দ্বিজেন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ।
রবীন্দ্রনাথের ‘বড়দা’ দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন একেবারে অন্যরকম। আপাতভাবে তাঁকে মনেই হতে পারে, একটু বেশি রকমের খেয়ালি, আপনভোলা। অঙ্কে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল, দর্শনে পাণ্ডিত্য। ভালো কবিতা লিখতেন। তাঁর সম্পর্কে ‘জীবনস্মৃতি’তে করা রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, দক্ষিণের বারান্দায় বিছানা পেতে, সেই বিছানার উপর ছোটো একটা ডেস্ক পেতে দ্বিজেন্দ্রনাথ ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ লিখেছিলেন। এই কাব্যটি ঘিরে বালক-বয়সে কবির প্রবল ভালো-লাগা, মুগ্ধতা ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বড়দাদার আশ্চর্য ভাষা, তাঁহার বিচিত্র ছন্দ, তাঁহার ছবিতে ভরা পাকা হাতের রচনা আমার মত বালকের অনুসরণ চেষ্টারও অতীত ছিল। আশ্চর্য এই যে স্বপ্নপ্রয়াণ বারম্বার শুনিয়া তাহার বহুতর স্থান আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল এবং উহা যে একটি অত্যাশ্চর্য কাব্য তাহাতেও আমার সন্দেহ ছিল না।’
দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন সৃষ্টিশীল মানুষ। অনেক নতুন ভাবনা তাঁর মাথায় খেলা করত। সেই ভাবনার বাস্তব-রূপও প্রায়শই দিতেন তিনি। সেসব অবশ্য কতখানি কাজের হয়ে হয়ে উঠত, সে সন্দেহ রয়ে যায়। প্রতিমা দেবী তাঁর উচ্চস্তরের গণিতচর্চা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘আমার স্বামী জ্যাঠামশায়ের অঙ্কের ধারা কেমব্রিজের কোন বিখ্যাত পণ্ডিতকে দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এগুলি খুব উঁচু দরের অঙ্ক, কিন্তু এর পদ্ধতি কখনো জগতে কাজে লাগবে কিনা বলা যায় না।’
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অত্যন্ত খামখেয়ালি, জাগতিক সব ব্যাপারই প্রবলভাবে উদাসীন, আত্মমগ্ন এই মানুষটি কখনও ব্যস্ত থাকতেন কাব্য রচনায়, আবার কখনও বাক্স বানাবার কৌশল উদ্ভাবনে। উদ্ভাবিত সেই বাক্সের নাম দিয়েছিলেন ‘বাক্সোমেট্রি’। বাংলা শর্টহ্যান্ডের সূচনাও তাঁর হাতে। বহু গুণে গুণান্বিত, কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন। স্বভাব-উদাসীনতা ছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের বড়ো বৈশিষ্ট্য। আপাতভাবে তাঁর আচার-আচরণ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সবই ছিল হাস্যরসময়। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর লেখায় আছে, দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রায়শই এটা-সেটা হারিয়ে ফেলতেন। কিছু হারিয়ে ফেললেই বাড়িশুদ্ধ সবাইকে নিয়ে খুব হই হই বাঁধাতেন। হয়তো চশমা খুঁজে পাচ্ছেন না, ‘কোথায় চশমা, কোথায় চশমা’ হা-হুতাশ করতে করতে প্রচণ্ড রাগারাগিও করে ফেলতেন। ‘কী হল, কী হল’ বলে কাজ ফেলে দৌড়ে আসত গৃহভৃত্য মুনীশ্বর। দ্বিজেন্দ্রনাথকে বিচলিত দেখে একটু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াত, তারপরই তার মুখে শোনা যেত, ‘বাবামশায় চশমা তো আপনি পরেই আছেন!’
