শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


গিরীন্দ্রনাথ।

প্রিন্স দ্বারকানাথের পাঁচ পুত্র। দিগম্বরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল পনেরো বছর বয়েসে। দিগম্বরী নিতান্তই তখন বালিকা। বছর ছয়েক বয়েস। দ্বারকানাথের চোখের সামনেই দিগম্বরী প্রস্ফুটিত হয়েছিলেন। নানাজনের স্মৃতিচারণে আছে, অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন তিনি। বাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মুখ এই সুন্দরীর মুখের আদলে তৈরি করা হত। প্রথমদিকে দ্বারকানাথ ও দিগম্বরীর জীবনে তেমন কোনও সমস্যা ছিল না। পরে তাঁদের দাম্পত্য-সম্পর্কে ফাটল ধরে। দ্বারকানাথের মদ্যপান, নাচগান ও বিলাস-বৈভবের জীবনযাপন দিগম্বরীর অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। দিগম্বরী অবশ্য স্বামীর প্রতি ‘অবশ্যকর্তব্য’ সবই করতেন। নিজেকে ‘পরিশুদ্ধ’ রাখার জন্য তাঁর চেষ্টার শেষ ছিল না। ক্ষিতীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘শুনিতে পারি যে, যতবার তিনি দ্বারকানাথের সহিত কথা কহিতে বাধ্য হইতেন, ততবারই সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করিয়া নিজেকে পরিশুদ্ধ বোধ করিতেন।’ সে অন্য প্রসঙ্গ।
দ্বারকানাথ-দিগম্বরীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দেবেন্দ্রনাথ। চতুর্থ সন্তান গিরীন্দ্রনাথ। গিরীন্দ্রনাথ বৈষয়িক ব্যাপারে খানিক সচেতন-সতর্ক থাকলেও মানসিক প্রশান্তির জন্য, আনন্দলাভের জন্য ফি-রোববার বেরিয়ে পড়তেন জলবিহারে। মাঝারি সাইজের এক বজরা, ‘ভিতরে সব সিল্কের গদি, সিল্কের পর্দা, চারদিকে আরামের চূড়ান্ত’, সেখানে বসে ছবি আঁকতেন তিনি। নানা গুণ ছিল তাঁর। গিরীন্দ্রনাথ শৌখিন যাত্রাদলের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ‘বাবুবিলাস’ নামে একটি নাটকও লিখেছিলেন। তাঁর পুত্র গুণেন্দ্রনাথ পিতার বিবিধ গুণাবলির অধিকারী হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম

গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের পিতৃদেব গুণেন্দ্রনাথও ভালো ছবি আঁকতেন। কিছুদিন আর্ট স্কুলে পড়েও ছিলেন। আর্ট স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন জেঠতুতো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। দু-জনের মধ্যে ছিল অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব। একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’। এই নাট্যশালায় রামনারায়ণ তর্করত্ন, মধুসূদন ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক অভিনীত হয়েছে। বাড়ির মেয়েদের দিয়ে নাটক করানোর ক্ষেত্রেও গুণেন্দ্রনাথ বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গুণুদাদা’কে খুবই পছন্দ করতেন।

চিন্তায় চেতনায় প্রগতিশীল এই শিল্পী-মানুষটি অত্যধিক মদ্যপান করতেন। মদই তাঁকে খেয়েছিল। মদ্যপানের কারণেই মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়েসে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।

গুণেন্দ্রনাথ।

গুণেন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত সহৃদয়। বড়ো মনের মানুষ। কারও দুঃখ- যন্ত্রণা সইতে পারতেন না। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। জ্যেতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ নামে‌ একটি আত্মজীবনী আছে। বইটি অবশ্য তিনি নিজে লেখেননি। মুখে মুখে নিজের জীবনের কথা শুনিয়েছেন বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। বসন্তকুমার লিখে রেখেছিলেন। সে বইতে আছে ‘দয়া ও আশ্রিত-বাৎসল্যের একটা গল্প।’ বসন্তকুমারকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, আমাদের একজন দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় ঋণগ্রস্ত হইয়া গুণুদাদার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।’ মানুষটি গুণেন্দ্রনাথের বাড়িতে থাকতেন। তাঁকে শুধু আশ্রয় দেননি তিনি, তাঁর যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সুবিধা-অসুবিধার দিকেও গুণেন্দ্রনাথের নজর ছিল। শুধু তো অতিথি নন, আত্মীয়ও বটে! তার ওপর মানুষটি বিপন্ন। বিপন্নজনের পাশে দাঁড়ানো, সাহায্যের হাত বাড়ানো, এর নামই তো মানবিকতা। গুণেন্দ্রনাথ যে অত্যন্ত মানবিক ছিলেন তাঁর দয়ার শরীর, পরের দুঃখে কাতর হতেন, তেমন দৃষ্টান্ত তাঁর জীবন জুড়ে অনেক অনেক রয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৬: গরমে কক্ষনও ডিম খেতে নেই?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প

