ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
রবীন্দ্রনাথের ব্যস্ততার শেষ ছিল না। লেখার ব্যস্ততা, পরিবার জীবন নিয়ে ব্যস্ততা, আশ্রম-বিদ্যালয় নিয়ে ব্যস্ততা, সমাজ-সম্পৃক্ত ব্যস্ততা। কত ধরনের, কত রকমের ব্যস্ততা। জোড়াসাঁকোয় বা শান্তিনিকেতনে, যেখানেই থাকুন, এমনকী ভ্রমণপথেও উটকো লোকের উৎপাত, নিরন্তর বকবকানি কম সইতে হয়নি তাঁকে! এসব নিয়ে কখনও বিরক্তি প্রকাশ করেননি, ‘যত্তসব’ বলে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এড়িয়ে চলেননি রবীন্দ্রনাথ। সুখ-বৈভবে দিনযাপন তাঁর ধাতে সয়নি। কার নামকরণ করতে হবে, কার বিয়ের পদ্য লিখে দিতে হবে, এসব আপাতভাবে ‘ফালতু পণ্ডশ্রম’ মনে হলেও রবীন্দ্রনাথের তেমন মনে হয়নি। অকাতরে চেনা-অচেনা নির্বিবাদে সবার চাহিদা মিটিয়েছেন। মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। সাধারণ মানুষজনকে এড়িয়ে নিজেকে নিয়ে, নিজের লেখা নিয়ে শুধুই ব্যস্ত থাকেননি। তাঁর অবস্থান ছিল মানুষের মাঝে, পা ছিল মাটির পৃথিবীতে। স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, তাই তো রবীন্দ্রনাথের তুলনা রবীন্দ্রনাথ নিজে।
রবীন্দ্রনাথ যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, প্রাপ্ত সব চিঠি পড়তেন। উত্তর দিতেন। উপহার পাওয়া বইপত্র পড়ার মতো হলে পড়ে, অথবা নেড়েচেড়ে প্রায়শই সংশ্লিষ্ট লেখককে দু’লাইন লিখে উৎসাহিত করতেন। রবীন্দ্রনাথ দেশ-বিদেশের খ্যাত-অখ্যাত কতজনের যে চিঠি পেয়েছেন, তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। ছোটরাও তাঁকে চিঠি লিখত, সেসব চিঠিরও তিনি উত্তর দিতেন। পরিবারের ছোটরা, পুপে, বুড়ি, নীতু বা শমীরা শুধু নয়, বরিশালের ইন্দুভূষণ বা ক্যানিংয়ের অমল—এমন কত বালক-কিশোর প্রায় দুঃসাহসী হয়ে বিশ্ববন্দিত কবিকে চিঠি লিখেছে, চিঠির উত্তরও দিয়েছেন কবি। রবীন্দ্রনাথের চিঠি পড়ে ছোটরা প্রাণিত হয়েছে। চলার পথটি চিনে নিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে অন্তত সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি চিঠি লিখেছেন, চিঠির উত্তর দিয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক চিঠির সন্ধান এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সহজেই অনুমেয়, এর বাইরেও অনেক অনেক চিঠি ব্যক্তিগত সংগ্রহে এখনও রয়ে গেছে। চিঠির প্রাপক-সংখ্যাও খুব কম নয়। প্রায় সাতশো। বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগ থেকে থেকে তাঁর চিঠিপত্রের সংগ্রহ উনিশ-কুড়ি খণ্ডে বেরিয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বহু চিঠিই আজও বিশ্বভারতীর এই সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অনাবিষ্কৃত-অপ্রকাশিত রবীন্দ্রপত্র অনেকের কাছে রয়ে গেছে। দু-একটি পত্রিকার শারদীয় সংখ্যার এখনও প্রধান আকর্ষণ ‘অপ্রকাশিত রবীন্দ্রপত্র’।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঘোরতর সংসারী। যেমন স্নেহময় পিতা, তেমনই দায়িত্ববান স্বামী। তাঁর লেখা অনেক অনেক পারিবারিক পত্র, কেজো চিঠিও কম নয়। এইসব পত্রমালার পাশাপাশি সাহিত্য-গুণান্বিত চিঠিও তো যথেষ্ট। স্বাদু ও রম্য পত্রের সংখ্যাই অধিক। সূচনা-অংশ ও শেষাংশ বাদ দিলে সেগুলি বিশুদ্ধ সাহিত্যই হয়ে ওঠে। আমাদের আপ্লুত ও আচ্ছন্ন করে।
