বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রকিশোর।

কলকাতায় তখন প্রবল প্লেগ। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। বড়োদের পাশাপাশি ছোটোরাও হচ্ছে প্লেগ-কবলিত। প্লেগে, ম্যালেরিয়ায় বা কলেরায় প্রতি বছরই বহু মানুষ মারা যেত। সে বছর প্লেগ ছড়িয়ে ছিল একটু বেশি রকম। প্লেগের এই ছড়িয়ে পড়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কতখানি চিন্তিত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, তা একটি ঘটনার কথা বললেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্লেগ নিয়ে কবির দুশ্চিন্তা শুধু নয়, ছোটোদের প্রতি তাঁর কত গভীর ভালোবাসা ছিল, সে সম্পর্কেও ধারণা করা যাবে।
উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর বইয়ের প্রুফ দেখে দিয়েছেন, প্রয়োজনে লেখার সংশোধন করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে পায়ে পায়ে প্রায়শই পৌঁছে যেতেন মানিকতলার অদূরে সুকিয়া স্ট্রিটে, উপেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ গান গাইতেন। উপেন্দ্রকিশোর বাজাতেন বেহালা। কোথা দিয়ে সময় কেটে যেত। এরকমই একদিন জমিয়ে গল্পগাছার পর ফেরার পথে রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন, আরেক বন্ধু আচার্য জগদীশচন্দ্র কাছেই থাকেন। তাঁর সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন।‌ সবে একটু এগিয়েছেন, হঠাৎই নজরে আসে, পথের ধারে একটা মরা ইঁদুর পড়ে রয়েছে। সামনে কয়েকজন বালক-বালিকা মনের আনন্দে খেলছে। ইঁদুর দেখে রবীন্দ্রনাথ আঁতকে উঠলেন। ইঁদুরই তো প্লেগ রোগের জীবাণু বহন করে। মনের আনন্দে ফুটফুটে উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা খেলছে, তাদের যদি বিপদ হয়, আক্রান্ত হয়ে পড়ে, এই ভেবে কবি আবার উপেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে ফেরত গেলেন। দরজায়‌ কড়া নাড়লেন। উপেন্দ্রকিশোর হতবাক। আতঙ্কিত গলায় রবীন্দ্রনাথ জানালেন তাঁর এই ফিরে আসার কারণ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

সব শুনে উপেন্দ্রকিশোরও উদ্বিগ্ন হয়েছেন। কেরোসিন জোগাড় করে চাকরবাকরদের ডেকে দ্রুত পায়ে সেখানে পৌঁছেছেন। কেরোসিন ঢেলে মরা ইঁদুরটাকে পোড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের এই উদ্বিগ্নতার বাস্তব কারণও ছিল। প্লেগের বীভৎসতা স্বচক্ষে দেখেছিলেন‌ তিনি। পরিবারের বাইরে দেখেছেন, পরিবারেও দেখেছেন। স্বভাবতই প্লেগ নিয়ে কবির মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ছিল সুগভীর দুর্বলতা। অত্যন্ত স্নেহ করতেন, খুব ভালোবাসতেন তাঁকে। সেই অবনীন্দ্রনাথের জীবনে মহাবিপর্যয় নিয়ে এসেছিল এই প্লেগ। প্লেগে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর কন্যা শোভার। শোভা অবনীন্দ্রনাথের তৃতীয় সন্তান, দ্বিতীয় কন্যা।

প্লেগ-কবলিত কলকাতা শহরের তখন ভয়ংকর পরিস্থিতি। গগনেন্দ্রনাথের কন্যা পূর্ণিমা দেবীর লেখায় আছে, ‘…কিছুদিন পরে কলকাতায় খুব প্লেগের হুড়ো চলে। সকলেই ভয়ে ভয়ে থাকত। যার হত সে আর বাঁচত না। সিঙ্গিবাগানের বস্তি থেকে অনবরত মড়া যাচ্ছে। তখন বড় বড় ইঁদুর দেখলেই জমাদাররা মারছে। ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হচ্ছে চারদিকে। প্লেগের তখনও কোনো ওষুধ বের হয়নি।’ প্লেগ-কবলিত কলকাতার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা ধরা আছে অবনীন্দ্রনাথের ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইটিতেও। প্লেগ প্রতিহত করতে পথে নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে ছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সেই সময় কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এ বাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেকশনে যেতেন। নার্স, ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল।’

