শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ।

সাঁতারে দক্ষতা ছিল, অতীব পারদর্শী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। খুব ভালো সাঁতার কাটতেন তিনি। কবিকন্যা মীরা দেবীর লেখায় আছে, ‘সাঁতরে নদী পার হতে পারতেন।’ কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁকে গোরাই নদী এপার-ওপার করতে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ নদীতে সাঁতার কাটতে নেমেছেন, কবির ‘গৌরবর্ণ পিঠটি’ শুধু জলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সে দৃশ্য মীরার পরে বারবার মনে পড়েছে। তাঁর লেখায় বাবার সেই সাঁতার-কাটার প্রসঙ্গটি এসেছে এভাবে, ‘যখন নদীতে স্নান করতে নামতেন, শুধু তাঁর গৌরবর্ণ পিঠটি জলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সেই কথা মনে পড়ে। তিনি ভালো সাঁতার জানতেন বলে ঝড়ের সময় বোটে থাকতেও ভয় পেতেন না।’
পুত্রকে শেখালেও কবি তাঁর দুই কন্যাকে অবশ্য সাঁতার‌-কাটা শেখাতে পারেননি। শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের দিদিমাকেও। মীরা লিখেছেন, ‘দিদিমাকে কোনরকমে ডুব দিতে শিখিয়েছিলেন।’

সাঁতার শেখানোর ভিন্নতর পদ্ধতি ছিল রবীন্দ্রনাথের। কী আশ্চর্য দক্ষতা ছিল তাঁর সাঁতার কাটায়! সেদিনও পদ্মায় বোটে করে সপরিবারে ঘুরছিলেন কবি। হঠাৎই ‘ঝুপ’ করে শব্দ। বোটে যাঁরা কবির সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা তো বটেই, আশপাশের নৌকোর মাঝিমাল্লারাও হতবাক। কী হল, আতঙ্কের কালো ছায়া পড়ে সবার চোখে মুখে! ঘোর কাটার আগেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আরে, কবিই তো ঝাঁপ দিলেন জলে!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৯: দ্রৌপদীর জন্য স্বর্গীয় ফুলের খোঁজে ভীমসেন কোনও পথে পাড়ি দিলেন!

হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ এভাবে নদীতে ঝাঁপ দিলেন কেন! বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ঝাঁপ-রহস্য! কবির পায়ের চটি পড়ে গিয়েছিল নদীতে। সেই চটি উদ্ধারের জন্যই এভাবে তিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন নদীতে। খানিক পরেই চটি নিয়ে পাড়ে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জবজপে, সবসপে কবিকে দেখে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। পড়ে স্বস্তির নিশ্বাস।

রথীন্দ্রনাথকে কবি নিজেই সাঁতার শিখিয়েছেন। সাঁতার শেখানোর পদ্ধতি ছিল অভিনব, অতি সহজ। রবীন্দ্রনাথ কোনও ঝুটঝামেলায়, জটিলতায় না গিয়ে নৌকো থেকে একদিন জলে ফেলে দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথকে। জলে পড়ে খানিক হাবুডুবু খেয়েছিলেন বটে, এলোমেলো হাত-পা ছোঁড়া- ছুঁড়ি করতে করতে একদিনেই সাঁতার শেখা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সে কথা তিনি লিখেছেন ‘পিতৃস্মৃতি’ বইতে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

