বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


'সখা ও সাথী', যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল প্রথম রবীন্দ্র- জীবনী।

আত্মজীবনী লিখেছিলেন প্রৌঢ়ত্বের দরজায়, পঞ্চাশ ঊর্দ্ধ তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স। বলা-ই বাহুল্য, সেটি ‘জীবনস্মৃতি’। জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে লিখেছিলেন ‘ছেলেবেলা’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বহস্তে আত্মকথা লেখেননি। মুখে মুখে বলে গিয়েছিলেন, অনুলিখন করেছিলেন ‌বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়। ঠাকুরবাড়ির বধূমাতা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নিজের জীবনের কথা দীর্ঘ পরিসরে বলেছিলেন কন্যা ইন্দিরা দেবীকে। ইন্দিরা লিখে রেখেছিলেন।

আত্মজীবনী ও জীবনী এক নয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের একটি প্রামাণ্য জীবনী রচনা করেছিলেন আশ্রমশিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তী। অকালপ্রয়াত অজিতকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহ‌ভাজন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তথ্যনিষ্ঠ‌ ও প্রামাণ্য জীবনী লিখেছিলেন মন্মথনাথ ঘোষ। সাত কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল ‘মানসী ও মর্মবাণী’ পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

বিভিন্নজনের লেখা রবীন্দ্রজীবনীর অভাব নেই। ভারতীয় ভাষায়, এমনকি বিদেশি ভাষাতেও‌ রবীন্দ্রনাথের জীবনী লেখা হয়েছে। বাংলা ভাষায় লেখা, গ্ৰন্থাকারে প্রকাশিত কবির প্রথম জীবনচরিত কোনটি, এ-প্রশ্নের উত্তরে নির্দ্বিধায় যামিনীকান্ত সোমের ‘ছেলেদের রবীন্দ্রনাথ’ বইটির কথা বলতে হয়। বইটি রবীন্দ্রনাথও পাঠ করেছিলেন। ২০ মাঘ ১৩৩৮-এ লেখা এক চিঠিতে তিনি যামিনীকান্ত সোমকে জানিয়েছিলেন, ‘তোমার ‘ছেলেদের রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে আনন্দিত হয়েছি।’ ‘মৌচাক’ পত্রিকায় বইটির প্রশংসাসূচক আলাচনা করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতে‌ই কাজ শুরু হয়েছিল প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা রবীন্দ্রজীবনী-র। চার খণ্ডে সমাপ্ত প্রভাতকুমারের রবীন্দ্রজীবনী যে বহু তথ্যের উৎস, যথার্থ অর্থেই আকরগ্ৰন্থ, তা নিয়ে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই। প্রভাতকুমার নিজেই জানিয়েছেন, তাঁর এই কাজ সম্পূর্ণতা পেয়েছিল কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের অকৃপণ সাহায্য-সহযোগিতায়।‌ নথি, পাণ্ডুলিপি‌, চিঠিপত্র, জীবনী-রচনার যাবতীয় উপাদান তিনি সংগ্ৰহ ও সংরক্ষণ করে সযত্নে রেখেছিলেন। এ-কাজে কবিপুত্রকে সাহায্য করেছিলেন কবির জামাতা, কন্যা মীরা দেবীর স্বামী নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রভাতকুমারের দেখানো পথে পরবর্তীকালে অধিকতর সাফল্য পেয়েছেন প্রশান্তকুমার পাল। তাঁর রবীন্দ্রজীবনী-রচনার বৃহৎ কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণ না হলেও যে আটটি খণ্ড রচিত হয়েছে, তা অতীব মূল্যবান।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনকথা প্রকাশিত হয় ‘সখা ও সাথী’ পত্রিকায়। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন ভুবনমোহন রায়। ‘শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ শিরোনামে এই জীবনকথাটি প্রকাশিত হয়েছিল শ্রাবণ, ১৩০২ সংখ্যায়। খুব সংক্ষেপে, সামান্য কিছু শব্দ-যোজনায় জীবনকথা লেখার প্রয়াস নয়, বেশ বিশদে লিখেছিলেন সম্পাদক ভুবনমোহন। মুদ্রিত জীবনকথার সঙ্গে ছবিও ছাপা হয়েছিল। শিরোনামে ‘সচিত্র জীবনকথা’ এই শব্দযুগল ব্যবহৃত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৫: রাক্ষসী মায়ায় ঘনাল কি বিপদের ছায়া

