শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ শেষের দিকের সন্তান। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাসুন্দরী চতুর্দশ সন্তান তিনি। অষ্টম পুত্র। রবীন্দ্রনাথের আগের জন সোমেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের থেকে বছর দেড়েকের একটু বেশি বড়ো ছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাল্য-কৈশোর সঙ্গী। রবি কবিতা লিখুক, চেয়েছিলেন সোমেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বই ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। পরে সোমেন্দ্রনাথের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে। সে অন্য প্রসঙ্গ।

রবীন্দ্রনাথের পরের জন বুধেন্দ্রনাথ। স্বল্পায়ু, মারা গিয়েছিলেন নিতান্তই শৈশবে। বুধেন্দ্রনাথই শেষ সন্তান। আর কোনও সন্তান সারদাসুন্দরীর কোল আলো করে আসেনি। শেষের দিকে হলেও রবীন্দ্রনাথ মায়ের রোগাভোগা ছেলে ছিলেন না। একেবারেই রুগ্ন নন, ছিলেন যথেষ্ট বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী।

অভাব ছিল না ঠিকই কিন্তু মহর্ষিদেব কখনও বিলাস-বৈভবে প্রশ্রয় দেননি। আড়ম্বরহীন বাল্যকৈশোর। সেই বেড়ে ওঠার দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেবেলা’ বইতে লিখেছেন, ‘শরীরে কোনোরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না।’ হয়তো তিনি জুতো জলে ভিজিয়ে ঘুরে বেড়ালেন, ভাবলেন সর্দি হবে, জ্বর আসবে, না, কিছুই হল না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে হিমেল হাওয়ায় শুয়ে রইলেন। গলায় একটু খুসখুসনি কাশিও দেখা গেল না। বদহজমের কথা শুনিয়ে কখনও সখনও অবশ্য মায়ের সহানুভূতি পাওয়া গিয়েছে। সারদাসুন্দরী গৃহভৃত্যকে ডেকে হয়তো-বা বলে দিয়েছেন, ‘আচ্ছা যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়তে হবে না।’
অসুস্থ হওয়ার যতই সাধ জাগুক না কেন, রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলাতে কখনও তেমনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েননি। পরে পরিণত বয়সে তিনি যে খুব ভুগেছেন, শরীর খারাপ হয়েছে, তা নয়। কঠোর পরিশ্রম করতেন তিনি। লেখার চাপ, পরিবারজীবনের সমস্ত দায়িত্ব পালন, শান্তিনিকেতন গড়ে তোলা, আশ্রম বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ-সংগ্রহের চেষ্টা — কাজের তাঁর শেষ ছিল না। সাহিত্যের ডাকে দেশ-বিদেশে যেতে হয়েছে। যেতে হয়েছে আশ্রম-বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ-সংগ্রহের তাগিদে। স্বদেশে হলে ট্রেনে, জলপথে বজরায় যাতায়াত, বিদেশে হলে জাহাজে। উড়োজাহাজেও গিয়েছেন বটে, সে অবশ্য পরের দিকে।

দৈনন্দিন জীবনে রবীন্দ্রনাথকে সত্যিই প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হত, ভাবলে অবাক হতে হয়! এত পরিশ্রমের পরও, সুখের কথা, তিনি সেভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েননি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, কাজের আনন্দে, প্রিয়-সান্নিধ্যে দিন কাটিয়েছেন। ছেলেবেলার সেই অসুস্থতাহীন দিনগুলির কেমন ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেবেলা’ বইতেই তো জানিয়েছেন, ‘জ্বরে ভোগা কাকে বলে মনে পড়ে না। ম্যালেরিয়া বলে শব্দটা শোনাই ছিল না।… মনে পড়ে না কুইনীন। গায়ে ফোঁড়া-কাটা ছুরির আঁচড় পড়েনি কোনোদিন। হাম বা জল-বসন্ত কাকে বলে আজ পর্যন্ত জানি নে। শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

রিভিউ: মধ্যমানের ভিএফএক্স আর সবাইকে সন্তুষ্ট করতে যাওয়াই কাল হল আদিপুরুষের

ঠাকুরবাড়িতে একাধিকজনের অর্শ ছিল। বলা যায়, পারিবারিক রোগ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অর্শ ছিল। সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর কারণ তো এই অর্শরোগ। রবীন্দ্রনাথও এ রোগে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছেন। লন্ডনে চিকিৎসাও করিয়েছেন। জীবনের বেলা-শেষে কবি ইরিসিপেলাসের কবলে পড়েছিলেন। হয়তো কথা বলছেন, কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। সে সময় কবি একটু ভেঙে পড়েছিলেন, তা তাঁর একাধিক উক্তি থেকে বোঝা যায়। মীরাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, তাঁর বুঝি ‘ছুটি পাবার সময় এসেছে।’