সব না হলেও রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ চিঠিই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, মূলত কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের নিরলস চেষ্টায়। আমাদের দেশে অনেক বরণীয় লেখকেরই পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র যথাযথভাবে সংগৃহীত-সংরক্ষিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ব্যতিক্রম। তাঁর পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র অনেকখানিই পাওয়া গেছে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথই ছড়িয়ে থাকা চিঠিপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। কবির চিঠিপত্র কপি করিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি।
রোজ সকালে পোস্টাফিস থেকে বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র আসত রবীন্দ্রনাথের। চিঠিপত্রের সঙ্গে দৈনিক সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রপত্রিকাও কম থাকত না! রানি চন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। সেবায় শুশ্রূষায় কবির বেলা শেষের দিনগুলি প্রতিমা দেবীর সঙ্গে তিনিও ভরিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভারী সুন্দর একটি বই লিখেছিলেন তিনি। যে বইয়ের মধ্য দিয়ে ‘মানুষ রবীন্দ্রনাথ’কে সহজেই চেনা যায়। বইটির নাম ‘গুরুদেব’। রানি চন্দের লেখায় ওইসব চিঠিপত্রের চমৎকার বিবরণ আছে। অংশবিশেষ তাঁর লেখা থেকে তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘চিঠিগুলি প্রায় নিজের হাতে ছিঁড়তেন তিনি। নানা ধরণের পাগলের চিঠি থাকতো বেশি। সে সব চিঠি জমিয়ে রাখলে আজ সবাই বুঝতে পারতো যে, গুরুদেব নিত্য কত পাগলামী নিয়ে কারবার করতেন।’
রানি চন্দ প্রত্যক্ষ সাক্ষী, নিজের চোখে এইসব চিঠি দেখেছেন। নিদারুণ অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাঁর। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট’ উপাধি পেয়েছিলেন। তখনকার দিনে ‘ডক্টরেট’দের নামের আগে এখনকার মতো ‘ড.’ না লিখে ‘ডাঃ’ লেখা হত। রবীন্দ্রনাথ নিজে না লিখলেও অনেক সময় পত্রপত্রিকায় তাঁর নামের আগে ‘ডাঃ’ লেখা হয়েছে। ডাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন চিঠিও নিয়মিত পেতেন, যে সব চিঠিতে রোগীরা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ জানতে চাইতেন! কেউ হয়তো গাঁটের কড়ি খরচ করে বই ছেপেছেন। নিজের লেখা সম্পর্কে তাঁর উচ্চ ধারণা। মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যদি নোবেল-কমিটির কাছে একটু অনুরোধ জানান, তাহলে তাঁর নামে বিলেত থেকে নোবেল-খেতাব নিশ্চিত চলে আসবে। রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ জানাতেন, নিজের মনোবাসনার কথা জানিয়ে এইটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আকুতি-ভরা অনুরোধ করতেন!