নিবেদিতা।

প্লেগ রেহাই দিল না ঠাকুরবাড়িকে। অবনীন্দ্রনাথের ফুটফুটে মেয়েটি, ন-দশ বছরের বেশি তার তখন বয়স নয়, হঠাৎই সে আক্রান্ত হল। জ্বর এলো, পা ফুলে উঠল। বাড়িতে ডাক্তার এলেন। সব দেখে বললেন, ‘এ ঘরে কেউ যেন না আসে। ছোট ছেলেমেয়েদের অন্য কোথাও সরিয়ে দিন।’ রবীন্দ্রনাথ ডাক্তারের পরামর্শ জানামাত্র তাদের সবার জন্য লাল বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ছোটোরা থাকত। তাদের মায়েরা সেখানেই স্নান করিয়ে দিয়ে আসতেন, খাবার দিয়ে আসতেন।

শোভাকে ঘিরে চলে কত উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা। সব চিকিৎসা, সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবনীন্দ্রনাথের মা সৌদামিনী দেবী শোভা সম্পর্কে আবেগে উচ্ছ্বাসে প্রায়ই বলতেন, ‘এই মেয়েটিই অবনের সবচেয়ে সুন্দর।’ সেই সুন্দর মেয়েটি যে বেঘোরে অসময়ে চলে যাবে, তা কে জানত! কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই আকস্মিক জোড়াসাঁকোয় ঘটে যায় মহাবিপর্যয়। ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটির মৃত্যু হয়। স্বভাবতই এই মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেনি। জোড়াসাঁকোয় শুধুই স্তব্ধতা। কারও মুখে কথা নেই, বাকরুদ্ধ। কেউ-বা নীরবে চোখের জল মুছতে থাকেন।‌ গোটা বাড়িতে থমথমে স্তব্ধতা। শুধুই শূন্যতা।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০: তত্ত্বতালাশ

সেই শূন্যতা স্বভাবতই অবনীন্দ্রনাথকে গ্রাস করে। সেই চরম বিপর্যয়ের কথা তিনি এভাবে শুনিয়েছেন, ‘হবি তো হ, সেই প্লেগ এসে ঢুকল আমারই ঘরে। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ফুলের মত মেয়েটি ছিল বড়ো আদরের।… ন’-দশ বছরের মেয়েটি আমার টুক করে চলে গেল; বুকটা ভেঙে গেল।’ অবনীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা উমা দেবী ‘বাবার কথা’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। সে বইতে আছে, অবনীন্দ্রনাথ কতখানি ভেঙে পড়েছিলেন, সেই কথা। তাঁর লেখায় রয়েছে শোকের তীব্রতা, হাহাকারের ব্যাপ্তি, বিস্তৃতি। উমা লিখেছেন, ‘সেই মারীর হাওয়া লাগলো আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ফুলের মতো আমার ছোট্ট বোনটিকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল আমাদের সংসার-বাগান থেকে।’