রবীন্দ্রনাথের বরাবরই অপারেশনে ভয়। অর্শের কষ্ট থেকে বাঁচতে, খানিক নিরুপায় হয়েই লন্ডনে তাঁকে অপারেশন করাতে হয়েছিল। রোটেনস্টাইন অপারেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামি শল্য-চিকিৎসকের অধীনে নির্ভরযোগ্য হাসপাতালে অপারেশন হয়েছিল। হপ্তাদুয়েক থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে। তবে সরাসরি অপারেশনের পথে হাঁটেননি রবীন্দ্রনাথ। অপারেশনে তাঁর অনিচ্ছা বলেই প্রথম হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আমেরিকার হোমিওপ্যাথিক-চিকিৎসক দানা-ওষুধ খাইয়ে রবীন্দ্রনাথকে অর্শমুক্ত করতে পারেননি।
কবি তখন কালিম্পঙে। মুত্রাশয়ের গুরুতর পীড়া। ইউরিন বন্ধ। দার্জিলিং থেকে আসা সাহেব ডাক্তার বলেছিলেন, ‘আজ রাতে অপারেশন না হলে ওঁর জীবন-সংশয় হতে পারে।’ প্রতিমা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, ‘ডাক্তারের মতে ওঁর য়ুরিমিয়া হয়েছে তাই ভিতরে ভিতরে বিষক্রিয়া হওয়ার দরুন উনি অচেতন হয়ে আছেন।’

ডাক্তার বললেও তখনই অপারেশন করাতে প্রতিমা দেবী রাজি হননি। রাজি হবেন কী করে? বাবামশায় যে ঘোরতর অপারেশনবিরোধী, তা তাঁর অজানা ছিল না। তাছাড়া রথীন্দ্রনাথ তখন জমিদারির কাজে পতিসরে। তাঁর অনুপস্থিতিতে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে প্রতিমা দেবী রাজি হননি। স্পষ্ট করেই সাহেব-ডাক্তারকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আজ রাত্রে অপারেশন হতে পারে না। প্রথমত, আমার স্বামী এখানে উপস্থিত নেই; দ্বিতীয়ত, কলকাতায় যে ডাক্তাররা কবিকে দেখে থাকেন, তাঁরা কাল সকালে এখানে এসে পৌঁছোবেন, তাঁদের জন্য অপেক্ষা না করে আজ রাত্রে অপারেশনে মত দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ এমন কথা শুনে ডাক্তার ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। প্রতিমা দেবীকে ‘ভয়াবহ’ এক কথা বলেছিলেন, ‘আপনি বারো ঘন্টার জন্য বিপদ-সম্ভবনা কাঁধে নিচ্ছেন, জানেন না, কাল কী ঘটতে পারে।’
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৪: এ শুধু অলস মায়া?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১০: রাজার আশপাশে থাকা দুষ্ট লোকেদের অতিক্রম করে তাঁর কাছ পর্যন্ত পৌঁছনোর পথ খুবই দুর্গম