রানি চন্দের লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ এমন চিঠি পেয়েছেন, যে চিঠিতে থাকত পত্রলেখকের আইবুড়ো মেয়ের জন্য সুপাত্র খুঁজে দেওয়ার অনুরোধ। এ তো গেল কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আর্জি, পাশাপাশি এমন চিঠিও আসত, যে চিঠিতে থাকত প্রথমা স্ত্রীকে আর সহ্য করতে পারছেন না, অসহ্য ঠেকছে। কবি যদি অনুগ্রহ করে একটি পাত্রী খুঁজে দেন, তাহলে তিনি আরেকবার ছাতনাতলায় যাবেন, নতুন করে জীবন শুরু করবেন। বিয়েতে আশীর্বাদি-কবিতা চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে অসংখ্য চিঠি আসত। এমনতরো চিঠির সঙ্গে কখনও কখনও থাকত ভীতি-প্রদর্শনও। রানি চন্দ জানিয়েছেন, কবি এমন চিঠি পেয়েছেন, যে চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমাদের বিয়েতে কবিতা চাই-ই। ক্ষুদ্র বলে অবহেলা করলে অভিশাপ দেবো।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে অর্থ-সাহায্য চেয়েও চিঠি এসেছে। বিপদে-আপদে পড়ে ধার চায়নি, পদ্য লিখে প্রতিষ্ঠার অর্জন করবে, তাই কবির কাছে টাকা চেয়েছে। রানি চন্দ উল্লিখিত এই চিঠিটির প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘কেউ চেয়েছেন দেড়লক্ষ টাকা পত্রপাঠ তাঁকে পাঠিয়ে দিয়ে কবি কর্তব্য পালন করেন। এই টাকা পেলে তবেই ভদ্রলোক সংসারের ভার হতে মুক্ত হয়ে সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকতে পারবেন বাকি জীবনটায়। নয়তো তাঁর প্রতিভার অপমৃত্যুতে যে মহা ক্ষতি সাধিত হবে, সেজন্য রবীন্দ্রনাথকেই জবাবদিহি করতে হবে সারা পৃথিবীর কাছে।’ এসব জেনে আমাদের মনে হয়তো পত্রলেখকের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। খ্যাতির বিড়ম্বনা! এভাবেই কিছু মানুষ ক্রমাগত বিরক্ত করত রবীন্দ্রনাথকে। মহাকবির মহামূল্যবান সময় নষ্ট হত।
বিড়ম্বনার শেষ ছিল না কবির। নিজের লেখা গদ্য ও পদ্য সংশোধন করে দেওয়ার বায়নাক্কা নিয়েও চিঠি আসত। প্রশংসাপত্র লিখে পাঠানোর আর্জিও কম আসত না।
বিচিত্র পত্রসম্ভার। এ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যত চিঠি আসত, সবই খুলে খুলে দেখতেন কবি। অনেক চিঠির রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিতেন না। কিছু চিঠির অবশ্য উত্তর তাঁকে প্রতিদিনই লিখতে হত। বেশিরভাগ চিঠিই রবীন্দ্রনাথ খুলে শুরুটা দেখতেন, শেষটা দেখতেন, তাতেই তাঁর মর্মার্থ জানা হয়ে যেত। বেছে বেছে কিছু চিঠি রাখতেন টেবিলের উপরে। সেসব চিঠির উত্তর দিতেন। কিছু ফেলে দিতেন ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে। উপভোগ্য মজাদার চিঠিগুলি। একান্ত সচিবের হাতে দিয়ে বলতেন, ‘নাও, সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে দিলুম তোমাকে।’
চিঠির উত্তর লেখা নিয়ে অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটেছে। মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনা গেছে। রানি চন্দের লেখা থেকে জানা যায়, একটি চিঠি হাতে পেয়ে একদিন খুবই উত্তেজিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখনই চিঠির উত্তর দিতে বসে গিয়েছিলেন। উত্তেজনায় তাঁর হাত কাঁপছিল। এমনভাবে তাঁকে চিঠি লিখতে আগে প্রিয়জনেরা দেখেননি। দ্রুত-হাতে চিঠি লিখেই একান্ত-সচিবকে ডাকে ফেলতে দিলেন। তিনি অবশ্য তখনই ডাকে দিয়ে আসেননি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। উত্তেজনা কমতেই গুরুদেবের তলব। ডাকলেন তাঁকে। বললেন, ‘চিঠিটা ডাকে দিয়েছিস? দিস্ নি? ভালোই করেছিস। ফেলে দে ছিঁড়ে?’
