মহর্ষি-পত্নী সারদাসুন্দরী নবজাতকের কল্যাণ কামনায়, পরমায়ু বৃদ্ধিকল্পে বাড়ির সমস্ত দাস-দাসীদের তেল ভরা কাঁসার বাটি দান করেছিলেন।
বলেন্দ্রনাথ, সকলের আদরের ‘বলু’ ছেলেবেলা থেকেই অশক্ত-দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বালক বয়স থেকে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। মা প্রফুল্লময়ীর লেখায় আছে, ‘বাপের ওই রকম অবস্থা হওয়াতে তার মনে তখন হইতেই একটা বড় হইবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা হইয়াছিল। যখন আট-নয় বছরের, সেই সময় আমাকে প্রায় বলিত যে, সে লেখাপড়া শিখিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হইবে। লেখাপড়া তাহার নিকট একটা প্রিয় বস্তু ছিল, কোনও দিন তাহাতে অবহেলা করে নাই।’
কৈশোরে মনের কোণে জেগে ওঠে সাহিত্য-স্পৃহা। বলেন্দ্রনাথ মন দিয়েছিলেন প্রবন্ধ রচনায়, কবিতা রচনায়। রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কবিপত্নী মৃণালিনী তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। যথাসময়ে বলেন্দ্রনাথের বিবাহ, সাহানা এল বধূ হিসেবে। প্রফুল্লময়ীর মনে হয়েছে, ‘কন্যা হয় নাই, সে আমার কন্যা।’ প্রফুল্লময়ী লিখেছেন, ‘এত কষ্টভোগের পর মনে বড় আহ্লাদ হইল। ভাবিলাম এইবার ঈশ্বর আমাকে একটু বুঝি সুখের মুখ দেখাইলেন।’
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। বলেন্দ্রনাথের অশক্ত শরীর বাড়াবাড়ি রকমের বিগড়ে যায়। অত্যাচারও করেছেন অনেক। সময়মতো স্নানাহার করতেন না। কখনও দুপুর তিনটে, কখনও-বা পাঁচটায় খেতে বসতেন। ঠাকুর কোম্পানির হিসেবপত্তর নিয়ে প্রায়শই ব্যস্ত থাকতেন। অচিরেই শরীর প্রতিশোধ নিল, আক্রান্ত হলেন যক্ষ্মায়। চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। রকমারি চিকিৎসা, সাহেব ডাক্তারও দেখানো হয়েছিল। দিনে দিনে বলেন্দ্রনাথের অবস্থা আরও খারাপ হয়। অসহ্য যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণা চোখে দেখা যায় না। তাই প্রফুল্লময়ী দেবী বলেন্দ্রনাথের পাশের ঘরে থাকতেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের খোঁজখবর নিতে। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলেন্দ্রনাথের ঘরে গিয়েছিলেন মা প্রফুল্লময়ী। চোখের সামনে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু দেখতে হয় তাঁকে। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। প্রফুল্লময়ী লিখেছেন, ‘রবির কথা শুনিয়া যখন তার কাছে গিয়ে তার পাশে বসিলাম তখন তার সব শেষ হইয়া আসিয়াছে। মনে হইল আমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিল, তাহার পর একবার বমি করিয়া সব শেষ হইয়া গেল। তখন ভোর হইয়াছে। সূর্যদেব ধীরে ধীরে তাহার কিরণচ্ছটায় পৃথিবীকে সজীব করিয়া তুলিতেছিলেন, ঠিক সেই সময় তাহার জীবন দীপ নিভিয়া গেল।’
উনত্রিশ বছর বয়সে একমাত্র পুত্রের মৃত্যু, সে-মৃত্যুদৃশ্য মাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়, এর থেকে নিদারুণ অভিজ্ঞতার আর কী হতে পারে! বীরেন্দ্রনাথ উন্মাদ অবস্থাতেই আরও পনেরো-ষোলো বছর বেঁচেছিলেন। মাঝে মাঝে প্রিয় বলুকে খুঁজতেন। কোথায় বলু, কোথায় বলু!
বুকের ভেতর দুঃখ জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল। সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি প্রফুল্লময়ী। বিষয়-সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো ছেড়ে একসময় ভাড়াবাড়িতেও থাকতে হয়েছে তাঁকে। প্রফুল্লময়ী দেবীর দুঃখ-দুর্গতির শেষ ছিল না। বেদনাময় তাঁর জীবন, বিষাদপ্রতিমা তিনি। এমন দুঃখ-যন্ত্রণা ঠাকুরবাড়ির আর কোন বধূমাতাকে সইতে হয়েছে!