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯: কৌরবদের জন্ম এবং কুরুপাণ্ডবদের ছেলেবেলার শত্রুতা

এই সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র মিত্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু অন্নদাচরণ সেন, কালিশঙ্কর সুকুল প্রমুখ লিখেছিলেন। ছাপা ‘জীবনস্মৃতি’-তে বর্ণিত ঘটনামালার আভাস রয়েছে কবির এই জীবনকথায়। ৭৬ থেকে ৭৯, মোট চার পৃষ্ঠার এই জীবনকথায় এমন‌ কিছু কিছু তথ্য‌ ও ঘটনার কথা আছে, যা ‘জীবনস্মৃতি’তে বা ‘ছেলেবেলা’-য় নেই। পারিবারিক সূত্রে এই জীবনকথায় উল্লিখিত‌‌ কিছু কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন ভুবনমোহন। কবির সঙ্গে কথা বলেও জেনে নিয়েছিলেন বহু তথ্যু। রবীন্দ্রনাথের জীবনকথাটি প্রকাশিত হয়েছিল শ্রাবণে, জৈষ্ঠে ছাপা হয়েছিল প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘সচিত্র জীবনকথা’। সেটিও ছিল সম্পাদক ভুবনমোহনের লেখা।

'ইচ্ছাপূরণ', 'সখা ও সাথী' পত্রিকায় প্রকাশিত ‌রবীন্দ্র-গল্প।

এটি যে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনকথা, তা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সখা ও সাথী’তে এই জীবনকথাটি প্রকাশের আগে, ১৮৮৪ সালে নবকান্ত চট্টোপাধ্যায় সংকলিত ‘ভারতীয় সঙ্গীত মুক্তাবলী’ গ্ৰন্থে রবীন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত ব্যক্তি-পরিচিতি মুদ্রিত হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত ব্যক্তি-পরিচয় ও জীবনকথা যে এক নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘সখা ও সাথী’তে প্রকাশিত রবীন্দ্র-জীবনকথা কে লিখেছিলেন, সরাসরি স্পষ্ট করে তা না বলা হলেও সূচিপত্রে রচনাকারের নামের জায়গায় রয়েছে ‘সম্পাদক’। তাই আমরা নিশ্চিত হতে পারি, কবি-জীবনীটি ভুবনমোহন রায়ই লিখেছিলেন‌।

রবীন্দ্রনাথ তখন তেত্রিশ বছরের যুবক। ‘সোনার তরী’, ‘মানসী’ ও ‘বিসর্জন’-এর মতো কাব্য ও নাট্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও তাঁর খ্যাতি সর্বত্রগামী হয়ে ওঠেনি। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই ভুবনমোহন রায় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এক কবি-লেখকের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৪: মাছের বাজারের দুনিয়ায় আলিপুরের ‘নেট বাজার’ তালিকায় শীর্ষে

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৩: আচমকা রাতের পার্টিতে হাজির পুলিশ

ভুবনমোহন নিজেও লিখতেন, সম্পাদক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব প্রশ্নাতীত। প্রথম সার্থক ছোটদের পত্রিকা ‘সখা’-র অস্তিত্ব সাহিত্যের আঙিনা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে, তিনি মেনে নিতে পারেন নি। নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাথী’-র সঙ্গে ‘সখা’ নামটি যুক্ত করে পত্রিকার নতুন নামকরণ করেছিলেন ‘সখা ও সাথী’। ভুবনমোহন রায়ের নাম বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও এক সময় শুধু সম্পাদক হিসেবে নয়, লেখক হিসেবেও তিনি সুখ্যাতির অধিকারী ছিলেন। নিয়মিত ছোটদের পত্র-পত্রিকায় লিখতেন। ‘সখা ও সাথী’তে ছোটদের কথা ভেবে অ্যাডভেঞ্চারমূলক লেখাও লিখতে শুরু করেছিলেন। সে-লেখার নাম ‘সুন্দরবনে সাত বৎসর’। ছোটদের কথা ভেবে এর আগে এমন অ্যাডভেঞ্চার লেখার প্রয়াস খুব বেশি হয়নি। লেখাটি অবশ্য ভুবনমোহন শেষ করতে পারেননি। সব মিলিয়ে চারটি সংখ্যায় লিখেছিলেন। অসমাপ্ত উপন্যাসটি পরবর্তীকালে শেষ করার কথা ভেবেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার। খগেন্দ্রনাথ মিত্র ‘শতাব্দীর শিশুসাহিত্য’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘বার্ধক্য, অসুস্থতা, পরিশেষে মৃত্যু তাঁকেও কর্মটি সম্পন্ন করতে দেয় না।’ যোগীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত সে কাজ ‌পরে সম্পন্ন করেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।‌ যোগীন্দ্রনাথ সরকারের এক পুত্রের অনুরোধে বিভূতিভূষণ এই অসমাপ্ত উপন্যাসটি সমাপ্ত করেছিলেন। যোগীন্দ্র-পুত্র প্রকাশনশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত‌ প্রকাশনালয় ‘সিটি বুক সোসাইটি’ তিনিই দেখাশোনা করতেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনী, 'সখা ও সাথী'র পাতায়।