উত্তেজনা থামতেই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, রাগের বশে দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছেন তিনি। কবির কাছ থেকে এমন আক্রমণাত্মক কথা শুনে মানুষটি কষ্ট পেতে পারে। এই ভেবে রবীন্দ্রনাথ চিঠিটা ডাকে দিতে বারণ করেছিলেন।
এমন কত চিঠি প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথের কাছে আসত। সব না হলেও কিছু কিছু চিঠির উত্তর যেত। বিশিষ্টজনের চিঠির তো উত্তর দিতেই হত। পারিবারিক চিঠিরও উত্তর লিখতেন। ভালোবাসার মানুষজনের চিঠি পেলে বোধহয় সব থেকে বেশি ভালো লাগত। উত্তরও লিখে ফেলতেন। চিঠি লেখাতেও কত আনন্দ, তা আজকের মানুষ, এই আমরা বুঝব না।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।
রবীন্দ্রনাথ যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, প্রাপ্ত সব চিঠি পড়তেন। উত্তর দিতেন। উপহার পাওয়া বইপত্র পড়ার মতো হলে পড়ে, অথবা নেড়েচেড়ে প্রায়শই সংশ্লিষ্ট লেখককে দু’লাইন লিখে উৎসাহিত করতেন। রবীন্দ্রনাথ দেশ-বিদেশের খ্যাত-অখ্যাত কতজনের যে চিঠি পেয়েছেন, তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। ছোটরাও তাঁকে চিঠি লিখত, সেসব চিঠিরও তিনি উত্তর দিতেন। পরিবারের ছোটরা, পুপে, বুড়ি, নীতু বা শমীরা শুধু নয়, বরিশালের ইন্দুভূষণ বা ক্যানিংয়ের অমল—এমন কত বালক-কিশোর প্রায় দুঃসাহসী হয়ে বিশ্ববন্দিত কবিকে চিঠি লিখেছে, চিঠির উত্তরও দিয়েছেন কবি। রবীন্দ্রনাথের চিঠি পড়ে ছোটরা প্রাণিত হয়েছে। চলার পথটি চিনে নিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে অন্তত সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি চিঠি লিখেছেন, চিঠির উত্তর দিয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক চিঠির সন্ধান এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সহজেই অনুমেয়, এর বাইরেও অনেক অনেক চিঠি ব্যক্তিগত সংগ্রহে এখনও রয়ে গেছে। চিঠির প্রাপক-সংখ্যাও খুব কম নয়। প্রায় সাতশো। বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগ থেকে থেকে তাঁর চিঠিপত্রের সংগ্রহ উনিশ-কুড়ি খণ্ডে বেরিয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বহু চিঠিই আজও বিশ্বভারতীর এই সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অনাবিষ্কৃত-অপ্রকাশিত রবীন্দ্রপত্র অনেকের কাছে রয়ে গেছে। দু-একটি পত্রিকার শারদীয় সংখ্যার এখনও প্রধান আকর্ষণ ‘অপ্রকাশিত রবীন্দ্রপত্র’।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঘোরতর সংসারী। যেমন স্নেহময় পিতা, তেমনই দায়িত্ববান স্বামী। তাঁর লেখা অনেক অনেক পারিবারিক পত্র, কেজো চিঠিও কম নয়। এইসব পত্রমালার পাশাপাশি সাহিত্য-গুণান্বিত চিঠিও তো যথেষ্ট। স্বাদু ও রম্য পত্রের সংখ্যাই অধিক। সূচনা-অংশ ও শেষাংশ বাদ দিলে সেগুলি বিশুদ্ধ সাহিত্যই হয়ে ওঠে। আমাদের আপ্লুত ও আচ্ছন্ন করে।
সব না হলেও রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ চিঠিই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, মূলত কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের নিরলস চেষ্টায়। আমাদের দেশে অনেক বরণীয় লেখকেরই পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র যথাযথভাবে সংগৃহীত-সংরক্ষিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ব্যতিক্রম। তাঁর পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র অনেকখানিই পাওয়া গেছে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথই ছড়িয়ে থাকা চিঠিপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। কবির চিঠিপত্র কপি করিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি।