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৪: কবির ভালোবাসার নজরুল
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে
এমন অনেকবারই ঘটেছে। মুহূর্তে রাগ গলে জল হয়ে গিয়েছে। প্রতিমা দেবী এমনতরো ঘটনার সাক্ষী। তাঁর লেখায় আছে, ‘কোথায় গেল তখন রাগ— তাঁর উচ্চহাসিতে কম্পিত হয়ে উঠলো নিচুবাংলোর আমবাগান।… সুদূর থেকেও সেই হাসি লোকে শুনতে পেত…।’
ছিটেফোঁটাও অহংকার ছিল না। সহজ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। ছোটোভাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে হলেই গুরুপল্লির নিচুবাংলো থেকে চলে যেতেন আশ্রমের যে বাড়িতে কবি থাকতেন, সে বাড়িতে। কবির পুত্রবধূ তাঁকে দেখে কখনোসখনো হতবাকও হয়েছেন। হতবাক হওয়ার মতোই তো সে ঘটনা! দ্বিজেন্দ্রনাথ পরে থাকা জামা আগাগোড়া সাদা ফিতে দিয়ে শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে এসেছেন। ব্যাপার কী, এমনভাবে বাঁধার আড়ালে কী কারণ থাকতে পারে, মনে প্রশ্ন জাগার পরও প্রতিমা জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাননি। সবে ঠাকুরবাড়িতে এসেছেন বধূ হয়ে, এসব জিজ্ঞাসা করলে যদি আবার বিপত্তি ঘটে, তাই জানতে চেয়েছিলেন হেমলতা দেবীর কাছে। দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ হেমলতাকে প্রশ্ন করে প্রতিমা জানতে পেরেছিলেন, হাওয়া জামায় ঢুকুক, জামা উড়ুক, সেটা ওঁর পছন্দ নয়, তাই শরীরের সঙ্গে জামা অদ্ভুত কৌশলে বেঁধে রেখেছেন।
ছিটেফোঁটাও অহংকার ছিল না। সহজ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। ছোটোভাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে হলেই গুরুপল্লির নিচুবাংলো থেকে চলে যেতেন আশ্রমের যে বাড়িতে কবি থাকতেন, সে বাড়িতে। কবির পুত্রবধূ তাঁকে দেখে কখনোসখনো হতবাকও হয়েছেন। হতবাক হওয়ার মতোই তো সে ঘটনা! দ্বিজেন্দ্রনাথ পরে থাকা জামা আগাগোড়া সাদা ফিতে দিয়ে শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে এসেছেন। ব্যাপার কী, এমনভাবে বাঁধার আড়ালে কী কারণ থাকতে পারে, মনে প্রশ্ন জাগার পরও প্রতিমা জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাননি। সবে ঠাকুরবাড়িতে এসেছেন বধূ হয়ে, এসব জিজ্ঞাসা করলে যদি আবার বিপত্তি ঘটে, তাই জানতে চেয়েছিলেন হেমলতা দেবীর কাছে। দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ হেমলতাকে প্রশ্ন করে প্রতিমা জানতে পেরেছিলেন, হাওয়া জামায় ঢুকুক, জামা উড়ুক, সেটা ওঁর পছন্দ নয়, তাই শরীরের সঙ্গে জামা অদ্ভুত কৌশলে বেঁধে রেখেছেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদিত 'ভারতী'।
প্রতিমা দেবীর লেখায় আছে, বড়দাদাকে দেখামাত্র রবীন্দ্রনাথ প্রণাম করতেন। আশ্রমের তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁকে কবি পা ছুঁয়ে এইভাবে প্রণাম করতেন। অগ্রজ ও অনুজ দু-জনে এক জায়গায় বসে সাহিত্য- দর্শন নিয়ে গম্ভীর আলোচনা করতেন, প্রতিমা অবাক-চোখে দূর থেকে সে সব শুনতেন, লক্ষ করতেন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি
লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…