এভাবে বিপন্ন মানুষটিকে আশ্রয় দিয়ে, একপ্রকার লুকিয়ে রাখার ফলে পাওনাদাররা তাঁকে খুঁজে পায়নি। তাঁর নামে ওয়ারেন্ট জারি করার সুযোগও পায়নি। গুণেন্দ্রনাথের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়টি অবশ্য কীভাবে পাওনাদারের পাওনা মিটিয়ে দেওয়া যায়, সে চেষ্টা আত্মগোপনে থেকেও করে চলেছিলেন। অচিরে মিটিয়েও দিতেন। চেষ্টা সফল হওয়ার আগেই ধরা পরার উপক্রম হয়। গুণেন্দ্রনাথ না থাকলে চরম গ্লানি তাঁকে সইতে হত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘জনৈক গৃহশত্রু বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া দ্বিপ্রহর রাত্রে তাঁহাকে ধরাইয়া দেয়।’

পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা নিশ্চিত। আত্মীয়টি হোক না দূরসম্পর্কীয়, তাঁর দুর্গতি গুণেন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি। মনে হয়েছে এ যেন তাঁর নিজেরই বিপন্নতা, আকস্মিক সমূহ সংকট। হাঁফাতে হাঁফাতে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

রাতদুপুরে হঠাৎ গুণেন্দ্রনাথের আগমনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথমে বিস্মিত হয়েছিলেন। পরে ঘটনার ভগ্নাংশ জানার পরই হতবাক হন। গুণেন্দ্রনাথ শুধু তাঁর নিকট আত্মীয় নন। প্রিয় বন্ধুও বটে। গুণেন্দ্রনাথের তাঁর ওপর যে বিরাট ভরসা-নির্ভরতা, তাও অজানা ছিল না। সব শুনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পড়লেন মহাবিপদে। কী করবেন, কোথা থেকে পাবেন এত টাকা! বড়ো দুশ্চিন্তা,খানিক দিশেহারা। কী করবেন, ভেবে কূলকিনারা পেলেন না। ব্যাঙ্ক তো আর এই রাতদুপুরে খোলা নেই।

অত টাকা কোথায় পাওয়া যাবে, এমন প্রশ্ন প্রথমে মনে জাগলেও মুহূর্তে সে সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ভাবনা-দুর্ভাবনার মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে পড়ে যায়, টাকা বাড়িতে না থাকলেও আছে হাটখোলায়। সেখানে দৈনন্দিন খরচের জন্য কিছু টাকা মজুত রাখা রয়েছে। সে টাকার পরিমাণ খুব কম নয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৬: রতনপুর মহামায়া দর্শন

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

হাটখোলায় ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পাটের আড়ৎ। আর দেরি না করে বিশ্বস্ত এক কর্মীকে তখনই পাঠালেন সেখানে।

পাট-আড়তের বন্ধ দরজা খুলিয়ে সব টাকা আনতে পারলে গুণেন্দ্রনাথের আত্মীয়টি বিপন্নতার হাত থেকে যে বাঁচবে, সম্ভ্রম রক্ষা হবে, এমনটি ভেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আশ্বস্ত হলেন।

যে বিশ্বস্ত কর্মীটিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পাঠিয়েছিলেন, সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। হোক না চারদিকে রাতের স্তব্ধতা, ঠিক সমস্ত প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে হাটখোলা থেকে টাকা নিয়ে আসবে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাকে জানেন, তার দায়িত্বশীলতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। চলে অপেক্ষা, প্রতীক্ষা।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি'।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখের দিকে এমন করে গুণেন্দ্রনাথ তাকিয়ে থাকেন যে মনে হয়, বিপন্নতা তাঁর নিজেরই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে ভরসা দিতে থাকেন। গুণেন্দ্রনাথ কোনোরকমে যারা দূরসম্পর্কিত আত্মীয়টিকে গ্রেফতার করতে এসেছিল, তাদের নিরস্ত করেছেন, বলেছেন ‘টাকা আসছে, একটু অপেক্ষা করুন।’ কোনও কারণে টাকা না আনতে পারলে কী হবে! বিপদের কালো মেঘ ছেয়ে যায় গুণেন্দ্রনাথের চোখে মুখে।

অবশেষে সেই অপেক্ষার, প্রহর গোনার শেষ হয়। রাতের অন্ধকার ভেদ করে টাকার পুঁটুলি নিয়ে এসে হাজির হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সেই বিশ্বস্ত কর্মীটি। তাকে দেখে গুণেন্দ্রনাথের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সেই হাসি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দূরসম্পর্কিত আত্মীয়টির মুখেও। কালো মুখে আলো জ্বলে ওঠে। সব চিন্তা মুহূর্তে মুছে গিয়ে তাঁর আঁধার মুখ ঝলমলিয়ে ওঠে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখেও পরিতৃপ্তির হাসি। গুণেন্দ্রনাথ তাঁর নিকট আত্মীয়, আবার প্রিয় বন্ধু। তাঁর গুণের শেষ নেই, বড়ো ভালো মানুষ তিনি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চোখে মুখে তাই খুশির রং লাগে।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content