রবীন্দ্রনাথ শুধু সাঁতার কাটতে উৎসাহিত করেননি রথীন্দ্রনাথকে। মীরা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, ছেলেবেলায় রথীন্দ্রনাথ খুবই রোগাভোগা ছিলেন। সে প্রসঙ্গে কবিকন্যা জানিয়েছেন, ‘দাদার শরীর যাতে বলিষ্ঠ হয় সেইজন্যে বাবা তাঁকে নানারকম ব্যায়াম, সাঁতার কাটা, দাঁড় টানা ইত্যাদি করিয়েছিলেন। ফলে দাদার শরীর ফিরে গেল।’ স্বাস্থ্য-উদ্ধার হওয়ায় শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয়ের অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের মতো নিজের থালা-বাটি মাজতে, ঘর ঝাঁট দিতে বা কুঁয়ো থেকে জল তুলতে, কোনও কাজেই আর কবিপুত্রের অসুবিধা হয়নি। অন্য ছাত্রদের মতো রথীন্দ্রনাথও সব কাজ করতেন নিজের হাতে। সে বিবরণও আছে মীরা দেবীর স্মৃতিচারণে।

রথীন্দ্রনাথ।

রথীন্দ্রনাথ বাল্য-কৈশোরে রকমারি খেলায় মজে থাকতেন। খেলার আনন্দে তাঁর ছেলেবেলার দিনগুলি বর্ণময় হয়ে উঠেছিল। কত রকমের, কত ধরনের খেলা। লাঠি-সড়কির খেলা, ঘোড়ায় চড়া—সেও ছিল এক খেলা। ঘোড়ায় চড়তে ভীষণ ভালো লাগতো রথীন্দ্রনাথের। সাঁতার জানতেন বলে জলের প্রতি বাড়তি আগ্রহ, ভালো-লাগা ছিল। কবিপুত্র জলের ধারে বসে মাছ ধরতেন। আবার কখনও বা আপন খেয়ালে জলে জলে ঘুরে বেড়াতেন। ছোট্ট একটি ডিঙিনৌকো ছিল তাঁর। মা মৃণালিনী দেবীই পরোক্ষে সে নৌকো কিনে দিয়েছিলেন। প্রতিমাসে পুত্রকে পাঁচ টাকা করে দিতেন তিনি। হাতখরচা, এই টাকায় শ্রীমান যা কিছু করবে, যা কিছু খাবে, এমনই‌ ভেবে মা মাসে মাসে পাঁচ টাকা দিতেন তাঁকে। অন্য কিছু না কিনে সেই টাকা জমিয়ে রথীন্দ্রনাথ নৌকো কিনেছিলেন। আহা, কী আনন্দ, জলে জলে যত খুশি ঘোরো! নদীতে আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়াতেন রথীন্দ্রনাথ। সাঁতার জানতেন বলে কোনও ভয়ডর ছিল না। ছোটো ছেলে একা-একা নদীতে ঘুরে বেড়াবে, মা মৃণালিনী মেনে নিতে পারতেন না। যদি কোনও বিপদ-আপদ ঘটে, এসব ভেবে বকাঝকা দিতেন, এভাবে ঘুরে বেড়াতে বাধা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কখনও রথীন্দ্রনাথের এই সাঁতার কাটায় বা জলবিহারে বাধা দেননি। কবি নিজেও তো জল ভালোবাসতেন। নদীতে নদীতে ঘুরে বেড়াতেন। জলবিহারের জন্য ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব দু-টি বজরা ছিল। সেই বোটেই রবীন্দ্রনাথ পদ্মায় ঘুরতেন। ঘুরতেন শিলাইদহে, এ নদীতে, সে নদীতে।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: রোজকার খাবার একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে? বাড়িতে সহজেই বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালং পনির

আমার উড়ান: শোনো এক মাটির মেয়ের গল্প তবে…

বজরা দু-টি ছিল একেবারে বাড়ির মতন। শোওয়া-থাকার সুন্দর ব্যবস্থা। লেখাপড়ার কাজ চালাতেও কবিকে বেগ পেতে হত না। দিনের আলো নিভে এলে, সন্ধ্যের দিকে পদ্মাবোটের ছাদে বসত গানের আসর। রবীন্দ্রনাথ গাইতেন, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা।’ সঙ্গে কখনও থেকেছেন অমলা দাশ। তিনি গাইতেন, ‘চিরসখা মোরে ছেড়ো না।’