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
বিয়ের সাত মাসের মাথায় প্রফুল্লময়ীর পিতৃদেব প্রয়াত হন। গৃহে আনন্দময় পরিবেশ থাকায় পিতৃবিয়োগের দুঃখ মনে জাঁকিয়ে বসেনি। বছর চারেক এইভাবে হাসিতে খুশিতে তাঁর কেটেছিল। তারপরই সব আনন্দ কোথায় হারিয়ে যায়! দুঃখের পর দুঃখ, বেদনার পর বেদনা, এত দুঃখ-বেদনা ঠাকুরবাড়ির কোনও বধূমাতাকে সহ্য করতে হয়নি। দুঃখ জর্জরিত সেই জীবনে তিনি কখনও ভেঙে পড়েননি, প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেছেন। হঠাৎই স্বামীর মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটে। ক্রমেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। চেনা বীরেন্দ্রনাথকে অচেনা মনে হয়। যিনি সংসারের আয়-ব্যয়ের তহবিল সামলাতেন, তিনি পরিবারজীবন সম্পর্কে একেবারেই নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। স্নান করা বন্ধ করে দেন, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেন। সারাক্ষণই সন্দেহ-বাতিক, খিটিরমিটির।
শান্তিনিকেতন গেলে বীরেন্দ্রনাথ ভালো থাকবেন, এই ভেবে তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়েও অপরিবর্তিত। চায়ের চামচের এক চামচ ভাত খান, ভাতের সঙ্গে বড়জোর একটা সেদ্ধ পটল। এইভাবে দিন তিনেক কাটে। পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসা। দিনে দিনে চিন্তা দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। শেষে তাঁকে পাগলাগারদে রাখা হয়, চিকিৎসার জন্য। পাগলাগারদ থেকে ফেরার পরে পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর জন্মকাল থেকেই মা প্রফুল্লময়ীর উৎকণ্ঠা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নবজাতক কাঁদেনি। নিস্তেজ অবস্থায় পড়েছিল। শেষে উপযুক্ত চিকিৎসায় নবজাতক খানিক সুস্থ হয়। মহর্ষি-পত্নী সারদাসুন্দরী নবজাতকের কল্যাণ কামনায়, পরমায়ু বৃদ্ধিকল্পে বাড়ির সমস্ত দাস-দাসীদের তেল ভরা কাঁসার বাটি দান করেছিলেন।
বলেন্দ্রনাথ, সকলের আদরের ‘বলু’ ছেলেবেলা থেকেই অশক্ত-দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বালক বয়স থেকে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। মা প্রফুল্লময়ীর লেখায় আছে, ‘বাপের ওই রকম অবস্থা হওয়াতে তার মনে তখন হইতেই একটা বড় হইবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা হইয়াছিল। যখন আট-নয় বছরের, সেই সময় আমাকে প্রায় বলিত যে, সে লেখাপড়া শিখিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হইবে। লেখাপড়া তাহার নিকট একটা প্রিয় বস্তু ছিল, কোনও দিন তাহাতে অবহেলা করে নাই।’
কৈশোরে মনের কোণে জেগে ওঠে সাহিত্য-স্পৃহা। বলেন্দ্রনাথ মন দিয়েছিলেন প্রবন্ধ রচনায়, কবিতা রচনায়। রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কবিপত্নী মৃণালিনী তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। যথাসময়ে বলেন্দ্রনাথের বিবাহ, সাহানা এল বধূ হিসেবে। প্রফুল্লময়ীর মনে হয়েছে, ‘কন্যা হয় নাই, সে আমার কন্যা।’ প্রফুল্লময়ী লিখেছেন, ‘এত কষ্টভোগের পর মনে বড় আহ্লাদ হইল। ভাবিলাম এইবার ঈশ্বর আমাকে একটু বুঝি সুখের মুখ দেখাইলেন।’
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। বলেন্দ্রনাথের অশক্ত শরীর বাড়াবাড়ি রকমের বিগড়ে যায়। অত্যাচারও করেছেন অনেক। সময়মতো স্নানাহার করতেন না। কখনও দুপুর তিনটে, কখনও-বা পাঁচটায় খেতে বসতেন। ঠাকুর কোম্পানির হিসেবপত্তর নিয়ে প্রায়শই ব্যস্ত থাকতেন। অচিরেই শরীর প্রতিশোধ নিল, আক্রান্ত হলেন যক্ষ্মায়। চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। রকমারি চিকিৎসা, সাহেব ডাক্তারও দেখানো হয়েছিল। দিনে দিনে বলেন্দ্রনাথের অবস্থা আরও খারাপ হয়। অসহ্য যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণা চোখে দেখা যায় না। তাই প্রফুল্লময়ী দেবী বলেন্দ্রনাথের পাশের ঘরে থাকতেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের খোঁজখবর নিতে। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলেন্দ্রনাথের ঘরে গিয়েছিলেন মা প্রফুল্লময়ী। চোখের সামনে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু দেখতে হয় তাঁকে। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। প্রফুল্লময়ী লিখেছেন, ‘রবির কথা শুনিয়া যখন তার কাছে গিয়ে তার পাশে বসিলাম তখন তার সব শেষ হইয়া আসিয়াছে। মনে হইল আমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিল, তাহার পর একবার বমি করিয়া সব শেষ হইয়া গেল। তখন ভোর হইয়াছে। সূর্যদেব ধীরে ধীরে তাহার কিরণচ্ছটায় পৃথিবীকে সজীব করিয়া তুলিতেছিলেন, ঠিক সেই সময় তাহার জীবন দীপ নিভিয়া গেল।’
উনত্রিশ বছর বয়সে একমাত্র পুত্রের মৃত্যু, সে-মৃত্যুদৃশ্য মাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়, এর থেকে নিদারুণ অভিজ্ঞতার আর কী হতে পারে! বীরেন্দ্রনাথ উন্মাদ অবস্থাতেই আরও পনেরো-ষোলো বছর বেঁচেছিলেন। মাঝে মাঝে প্রিয় বলুকে খুঁজতেন। কোথায় বলু, কোথায় বলু!
বুকের ভেতর দুঃখ জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল। সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি প্রফুল্লময়ী। বিষয়-সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো ছেড়ে একসময় ভাড়াবাড়িতেও থাকতে হয়েছে তাঁকে। প্রফুল্লময়ী দেবীর দুঃখ-দুর্গতির শেষ ছিল না। বেদনাময় তাঁর জীবন, বিষাদপ্রতিমা তিনি। এমন দুঃখ-যন্ত্রণা ঠাকুরবাড়ির আর কোন বধূমাতাকে সইতে হয়েছে!
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।