রবীন্দ্রনাথ।
নিজের লেখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের খুঁতখুঁতুনি ছিল। কিছুতেই পছন্দ হত না। কাটাকুটি করতে করতে প্রায়শই ছবি হয়ে যেত। এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার সূত্রপাত। রবীন্দ্রনাথের পৌত্র অসিতকুমার একবার দেখেছিলেন জোড়াসাঁকোয় তেতলার ঘরে বসে কবি লিখছেন আর ছিঁড়ছেন। কবিতা-গল্প নয়, রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন একটি চিঠি। লেখার পরে কেন ছিঁড়ে ফেলছেন, সে প্রশ্নের উত্তরে কবি জানিয়েছিলেন, ‘কেন জানি না লাগসই ইংরাজি আসচে না রে —একটি ইংরাজ বন্ধুকে চিঠি লিখতে হবে।’ এমনতরো অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথের লেগেই থাকত। যা লিখতেন, তা পছন্দ হত না। আবার নতুন করে শুরু করতেন। রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথের পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ একবার দেখেছিলেন, যেখানে বসে কবি লেখেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের একই রচনার অজস্র নকল অযত্নে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গুণে দেখেছিলেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ, সব মিলিয়ে চল্লিশটি। কেন এই কাটাকুটি, নকলের পুনরাবৃত্তি—প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, ‘মনোমত শব্দ’ না পাওয়ায় বারবার নকল করে চলেছেন, শব্দ বদল করছেন। যতক্ষণ না পছন্দ হচ্ছে, এভাবেই করে যেতে হবে জানিয়ে কবি তাঁর নিখাদ নিষ্ঠারই পরিচয় দিয়েছিলেন।
টুকরো কাগজে নয়, রবীন্দ্রনাথ বেশিরভাগ সময়ই লিখতেন খাতায়, ডায়রিতে, নোটবুকে ও রাইটিং প্যাডে। একটি খাতায় পেনসিলে লিখেছিলেন ‘বলাকা’র প্রায় সব কবিতা। রবীন্দ্রনাথ লিখতেন ফাউন্টেন পেনে। এই কলমেরই তিনি মানানসই প্রতিশব্দ করেছিলেন ‘ঝরনা কলম’। যে কলমে লিখতেন, সে কলমের প্রতি সঙ্গত কারণেই মমতা তৈরি হয়ে যেত। খুব প্রিয়জনকে অবশ্য প্রিয় কলমটি উপহার দিয়েছেন, এমনও ঘটেছে। কবি তাঁকে বলতেন ‘জোনাকি’, তিনি হেমন্তবালা। হেমন্তবালাকে লেখা কবির অজস্র চিঠি রয়েছে। সেসব চিঠিতে লক্ষ করা যায়, গুরুগম্ভীর বিষয়ের অবতারণা, আলোচনা। হেমন্তবালা তাঁর নিজের জন্য নয়, কন্যার জন্য কবির ব্যবহৃত একটি কলম চেয়েছিলেন। না, চেয়ে নিরাশ হননি। প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির স্নেহের দান সেই কলমটি প্রসঙ্গে হেমন্তবালা জানিয়েছেন, ‘ওই কলমে তাঁর অনেক রচনা লিখেছেন। তবে এখনো বেশ ব্যবহারযোগ্য আছে…।’
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির
লেখার চাপ লেগেই থাকত রবীন্দ্রনাথের। একটুও সময় অপচয় করতেন না। পদ্মায় বোটে জলবিহার করতে করতেও লিখতেন, আবার, জাহাজে এ দেশ থেকে ও দেশে যাওয়ার পথে প্রায়শই পুরো সময়টারই সদ্ব্যবহার করতেন। এটা-সেটা কত লেখা এভাবে লিখেছেন। লেখার চাপ না থাকলে প্রিয়জনের উদ্দেশে চিঠি লিখতেন। চাপে কত ভালো লেখা তাঁর হয়ে গিয়েছে, চাপ না থাকলে হয়তো লিখতেনই না। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসটি ‘প্রবাসী’-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের চাপেই শেষ পর্যন্ত লেখা হয়েছিল, তা রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন।
কবিপত্নী মৃণালিনী।