চলো যাই ঘুরে আসি: পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

শেষ পর্যন্ত সে যাত্রায়, তখুনই অপারেশন করাতে হয়নি। চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছিলেন কবি। একটু সুস্থ বোধ করেছেন। পাহাড় থেকে সমতলে, কলকাতায় নিয়ে আসা হয় তাঁকে। কলকাতায় আনার পর রবীন্দ্রনাথ যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন, তা নয়। প্রতিমা দেবী ‘নির্বাণ’ বইতে লিখেছেন, ‘রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, কী কষ্ট পেয়েছেন, চোখে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই জানেন।’ এরপরও রবীন্দ্রনাথ অপারেশন করাতে রাজি হননি। ডাক্তাররা বুঝিয়েছিলেন, সামান্য ব্যাপার, ফোঁড়া কাটার মতো। না, কবিকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। ‘কাটাকুটি ছেঁড়াছিঁড়ি’তে তাঁর ঘোরতর আপত্তি। কবিরাজি চিকিৎসার কথা ভেবেছেন, বলেছেন। শেষে অবস্থা ক্রমেই জটিল হয়েছে। অপারেশন ছাড়া আর কোনও বিকল্প রাস্তা যে নেই, তা পরিবারের সকলেই বুঝেছেন। রবীন্দ্রনাথও অগত্যা রাজি হয়েছেন। প্রোস্ট্রেটে ইউরিনারি ইনফেকশনের জন্য অপারেশন হয়েছে। অপারেশন থিয়েটার ছাড়া বাড়িতেই অপারেশন। শেষে ক্ষতস্থানে সেপটিক। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল। অপারেশন বিরোধী কবির অপারেশনোত্তর জটিল পরিস্থিতিতে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
অপারেশনে কবির কতখানি ভয় ছিল, তা নির্মলকুমারী মহলানবিশের লেখায়, প্রতিমা দেবীর লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইঞ্জেকশনেও কি তাঁর কম ভয় ছিল? ইনজেকশন নিতে, টিকা নিতে ভয়ের শেষ ছিল না। একবার বোলপুরে, আশপাশের গ্রামে খুব বসন্ত হয়। ডাক্তার শচীন মুখোপাধ্যায় আশ্রমে ঘুরে ঘুরে জনে জনে সবাইকে বসন্তের টিকা দিয়েছিলেন। সকলেই টিকা নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমার কাছে এসেছ কেন ডাক্তার? যাদের ফিরে ফিরে বসন্ত আসে তাদের টিকা দাওগে যাও। আমার এত বছরে বছরে বসন্ত আসে না।’ এই কথা বলে তিনি লেখায় মন দিয়েছিলেন। কবির কথায় কৌতুক ছিল। সেই কৌতুক টিকা না দিতে পেরে বিমর্ষ হয়ে পড়া ডাক্তারবাবুকে স্পর্শ করেনি। রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের সঙ্গিনী ছিলেন রথীন্দ্রনাথের পালিত-কন্যা পুপে। পুপের লেখা আছে, ইনজেকশনের ভয়ে কবি বাথরুমে গিয়ে লুকোতেও কুণ্ঠিত হননি। ঘটনাটি ঘটেছিল শান্তিনিকেতনে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৫: আমাদের নাকি রোজই চুল পড়ে!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

সারাক্ষণ লেখালেখির কাজ। মাঝেমধ্যে তাই তিনি কোমরের ব্যথায় ভুগতেন। জ্বরও হয়েছে কখনও। অবসন্নতা-অবসাদ একবার তীব্র আকার ধারণ করেছিল। বেঁচে থাকাই তাঁর কাছে নিরর্থক হয়ে উঠেছিল। সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ রবীন্দ্রনাথ নিজেই খুঁজে পেয়েছিলেন।

বিদেশে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ কখনও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একবার ইউরোপে যাওয়ার মুখে হার্টের গন্ডগোল ধরা পড়েছিল। সফর বাতিল হয়েছিল। যাবার মুখে অসুস্থতা, সফর বাতিল, তবু বাঁচোয়া। সফরে গিয়েও তিনি অসুস্থ হয়েছেন। তেমন বড়সড় অসুস্থতা নয়, অত্যধিক ক্লান্তি, সঙ্গে জ্বর-সর্দি হয়েছিল একবার ইউরোপ সফরে গিয়ে।
দেশে-বিদেশে চিকিৎসা-সংক্রান্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে কবির, ইসিজি করানো হয়েছে অজস্রবার। প্যারিসে গিয়ে দাঁতের ব্যথায় একবার এতই কাবু হয়ে পড়েছিলেন যে, ও দেশেই দাঁত তুলতে হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থ শরীরেও কবির রসিকতার ঘাটতি পড়েনি। রসবোধে তিনি বরাবরই সমুজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথের তখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। অসুস্থ কবিকে কীভাবে ভালো রাখা যায়, তা নিয়ে প্রিয়জনদের চিন্তার অন্ত ছিল না। রানি চন্দের বইতে আছে, অসুস্থ কবিকে রাত-পাহারা দেওয়ার জন্য ঘরের বাইরে কন্যা মীরা একটি মোড়া নিয়ে বসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠিক টের পেয়ে গিয়েছিলেন। বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে চলে আসেন একটা মোড়া নিয়ে। ঠিক কন্যার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘মীরু, দু’জন জেগে থেকে কী লাভ?’

অসুস্থ শরীরেও রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করতে পারতেন। রসবোধে কখনও ঘাটতি পড়েনি। আসলে অসুখ-বিসুখকে কবি কোনওকালেই পাত্তা দেননি।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content