রোজ সকালে পোস্টাফিস থেকে বিপুল পরিমাণ চিঠিপত্র আসত রবীন্দ্রনাথের। চিঠিপত্রের সঙ্গে দৈনিক সংবাদপত্র, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রপত্রিকাও কম থাকত না! রানি চন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। সেবায় শুশ্রূষায় কবির বেলা শেষের দিনগুলি প্রতিমা দেবীর সঙ্গে তিনিও ভরিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভারী সুন্দর একটি বই লিখেছিলেন তিনি। যে বইয়ের মধ্য দিয়ে ‘মানুষ রবীন্দ্রনাথ’কে সহজেই চেনা যায়। বইটির নাম ‘গুরুদেব’। রানি চন্দের লেখায় ওইসব চিঠিপত্রের চমৎকার বিবরণ আছে। অংশবিশেষ তাঁর লেখা থেকে তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘চিঠিগুলি প্রায় নিজের হাতে ছিঁড়তেন তিনি। নানা ধরণের পাগলের চিঠি থাকতো বেশি। সে সব চিঠি জমিয়ে রাখলে আজ সবাই বুঝতে পারতো যে, গুরুদেব নিত্য কত পাগলামী নিয়ে কারবার করতেন।’
রানি চন্দ প্রত্যক্ষ সাক্ষী, নিজের চোখে এইসব চিঠি দেখেছেন। নিদারুণ অভিজ্ঞতাও হয়েছে তাঁর। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট’ উপাধি পেয়েছিলেন। তখনকার দিনে ‘ডক্টরেট’দের নামের আগে এখনকার মতো ‘ড.’ না লিখে ‘ডাঃ’ লেখা হত। রবীন্দ্রনাথ নিজে না লিখলেও অনেক সময় পত্রপত্রিকায় তাঁর নামের আগে ‘ডাঃ’ লেখা হয়েছে। ডাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন চিঠিও নিয়মিত পেতেন, যে সব চিঠিতে রোগীরা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ জানতে চাইতেন! কেউ হয়তো গাঁটের কড়ি খরচ করে বই ছেপেছেন। নিজের লেখা সম্পর্কে তাঁর উচ্চ ধারণা। মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যদি নোবেল-কমিটির কাছে একটু অনুরোধ জানান, তাহলে তাঁর নামে বিলেত থেকে নোবেল-খেতাব নিশ্চিত চলে আসবে। রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ জানাতেন, নিজের মনোবাসনার কথা জানিয়ে এইটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আকুতি-ভরা অনুরোধ করতেন!
রানি চন্দের লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ এমন চিঠি পেয়েছেন, যে চিঠিতে থাকত পত্রলেখকের আইবুড়ো মেয়ের জন্য সুপাত্র খুঁজে দেওয়ার অনুরোধ। এ তো গেল কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার আর্জি, পাশাপাশি এমন চিঠিও আসত, যে চিঠিতে থাকত প্রথমা স্ত্রীকে আর সহ্য করতে পারছেন না, অসহ্য ঠেকছে। কবি যদি অনুগ্রহ করে একটি পাত্রী খুঁজে দেন, তাহলে তিনি আরেকবার ছাতনাতলায় যাবেন, নতুন করে জীবন শুরু করবেন। বিয়েতে আশীর্বাদি-কবিতা চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে অসংখ্য চিঠি আসত। এমনতরো চিঠির সঙ্গে কখনও কখনও থাকত ভীতি-প্রদর্শনও। রানি চন্দ জানিয়েছেন, কবি এমন চিঠি পেয়েছেন, যে চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমাদের বিয়েতে কবিতা চাই-ই। ক্ষুদ্র বলে অবহেলা করলে অভিশাপ দেবো।’