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভগ্নী অমলা ছিলেন মৃণালিনীর প্রিয়বান্ধবী। প্রায় পরিবারভুক্ত, শিলাইদহ যাত্রাকালে এই সহচরীটি কখনও কখনও মৃণালিনীর সঙ্গী হতেন। তাঁর উপস্থিতিতে শিলাইদহ-বাস আরও আনন্দমুখর হয়ে উঠত। রবীন্দ্রনাথও অমলাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কবির গান মহিলা-শিল্পীদের মধ্যে তিনিই প্রথম রেকর্ড করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান পছন্দ করতেন। তাঁর ওপর নির্ভরতা ছিল, তাই রেকর্ডে গান করার অনুমোদন দিয়েছিলেন।

মীরা।

রবীন্দ্রনাথ সযত্নে পুত্রকে গড়েছিলেন। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। একবার শিলাইদহে গুলতি দিয়ে পাখি মারায়, রথীন্দ্রনাথ পিতৃদেবের কাছে খুব বকা খেয়েছিলেন। জমিদারির মধ্যে কেউ কক্ষনো পাখি মারতে পারবে না, এমন আদেশও জারি করেছিলেন কবি।

শিলাইদহে বাসকালে প্রতি সপ্তাহে শনিবার কবি-বন্ধু আচার্য জগদীশচন্দ্র চলে আসতেন। তিনি কচ্ছপের ডিম খেতে ভালোবাসতেন। পিতৃবন্ধু এলে রথীন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়তেন কচ্ছপের ডিম খুঁজতে। নদীর চরায় বালি সরিয়ে গর্তের মধ্যে পেড়ে যাওয়া ডিম খোঁজা সহজ নয়। শেয়ালে যাতে সন্ধান না পায়, সে কারণে কচ্ছপরাই এভাবে ডিম পেড়ে রেখে যেত। রথীন্দ্রনাথ সে ডিম জগদীশচন্দ্রের জন্য ঠিক খুঁজে আনতেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১১: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’ একটি ছবি তুলতে না তুলতেই হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

প্রকৃতিকে রথীন্দ্রনাথ কতখানি ভালোবেসে ফেলেছিলেন, তার দৃষ্টান্ত আছে ইন্দিরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে। পুত্রের এই প্রকৃতিপ্রীতি রবীন্দ্রনাথকে আপ্লুত করেছিল। রথীন্দ্রনাথের বছর চারেক বয়েস তখন। সেদিন খুব ঝড় উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ‘উত্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের মধ্যে তাঁর ক্ষুদ্র অপরিণত নাসিকাটি প্রবেশ করিয়ে নিস্তব্ধভাবে ওই ঝড়ের আঘ্রাণ এবং আস্বাদ গ্রহণে নিযুক্ত আছেন।’ ঝড়ের পর নামে বৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ পুত্রকে বলেছিলেন, ‘খোকা তোর গায়ে জলের ছাট লাগবে। এইখানে এসে চৌকিতে বোস্।’ এরপর তিনি যা দেখলেন, তা অভূতপূর্ব, মন ভরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কবি আনন্দময় সেই অনুভূতির কথা লিখেছেন এভাবে, ‘খোকা তার মাকে ডেকে বললেন, মা তুমি চৌকিতে বোসো — আমি তোমার কোলে বসি’, বলে মায়ের কোল অধিকার করে নীরবে বর্ষাদৃশ্য সম্ভোগ করতে লাগল।’

কবির বজরা।

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন

নদী, গাছপালা আর পাখপাখালির শিলাইদহে রথীন্দ্রনাথকে মনের মতো করে গড়তে পেরেছিলেন কবি। রবীন্দ্রনাথ মোটেই সংসার-পলাতক ছিলেন না। সংসারের মধ্যে থেকেই মগ্ন হয়েছিলেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। রবীন্দ্রনাথের দায়িত্ব-পরায়ণতার, কর্তব্যনিষ্ঠার সত্যিই কোনও তুলনা হয় না।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content