লেখক হিসেবে সফল, সম্পাদক হিসেবে‌ ভুবনমোহন রায়ের প্রশ্নাতীত সাফল্য। অভাবনীয় তাঁর দূরদর্শিতা। সূচনাপর্বেই রবীন্দ্রনাথকে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। ভুবনমোহন বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর খ্যাতি বহুদূর প্রসারিত হবে, তাঁকে ঘিরে বিস্ময় সৃষ্টি হবে!

‘সখা ও সাথী’তে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিয়মিত লিখতেন। উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে ভুবনমোহনের যথেষ্ট সখ্যও ছিল।‌ উপেন্দ্রকিশোর শুধু নন, ‘সখা ও সাথী’তে তো অনেকেই নিয়মিত লিখতেন! জগদানন্দ রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সখারাম গণেশ দেউস্কর, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রামব্রহ্ম সান্যাল, গিরিজাকুমার বসু, দীনেন্দ্রকুমার রায়—এমন কত নাম, তাঁদের বিচিত্র রচনা-কর্মের হদিস মেলে ‘সখা ও সাথী’-র জীর্ণ পৃষ্টায়। ভুবনমোহন তাঁদের কারও জীবনী লেখার ও ছাপার কথা ভাবেননি। তিনি চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ‘সখা ও সাথী’-র জন্যও কলম ধরুন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেও লেখা পাওয়ার প্রত্যাশা ফলপ্রসূ হয়নি। ‌রবীন্দ্রনাথের একটি পত্র থেকে জানা যায়, ‘অনেক ব্যর্থ অনুরোধের পর অবশেষে রফা’ হয়েছিল পত্রিকা-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ঠিক হয়েছিল, তাঁরা কবির ‘একটি কোন পুরাতন গল্প সহজ ভাষায় লিপিবদ্ধ’ করে ছাপাবেন। রবীন্দ্রনাথ উল্লিখিত পত্রে জানিয়েছেন, ‘ছুটি গল্পটি নির্বাচিত হইলে পর তাহার পুনর্লিখনের ভার তাঁহাদেরই হাতে দিই।’ গল্পটির পুনর্লিখন ও মুদ্রণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কিঞ্চিৎ রসিকতা করে লিখেছেন, ‘সে বেচারার ভাগ্যে ছাপাখানার মসী-অভিষেক জোটে নাই—কারণ অবশেষে একটি নূতন ছোট গল্প লিখিয়া সম্পাদকীয় Perturbed spiritকে শান্তি দান করিয়াছিলাম।’ রবীন্দ্রনাথ নতুন যে গল্পটি ‘সখা ও সাথী’ পত্রিকায় দিয়েছিলেন, সেটি ‘ইচ্ছাপূরণ’। গল্পটি সযত্নে ছাপা হয়েছিল। গল্পের সঙ্গে তিনটি প্রাসঙ্গিক ছবিও ছাপা হয়। বহু আকাঙ্ক্ষিত গল্পটি হাতে পাওয়ার আগেই ভুবনমোহন রায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলে, অন্যান্য সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কবির জীবনকথা লিখে ফেলেছিলেন। সে-লেখা রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে প্রকাশের ‌অনুমতিও নিয়েছিলেন।‌‌ কবির সম্মতি পাওয়ার পরই পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন ভুবনমোহন। যে বছর‌ জীবনকথাটি ‘সখা ও সাথী’তে প্রকাশিত হয়, সে-বছরের ফাল্গুন সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ বইটির সমালোচনা। এই কাব্যপুস্তিকাটির ছবি এঁকে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।