রবীন্দ্রনাথের কথা দ্বিজেন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করত। তাঁর চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠত, তা প্রতিমা দেবীর কখনও নজর এড়িয়ে যায়নি। দ্বিজেন্দ্রনাথের হাবভাব দেখে প্রতিমার মনে হত, তিনি তাঁর ভাইটিকে ‘শিশু রবি’ বলেই ভাবতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন খ্যাতির শীর্ষে, ‘গীতাঞ্জলি’ লিখে সবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, সেই আনন্দ-মুহূর্তে দ্বিজেন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখেছিলেন ছোটোভাইটিকে। প্রতিমা দেবীর স্মৃতিচারণ থেকেই জানা যায়, সে চিঠি ছিল এরকম, ‘সেদিনের সেই শিশুরবি আজ আবার পৃথিবীর বিদ্বান ও গুণিমহলে এত নাম করবে, এ আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি।’
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
দ্বিজেন্দ্রনাথ পশুপাখিদের কতখানি ভালোবাসতেন, তা আমাদের অজানা নয়। গায়ে মাথায় নির্ভয়ে পাখিরা এসে বসত, কাঁধে কাঠবিড়ালি ঘুরে বেড়াত। পশুপাখিদের জন্য নিচু বাংলোয় খাবার সাজানো থাকত। তাঁর এই ভালোবাসা কত গভীর ছিল, তা জানাতে গিয়ে প্রতিমা দেবী একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। একদিন এক চড়াই চশমা পরা দ্বিজেন্দ্রনাথের চশমায় ঠোকর মেরেছিল। চশমা পরা থাকায় সরাসরি চোখের ক্ষতি না হলেও দ্বিজেন্দ্রনাথের কপালে আঘাত লেগেছিল। কেন সে ঠকরাতে এলো, এ ভাবে অকারণে আঘাত করল, এসব ভেবে উত্তেজিত হয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ তখনই মুনীশ্বরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘একে আর খেতে দিস নে, তাড়িয়ে দে।’ নির্দেশ মতো চড়ুইটিকে সেদিন আর খেতে দেওয়া হয়নি। ছোট্ট পাখিটি অনুতপ্ত হয়ে অথবা বকা খেয়ে আর সে পথ মাড়ায়নি। এই ভাবে দু-তিন দিন যাওয়ার পর দ্বিজেন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। মুনীশ্বরকে বললেন, ‘ওকে আন। ওর কিছু দোষ নেই। চশমা যে চোখের উপরে থাকে, তা সে আর কী করে বুঝবে?’
আরও পড়ুন:
অজানার সন্ধানে: পাচার হয়েছিল টন টন সোনা ও দামি ধাতু! ৮৫ বছরের সেই ভূতুড়ে রেলস্টেশন এখন অভিজাত হোটেল
চলো যাই ঘুরে আসি: অযোধ্যা— প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১
ভবিষ্যবাণী: বিবাহিত? প্রেমের সম্পর্কে রয়েছেন? জেনে নিন গ্রহের স্থান কিরকম থাকলে সম্পর্ক মজবুত ও মসৃণ হয়
পরের দিনই সে পাখি এলো। হয়তো ভালোবাসার টানেই এই পুনরায় আগমন। চড়ুই ফিরে আসায় দ্বিজেন্দ্রনাথ যে ভারি আনন্দ পেয়েছিলেন, তা তাঁর চোখে মুখেই ফুটে উঠেছিল। প্রতিমা দেবী অতি নিকট থেকে দেখেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথকে। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘এই ঋষিতুল্য বৃদ্ধকে দেখলে মনে হত, সব সময় যেন ধ্যানের মধ্যে বিচরণ করছেন। বাহিরের প্রকৃতির সঙ্গে যোগ যেন নেই, নিজেকে যেন বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। চক্ষু সব সময় স্বপ্নময় ভাসা ভাসা হয়ে থাকত, পরিচিত কেউ এলে যেন চমক ভাঙত।’ সত্যিই তিনি ছিলেন ঋষিতুল্য।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।
সাধকের মতো তাঁর জীবনযাপন। নিজেকে গুটিয়ে, লুকিয়ে রেখেই তাঁর ছিল আনন্দ। নানা ক্ষেত্রে ছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের পারঙ্গমতা। অভাবনীয় সব কৃতিত্ব। এত বড় মানুষ, অথচ তাঁর মধ্যে ছিল অভাবনীয় রকমের ছেলেমি, জীবন ছিল সারল্যে ভরপুর। ব্যতিক্রমী তিনি, একেবারেই অন্যরকম। পশুপাখিদের প্রতি তাঁর নিখাদ ভালোবাসা আমাদেরও উদ্বুদ্ধ করুক।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।