রবীন্দ্রনাথের কাছে অর্থ-সাহায্য চেয়েও চিঠি এসেছে। বিপদে-আপদে পড়ে ধার চায়নি, পদ্য লিখে প্রতিষ্ঠার অর্জন করবে, তাই কবির কাছে টাকা চেয়েছে। রানি চন্দ উল্লিখিত এই চিঠিটির প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘কেউ চেয়েছেন দেড়লক্ষ টাকা পত্রপাঠ তাঁকে পাঠিয়ে দিয়ে কবি কর্তব্য পালন করেন। এই টাকা পেলে তবেই ভদ্রলোক সংসারের ভার হতে মুক্ত হয়ে সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকতে পারবেন বাকি জীবনটায়। নয়তো তাঁর প্রতিভার অপমৃত্যুতে যে মহা ক্ষতি সাধিত হবে, সেজন্য রবীন্দ্রনাথকেই জবাবদিহি করতে হবে সারা পৃথিবীর কাছে।’ এসব জেনে আমাদের মনে হয়তো পত্রলেখকের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। খ্যাতির বিড়ম্বনা! এভাবেই কিছু মানুষ ক্রমাগত বিরক্ত করত রবীন্দ্রনাথকে। মহাকবির মহামূল্যবান সময় নষ্ট হত।
বিড়ম্বনার শেষ ছিল না কবির। নিজের লেখা গদ্য ও পদ্য সংশোধন করে দেওয়ার বায়নাক্কা নিয়েও চিঠি আসত। প্রশংসাপত্র লিখে পাঠানোর আর্জিও কম আসত না।
বিচিত্র পত্রসম্ভার। এ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যত চিঠি আসত, সবই খুলে খুলে দেখতেন কবি। অনেক চিঠির রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিতেন না। কিছু চিঠির অবশ্য উত্তর তাঁকে প্রতিদিনই লিখতে হত। বেশিরভাগ চিঠিই রবীন্দ্রনাথ খুলে শুরুটা দেখতেন, শেষটা দেখতেন, তাতেই তাঁর মর্মার্থ জানা হয়ে যেত। বেছে বেছে কিছু চিঠি রাখতেন টেবিলের উপরে। সেসব চিঠির উত্তর দিতেন। কিছু ফেলে দিতেন ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে। উপভোগ্য মজাদার চিঠিগুলি। একান্ত সচিবের হাতে দিয়ে বলতেন, ‘নাও, সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে দিলুম তোমাকে।’
চিঠির উত্তর লেখা নিয়ে অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটেছে। মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনা গেছে। রানি চন্দের লেখা থেকে জানা যায়, একটি চিঠি হাতে পেয়ে একদিন খুবই উত্তেজিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখনই চিঠির উত্তর দিতে বসে গিয়েছিলেন। উত্তেজনায় তাঁর হাত কাঁপছিল। এমনভাবে তাঁকে চিঠি লিখতে আগে প্রিয়জনেরা দেখেননি। দ্রুত-হাতে চিঠি লিখেই একান্ত-সচিবকে ডাকে ফেলতে দিলেন। তিনি অবশ্য তখনই ডাকে দিয়ে আসেননি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। উত্তেজনা কমতেই গুরুদেবের তলব। ডাকলেন তাঁকে। বললেন, ‘চিঠিটা ডাকে দিয়েছিস? দিস্ নি? ভালোই করেছিস। ফেলে দে ছিঁড়ে?’
উত্তেজনা থামতেই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, রাগের বশে দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছেন তিনি। কবির কাছ থেকে এমন আক্রমণাত্মক কথা শুনে মানুষটি কষ্ট পেতে পারে। এই ভেবে রবীন্দ্রনাথ চিঠিটা ডাকে দিতে বারণ করেছিলেন।
এমন কত চিঠি প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথের কাছে আসত। সব না হলেও কিছু কিছু চিঠির উত্তর যেত। বিশিষ্টজনের চিঠির তো উত্তর দিতেই হত। পারিবারিক চিঠিরও উত্তর লিখতেন। ভালোবাসার মানুষজনের চিঠি পেলে বোধহয় সব থেকে বেশি ভালো লাগত। উত্তরও লিখে ফেলতেন। চিঠি লেখাতেও কত আনন্দ, তা আজকের মানুষ, এই আমরা বুঝব না।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।