তেত্রিশ বছরের রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ‘কুঁড়িতেই’ সৌরভের ‘আভাষ’ পেয়েছিলেন ‘সখা ও সাথী’-র সম্পাদক। প্রকাশিত রবীন্দ্র-জীবনকথার সূচনা হয়েছে এ-ভাবে, ‘যে ফুলের সৌরভ আছে, কুঁড়িতেই তাহার আভাস পাওয়া যায়। যাহার কুঁড়িতে সৌরভ নাই, সে ফুল ফুটিলেও সৌরভ পাওয়া যায় না। মানুষেরও প্রতিভা থাকিলে সে প্রতিভা ফুটিয়া উঠিবার আগেই তাহার আভাস পাওয়া যায়। যাঁহারা বড় লোক হইয়াছেন, তাঁহাদের সকলের জীবনেই আমরা এটি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাই।’ ‘বড় লোক’ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ভুবনমোহন প্রতিভার স্ফুরণ- আভাস শুধু লক্ষ করেননি, প্রতিভার দীপ্তি তাঁকে অভিভূত করেছিল। সেই মুগ্ধতা থেকেই জীবনকথা রচনার প্রয়াস। ভুবনমোহন লিখেছেন, ‘আজ বাঙলার একজন প্রধান প্রতিভাবান লেখকের সম্বন্ধে কয়েকটি কথা তোমাদিগকে বলিব। যে প্রতিভাবলে তিনি আজ এত যশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, বাল্যকালে সেই প্রতিভা কি রকম ফুটিয়া উঠিয়াছিল, তাহা তোমাদিগকে দেখাইতে চেষ্টা করিব।’
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!

স্বাদে-আহ্লাদে: আম দিয়ে তৈরি এই লোভনীয় স্বাদের আচার খেয়েছেন?

দশভুজা: জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২

এই চেষ্টা সংক্ষিপ্ত পরিসরে। ভুবনমোহন রায়ের লেখা জীবনকথায় এমন তথ্যও আছে, যা ‘জীবনস্মৃতি’ বা ‘ছেলেবেলা’য় নেই। সেসব তথ্য বানানো, মন-গড়া নয়, তেমন হলে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই শুধরে দিতেন। তথ্য পরিবেশনে‌ যেটুকু ত্রুটি ছিল, তা তিনি নিজেই‌ সংশোধন করে দিয়েছিলেন। ভাদ্র সংখ্যায় ‘রবিবাবুর পত্র’ মুদ্রিত হয়েছিল, সে পত্রে রবীন্দ্রনাথ তথ্যগত ত্রুটি সংশোধন করেছিলেন। ফলে এই সংশোধনের পর অন্তত একথা বলা যায়, প্রথম প্রকাশিত কবির এই জীবনকথায় তথ্যগত বিচ্যুতি আর নেই। যাঁর জীবনী, তাঁর দ্ধারা অনুমোদিত হলে সে আশঙ্কা‌ আর থাকে না। প্রামাণ্যতা নিয়েও পাঠক-মনে প্রশ্ন জাগে না।

রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত পত্রটি সরসতায় উজ্জ্বল, কৌতুকমিশ্রিত। কবি‌ লিখেছেন, ‘আধুনিক কালের শাস্ত্র অনুসারে পিণ্ডদানের পরিবর্তে জীবনবৃত্তান্ত রচনা প্রচলিত হইয়াছে; কিন্তু অনুরাগী ব্যক্তিগণ যখন তাঁহাদের প্রীতিভাজনের জীবদ্দশাতেই উক্ত বন্ধুকৃত্য আগেভাগে সারিয়া রাখিতে চেষ্টা করেন, তখন সজীব সশরীরে তাঁহাদের প্রদত্ত সেই অন্তিম সৎকার গ্ৰহণ করিতে সঙ্কোচ বোধ হয়।… আপনারা যখন আমার বাল্য-বিবরণ লিখিবেন বলিয়া আমাকে শাসন করিয়া গিয়াছিলেন, তখন তাহার গুরুত্ব আমি উপলব্ধি করিতে পারি নাই—এবং নিশ্চিন্ত চিত্তে সম্মতি দিয়াছিলাম, কিন্তু সম্প্রতি আপনাদের মাসিকপত্রে প্রবন্ধের শিরোভাগে নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখিয়া সবিশেষ লজ্জা অনুভব করিতেছি। ছাপার কালিতে ম্লান না দেখায় এমন উজ্জ্বল নাম অল্পই আছে।’