অবনীন্দ্রনাথ।

সব কিছু ভেঙেচুরে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। মা সুহাসিনীকে সামাল দেওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে। চারপাশে ছোট্ট শোভার কত স্মৃতি। ছাড়তে হয় স্মৃতি দিয়ে ঘেরা জোড়াসাঁকোও। কোথায় গেলে একটু শোক ভুলে থাকা যাবে, হাজার স্মৃতি আর কু্রে কুরে খাবে না, তারই চেষ্টা চলে। ডাক্তারবাবু পরামর্শ দেন, ছোঁয়াচে রোগ। জীবাণুর যাতে বিনাশ হয়, তাই ঘরদোর চুনকাম করাতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ মতো অবনীন্দ্রনাথের পরিবার, তাঁর দাদার পরিবারের সবারই পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ির প্রদ্যোতকুমারের বরানগরের বাড়িতে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা হয়। সেখানে গিয়েও শোকযন্ত্রণা ভোলা যায়নি। সুহাসিনী দেবীকে সামাল দেওয়ার জন্য অবনীন্দ্রনাথ অনেক পাখি কিনে আনতেন। টিয়া-চন্দনা-ময়না কত রকমের পাখি। তাদের মসুরডাল সেদ্ধ আর ছাতু খাইয়ে চলে বড়ো করে তোলার চেষ্টা। সেবায়, পরিচর্যায় পাখিদের বড়ো করে তুলতেন অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী সুহাসিনী। পাখিছানারা বড়ো হয়ে ওঠার পর তাদের খাঁচায় না রেখে দেওয়া হত ছেড়ে। উমা দেবী তাঁর পিতৃদেবের গভীর শোকযন্ত্রণা ও মনোবেদনার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মায়ের মন তখন খুব খারাপ। বরানগরে গিয়ে মায়ের মনকে অন্য কাজে ভুলিয়ে রাখবার জন্য বাবা তাঁকে অনেক রকম পাখি কিনে দিতেন।… কোন পাখির অসুখ করলে বই দেখে তাকে ওষুধ খাওয়াতেন। তার যদি মৃত্যুর লক্ষণ দেখা যেত, তিনি শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে বসে থাকতেন স্থিরভাবে। আমার মনে হয় এই পাখির মৃত্যুর ভিতর দিয়ে নিজের মেয়ের মৃত্যুকে সহজ করে নিতেন মনের মধ্যে —কন্যার শোকের খানিকটা বোধহয় পাখির দিকে চলে যেত।’
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৫: সারদা দাদার থেকে চিল্পিঘাটি

অবাধ অ্যান্টিবায়োটিক ডেকে আনছে বড় বিপদ, সতর্ক হন এখনই

শাকুন্তলম্: প্রেমের পরবশ থেকে মাতৃত্বের উত্তরণ

শোকস্তব্ধ অবনীন্দ্রনাথ এসময় ছবি আঁকতে একেবারেই পারছিলেন না।‌ বেদনায়, বিষাদে কোনওরকমে তাঁর দিন কাটত। দিল্লিতে এক্সিবিশন হবে। হ্যাভেলসাহেব বললেন, সেই এক্সিবিশনে ছবি পাঠাতে হবে। যে সম্পর্ক, তাতে সাহেবের অনুরোধ উপেক্ষা করা যায় না। অবনীন্দ্রনাথ পড়লেন মহাসংকটে। কবি জসীমউদ্দিন তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন। ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। বইতে আছে, অবনীন্দ্রনাথের বিপন্নতার কথা। জসীমউদ্দীনকে তিনি বলেছিলেন, ‘রং-তুলি নিয়ে আঁকতে আরম্ভ করলাম। আমার মেয়ের মৃত্যুজনিত সমস্ত শোক আমার তুলিতে রঙিন হয়ে উঠল।’ ‘অন্তিম শয্যায় সাজাহান’ নামে যে ছবি তিনি এঁকেছিলেন, তা নিজের বোধের সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে ওঠায় বড়োই মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছিল। অন্তরের বেদনা ছবিটির পরতে পরতে, সেই বেদনা দর্শক-মনকেও সহজে ছুঁয়ে যায়। অয়েল পেইন্টিংয়ে আঁকা এই ছবিটি প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের কন্যা উমা লিখেছেন, ‘নিজের অন্তরের সমস্ত বেদনা, বিয়োগ-ব্যথা ঢেলে দিয়েছিলেন ছবিখানিতে, তাই অতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল ছবিখানি।’

উমা‌ দেবী।

দিল্লির দরবারে শুধু অংশগ্রহণ নয়, এই ছবিটি পেয়েছিল স্বর্ণপদক। অবনীন্দ্রনাথ পদক-লাভের সংবাদ মাকে জানাতে তাঁর চোখ আনন্দ-অশ্রুতে ভরে উঠেছিল। বলেছিলেন, ‘আমার সেই ছোট্ট ছেলে অবন, কত কালি-ঝুলি রং মেখে কাপড় নোংরা করত। কত বকেছি তার জন্য। সেই রং আজ সোনা হয়ে আসবে, কে জানত।’

কন্যার মৃত্যু-বেদনায় শোকদগ্ধ, অশ্রুসিক্ত অবনীন্দ্রনাথ যে সৃষ্টির ফুল ফুটিয়েছিলেন, সত্যিই তা ভিন্নতর মাত্রা পেয়েছিল।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content