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল।

‘জীবনস্মৃতি’ লিখতে বসে রবীন্দ্রনাথের যে স্মৃতি-বিভ্রাট ঘটেছিল, তা প্রশান্তকুমার পালের পরিশ্রমী কাজে, রবীন্দ্রচর্চার আকরগ্রন্থ রবিজীবনীতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার প্রসঙ্গটি। ‘জীবনস্মৃতি’তে কবি ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার কথা জানালেও আদৌ যে তিনি ওই বিদ্যালয়ে পড়েননি, তা ঠাকুরবাড়ির ‘ক্যাশবহি’ দেখে প্রশান্তকুমার পাল প্রমাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই প্রথম জীবনকথায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার কথা ভুলেও বলা হয়নি। ভুবনমোহন রায়কে রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়েছিলেন। তাই বলা যায়, যুবক বয়সের সজীব স্মৃতিগাত্রে পরিণত বয়সে বিভ্রান্তির আস্তরণ পড়েছিল! কবির স্মৃতি বিপর্যয় ঘটেছিল।‌ এই জীবনকথায় কবিজীবনের কোনও কোনও ঘটনা যেন-বা পেন্সিলে আঁকা স্কেচ, ‘জীবনস্মৃতি’তে সে-সব ঘটনা জলরঙে-তেল রঙে আঁকা বর্ণময় ছবি। বাল্য- কৈশোরের স্মৃতি সহসা হারায় না। ‘জীবনস্মৃতি’-র পাতায় পাতায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।‌ ‘জীবনস্মৃতি’তে বর্ণময় হয়ে ওঠা একটি ঘটনা খুব সংক্ষেপে শুনিয়েছেন ভুবনমোহন। নিশ্চিতভাবে রবীন্দ্রনাথই তাঁকে এই আখ্যানটি শুনিয়েছিলেন, সংক্ষেপে ঘটনা-নির্যাস দিয়েছেন ভুবনমোহন। তাঁর লেখা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘বাড়ীর চতুঃসীমার মধ্যেই বালক রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদ্র পৃথিবীটি আবদ্ধ ছিল। বাড়ীর বাহির হইবার তাঁহার অধিকার ছিল না; এবং সমবয়স্ক অন্যান্য বালকদের সহিতও খেলিতে পাইতেন না। দক্ষিণ খোলা একটি ঘরে বসিয়া সম্মুখে পুষ্করিণী তীরের ঘনপল্লবময় বটগাছটির দিকে চাহিয়া থাকিতেন এবং বাল্য-কল্পনায় সেই ছায়াময় বটমূলে কত পরীর আবাসস্থান দেখিতে পাইতেন। শ্বেতবর্ণ রাজহাঁসগুলি গলা বাঁকাইয়া পুষ্করিণীর কালো জলে সাঁতার দিয়া বেড়াইত, কখনো বা চঞ্চু দ্বারা আপনাদের পক্ষ পরিষ্কার করিত, মহা‌ কুতূহলে বসিয়া তিনি তাহাই দেখিতেন।’ পরবর্তীকালে ‘জীবনস্মৃতি’তে বর্ণিত এমন কত ঘটনার কথাই তো ‘সখা ও সাথী’তে প্রকাশিত জীবনকথায় এসেছে! নর্মাল স্কুলের শিক্ষক সাতকড়িবাবুর কথা আছে। যিনি দু’ পঙক্তি লিখে দিয়ে বালক রবীন্দ্রনাথকে পরের দু’ পঙক্তি লিখে আনতে বলেছিলেন। শিক্ষকমশায়ের ‘রবিকরে জ্বালাতন…’ দু’ পঙক্তির পর মানানসই আরও দু’টি পঙক্তি লিখে দিয়েছিলেন আট বছরের রবীন্দ্রনাথ। পঙক্তি দুটি আমাদের অজানা নয়, ‘মীনগণ‌ হীন হয়ে ছিল…’। রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনা, পেনেটির বাগানবাড়িতে যাওয়ার স্মৃতি, পিতার সঙ্গে ডালহৌসি পাহাড়ে যাওয়া বা সিভিলিয়ান অগ্ৰজ সত্যে ন্দ্রনাথের কর্মস্থল বোম্বাই যাওয়া—এমনতরো নানা চেনা ঘটনা, পরবর্তীকালে ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা ঘটনা ক্রমান্বয়ে এসেছে ভুবনমোহন রায়ের লেখা কবির এই জীবনকথায়। পেনেটির বাগানবাড়িতে বড়ো আনন্দে কেটেছিল বালক রবীন্দ্রনাথের। জানা যায়, ‘পানিহাটির বাড়ীটি গঙ্গার ধারে, সম্মুখে বিস্তৃত বালুকাময় চড়া। গাছপালার শোভা, পাখীর গান,নদীর কুল কুল রব, এই সমস্ত দেখিবার ও শুনিবার জন্য রবীন্দ্রনাথের মন বড়‌ ব্যাকুল হইত।’ ভুবনমোহন রায় বালক রবীন্দ্রনাথের অন্তরে জেগে ওঠা আবেগ স্পর্শময় ভাষায় এই জীবনকথায় ধরে রেখেছেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৩: এখানকার একমাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁর মালিকও বাঙালি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

‘জীবনস্মৃতি’তে ‘পেনেটির বাগানবাড়ি’ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় আছে। সেই অধ্যায়ের পরতে পরতে মিশে রয়েছে কবির বালকবেলার আবেগ। পেনেটির আনন্দ-স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ জীবনভর লালন করেছিলেন।

চেনা তথ্য, অল্প জানা তথ্য, এমনকি অনেক অজানা তথ্যও রয়েছে এই জীবনকথায়। আকারে আয়তনে যতই সংক্ষিপ্ত হোক না কেন, ভুবনমোহন রায়ের লেখা কবির এই প্রথম জীবনকথাটি অতীব মূল্যবান। এমন তথ্যও তো আছে, যা অন্যত্র, বইতে বা স্মৃতিনির্ভর রচনায় নেই। এই জীবনকথায় রয়েছে নর্মাল স্কুলের শিক্ষক হরনাথ পণ্ডিতের কথা‌। রবীন্দ্রনাথ কখনো এই শিক্ষকের কথা লেখেননি বা বলেননি। ভুবনমোহনের জীবনকথার তথ্যগত যে সামান্য ত্রুটি ছিল, তা তো রবীন্দ্রনাথ পত্রিকা-সম্পাদককে রীতিমতো চিঠি লিখে সংশোধন করে দিয়েছিলেন! হরনাথ পণ্ডিতকে কেন্দ্র করে ভুবনমোহনের কোনও তথ্যগত ত্রুটি থাকলে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই উল্লেখ করতেন। তা কবি করেননি। ফলে আমরা নিশ্চিত, হরনাথ পণ্ডিতের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল নর্মাল স্কুলে। হরনাথ ভালো শিক্ষক ছিলেন না। ছেলেদের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করতেন। ভুবনমোহন রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, বালক রবীন্দ্রনাথের মনে এই শিক্ষককে ঘিরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। কবির জীবনকথায় আছে, ‘রবীন্দ্রনাথ এই শিক্ষকের উপর হাড়ে চটা ছিলেন; কখনো ইহার সহিত কথা কহেন নাই, ক্লাসে পড়া জিজ্ঞাসা করিলেও রবীন্দ্রনাথ তাহার উত্তর করিতেন না। ইহার জন্য অনেক সময় তাঁহাকে খুব কঠিন শাস্তি পাইতে হইয়াছে, অনেক সময়ে উঠানে রৌদ্রে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে। সে আবার সোজা দাঁড়ান নয়, মাথা হেঁট করিয়া পিঠ বাঁকইয়া, অনেকক্ষণ একভাবে থাকিতে হইত।’

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়-শিক্ষক মধূসুদন বাচস্পতির নেওয়া পরীক্ষায় অনেক নম্বর পেয়েছিলেন। বালক রবির সে-কৃতিত্ব মেনে নিতে পারেননি হরনাথ‌ পণ্ডিত। বিরূপ‌ মন্তব্য করেছিলেন।‌ বলেছিলেন, ‘পরীক্ষক পক্ষপাত করিয়া বেশী নম্বর দিয়াছেন। যে সারা বৎসর কিছু পড়ে নাই, সে কেমন করিয়া এত নম্বর পাইল।’ রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় পরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিলেন হরনাথ পণ্ডিত। রবীন্দ্রনাথ‌‌ ‘বিরক্তিবশতঃ’ই তাঁর ক্লাসে অমনোযোগী হতেন, পড়া শুনতেন না,পড়া ধরলেও উত্তর দিতেন না। শিক্ষক হিসেবে হরনাথ পণ্ডিত ব্যর্থ, নিজের ব্যর্থতা নিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও তিনি ভাবেননি।

হরনাথ পণ্ডিতের হৃদয়হীন আচরণের স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ বোধহয় সচেতনভাবেই মনে রাখতে চাননি। যদি ‘জীবনস্মৃতি’তে বা ‘ছেলেবেলা’-য় হরনাথ পণ্ডিতের কথা তিনি লিখতেন, তাহলে এ-পেশার পক্ষে অনুপযুক্ত, সমাজজীবনের পক্ষে ক্ষতিকর এক হৃদয়হীন শিক্ষকের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতো। নির্মমতার জন্য, হৃদয়হীনতার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন, ভুলে থেকেছেন।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

হেলদি ডায়েট: এই গরমে চুলের যত্ন নেওয়ার জন্য রইল ১০টি জরুরি টিপস

অজানার সন্ধানে: মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?

ভুবনমোহন সযত্নে রবীন্দ্রনাথের জীবনকথা লিখেছিলেন। তথ্য যতই অপ্রতুল হোক না কেন,তথ্য সংগ্ৰহে তাঁর নিষ্ঠার অভাব ছিল না। কবির কাছ থেকেই যে হেতু অধিকাংশ তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল, তাই পরিবেশিত তথ্যের প্রামাণ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও দু’চারটি তথ্যগত ত্রুটি রয়ে গেছে। ক্রমান্বয়ে ক্রটিগুলি রবীন্দ্রপত্রের অনুসরণে উল্লেখ করা যেতে পারে। ভুবনমোহনের লেখায় আছে, ‘একবার একটি সভায় দেশের প্রধান প্রধান লেখকগণ একত্রিত হইয়াছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া বঙ্কিমবাবুর গলায় একছড়া মালা পরাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু বঙ্কিমবাবু সেই মালাছড়াটি রবীন্দ্রনাথের গলায় সাদরে পরাইয়া দিলেন। দেশের প্রধান প্রধান লেখকদিগের মধ্যে বঙ্কিমবাবুর কাছে এ প্রকার সমাদর লাভ করা সাধারণ গৌরবের কথা নয়। আজকাল রবীন্দ্রনাথ দেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক বলিলে অত্যুক্তি হয় না।’ ভুবনমোহনের লেখায় অতিরঞ্জন আছে। রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিতে গিয়ে তিনি যে ঘটনা আরোপ করেছেন, তা কবি খণ্ডন না করলে, সকলে সত্য বলে ধরে নিত। হয়তো তিনি নিজে আরও বেশি করে প্রতিভাত হতেন, তা সত্বেও রবীন্দ্রনাথ চান নি, আরোপিত আখ্যান ‘সত্য’ হয়ে উঠুক। তাই পত্রিকা-সম্পাদককে চিঠি লিখে প্রকৃত ঘটনাটি জানিয়েছেন। কী ঘটেছিল সেদিন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মাননীয় শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের জ্যোষ্ঠা কন্যার বিবাহ-সভায় নিমন্ত্রিত হইয়া আমি বাহিরের বারান্দায় বেড়াইতেছিলাম, সেইখানে বঙ্কিমের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমার কোন নব প্রকাশিত গ্ৰন্থ সম্বন্ধে আলোচনা করিতেছিলেন, এমন সময় কন্যা-কর্তৃপক্ষের কেহ বঙ্কিমের কণ্ঠে পুষ্পমাল্য পরাইতে আসিলে তিনি তাহা লইয়া স্বহস্তে আমার গলে অর্পণ করিয়াছিলেন। সেখানে দেশের প্রধান লেখকরা উপস্থিত ছিলেন না—এবং মাল্যদানের দ্বারা বঙ্কিম আমাকে অন্যান্য লেখকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পদ দেন নাই।’

ভুবনমোহন লিখেছেন, ‘পিতার সহিত ডালহাউসি পাহাড়ে কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন। তাঁহার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,রাত্রি চারিটার সময় উঠিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিতেন, পুত্রকেও সেই সময়ে উঠিয়া সংস্কৃত রামায়ণের শ্লোক ও সংস্কৃত ব্যাকরণ মুখস্থ করিতে হইত।’ পিতৃদেব ভোররাতে চারটের সময় নয়, উঠতেন ‘অর্ধরাত্রে’, এরপর শুরু হতো তাঁর উপাসনা। এই ত্রুটিও সংশোধন করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ভুবনমোহনকে লেখা উল্লিখিত পত্রে লিখেছেন, ‘ডালহৌসি পাহাড়ে থাকিতে আমার পিতা অর্ধরাত্রে উঠিয়া বারান্দায় বসিয়া উপাসনা করিতেন; আমাকে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ অভ্যাস করিবার জন্য রাত্রি চারিটায় সময় উঠাইয়া দিতেন।’ রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন, তাঁর জীবনকথা যেটুকু ছাপা হয়েছে, তাতে যেন কোনও ভুল তথ্য না থাকে! তাই পিতৃদেবের উপাসনার সময়কালটিও নির্ভুলভাবে দিতে তৎপর হয়েছেন, আবার, শিক্ষকমহাশয়ের নামটিও ঠিকঠাক দিতে চেয়েছেন। তাই ভুবনমোহনকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শ্রীযুক্ত মধুসূদন বাচস্পতি মহাশয়কে আপনাদের প্রবন্ধে স্মৃতিরত্ন উপাধি দেওয়া ‌হইয়াছে; নিশ্চয়ই সেটা বিস্মৃতিবশতঃই ঘটিয়াছে।’ ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে বাড়ির ছোটরা স্কুলে যাচ্ছে দেখে রবীন্দ্রনাথ স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতেন। সে-সময় তাঁর স্কুলে যাওয়ার এই সদিচ্ছা নিয়ে আগাম ভবিষ্যৎ-বাণী করেছিলেন এক পণ্ডিতমশায়। বলেছিলেন, ‘এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য কাঁদছ, এরপর স্কুলে যেতে হবে বলে কাঁদবে।’ না, এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন তোলেননি। ভুবনমোহন লিখেছিলেন, ‘ছেলেবেলায় তাঁহাকে স্কুলেও যাইতে দেওয়া হয় নাই, বাড়ীতেই পণ্ডিত রাখিয়া পড়ান হইত।’ আসল ঘটনাটি তেমন নয়। ছেলেবেলায়, নিতান্ত অল্প বয়েসে রবীন্দ্রনাথকেও স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। তথ্যগত এই ত্রুটি ‌এভাবে তিনি শুধরে দিয়েছেন, ‘অভিভাবকগণ যথেষ্ট বাল্যবয়সেই আমাকে স্কুলে দিয়াছিলেন; কিন্তু আমার অপেক্ষা অধিক বয়স্ক সঙ্গীগণ আমার পূর্বেই স্কুলে যাইবার অধিকার প্রাপ্ত হওয়াতে আমি ঈর্য্যন্বিত হইয়া প্রভূত শোক প্রকাশ করিয়াছিলাম, সে কথা যথার্থ।’

রবীন্দ্রনাথ। ১৮৯০ তে তোলা ছবি।

ভুবনমোহন রায় ছিলেন শিশু-কিশোর সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ। ছোটদের কথা ভেবে নানা ধরণের লেখা লিখেছেন। সমাপ্ত না করলেও ছোটদের জন্য অ্যাডভঞ্চারমূলক উপন্যাস লিখতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁর এই প্রয়াসটি নিঃসন্দেহে অভিনব। ছোটদের পত্রিকা ‘সখা’কে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। এসব নিশ্চয়ই স্মরণীয় কীর্তি, রবীন্দ্রনাথের জীবনীরচনা নিঃসন্দেহে ভুবনমোহন রায়ের অবিস্মরণীয় কীর্তি। তেত্রিশ বছরের রবীন্দ্রনাথ যে একদিন খ্যাতির চুড়োয় পৌঁছবেন, অনেক অনেক সাফল্য তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, তা বুঝতে পেরেছিলেন ভুবনমোহন রায়। তাঁর লেখা রবীন্দ্রজীবনকথার এক ঐতিহাসিকমূল্য রয়েছে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই জীবনকথায় বর্ণিত তথ্য অনুসরণ করেছিলেন, এটা কম বড়ো কথা নয়! না, ভুবনমোহন রায়কে আমরা মনে রাখিনি।

Skip to content