সম্পাদকের দাবি মেটাতে গিয়ে নিজের শরীরের দিকে ফিরেও তাকাতেন না। ফিরে তাকানোর ফুরসতই বা পেতেন কোথায়! ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতেন না। শরীরের উপর অত্যাচার, শরীরও প্রতিশোধ নিত কখনও। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না, লেখায় থাকতেন ডুবে। ‘চিরকুমার সভা’ লেখার সময় এমনই এক কাণ্ড হয়েছিল। এক বেলা খেয়ে, রাত-দিন লিখে দ্রুত শেষ করেছিলেন নাটকটি। শরীরের প্রতি উদাসীনতার খেসারত দিতে হয় অচিরেই। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, ‘সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন।’ কবিপত্নী মৃণালিনী সারাক্ষণই পতিদেবতার দিকে নজর রাখতেন, নানাভাবে সাহায্য করতেন। নিজের প্রতি তাঁর এই উদাসীনতা, না খাওয়া মৃণালিনীকে প্রচণ্ড বিচলিত করেছিল। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন তিনি। সেই উদ্বিগ্নতায় ক্ষোভও মিশেছিল। বলেছিলেন, ‘কাঙ্গালের কথা বাসি হলে খাটে।’
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪: অপবাদ এবং রামচন্দ্রের সুশাসনের রামরাজত্ব
খাই খাই: সন্ধেবেলা খিদে পেলে শুধুই মুড়ি মাখা? স্বাদ বদলে মুড়ি দিয়েই তৈরি করে ফেলুন এই ৩ মুখরোচক নাস্তা
দশভুজা: এগারো রকমের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে, একাত্তরেও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান
রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা নিজেই কপি করতেন। জীবন-সায়াহ্নে অবশ্য অন্য কেউ কপি করে দিয়েছেন। একেবারেই যখন অপারগ, তখন বলতেন মুখে মুখে। নিজের কলমে নিজে লিখে যে পরিতৃপ্তি তা তো অন্যভাবে হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বলতেন ‘মামণি’। মৃত্যু তখন দরজায়, অপারেশনের আধ ঘণ্টা আগে রানী চন্দকে দিয়ে মামণির উদ্দেশে একটি চিঠি লিখিয়েছিলেন। প্রতিমা দেবীর লেখা ‘নির্বাণ’ বইতে চিঠিটি গ্রন্থিত হয়েছে। প্রতিমা জানিয়েছেন, ‘এই চিঠিতে শুনলুম তাঁর কলম শেষ সহি রেখে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়েছে।’ ঠিক ‘সহি’ করেননি, কাঁপা কাঁপা হাতে লিখেছিলেন একটি শব্দ, ‘বাবামশায়’। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমাকে নিজের হাতে লিখতে পারিনে বলে, কিছুতে লিখতে রুচি হয় না।’ নিজের হাতে নিজের কলমে লিখেই বেশি পরিতৃপ্ত হতেন রবীন্দ্রনাথ।
কবির শেষ চিঠি, যে চিঠিতে কোনো রকমে লিখেছিলেন 'বাবামশায়'।
রকমারি দায়দায়িত্ব। ব্যস্ততার শেষ ছিল না। সেসব মিটিয়ে সারাক্ষণই তিনি লেখায় ব্যস্ত থাকতেন। সাক্ষাৎ প্রার্থীরা আসতেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে হত। তরুণ লেখকদের রবীন্দ্রনাথ উপেক্ষা করতেন না কখনও। সাদরে আদরে তাঁদের স্বাগত জানাতেন। তাঁরা কেউ বই দিলে পড়ে মতামত জানাতেন। সাক্ষাৎ করতে শান্তিনিকেতনে বা জোড়াসাঁকোয় উপস্থিত হলে লেখার কাজ থামিয়েও তাঁদের সঙ্গে গল্পগাছা করতেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বয়েসের ভারে খানিক কাবু হয়ে পড়েছেন। আশির কাছাকাছি বয়েস। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। যিনি ‘বনফুল’ নামে লেখক হিসেবে সুপরিচিত। কবির আমন্ত্রণে তাঁর যাওয়া, গিয়ে দেখলেন উত্তরায়ণের এক ঘরে টেবিলে ভীষণ রকম ঝুঁকে রবীন্দ্রনাথ লিখেই চলেছেন। কেউ এলে সাক্ষাৎপ্রার্থীকে বলছেন, ‘বসো, আমার এখনই হয়ে যাবে।’ বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ খুব কষ্ট করে টেবিলের ওপর ঝুঁকে লিখছেন, দেখে বলাইচাঁদের মনে বেদনার উদ্রেক হল। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত ঝুঁকে লিখতে আপনার কষ্ট হচ্ছে না?’ পরামর্শ দিলেন আরামপ্রদ কোন চেয়ার কেনার জন্য। জানালেন, এখন নানারকম চেয়ার পাওয়া যায়, তেমন এক চেয়ার পেলে এত কষ্ট করে লিখতে হবে না। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সব রকম চেয়ারই আমার আছে, কিন্তু ঝুঁকে না লিখলে লেখা বেরোয় না।’ তারপর দিয়েছিলেন এক মোক্ষম যুক্তি, ‘কুঁজোর জল কমে গেছে তাই উপুড় করতে হয়।’
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন
শুধু কি লেখা, লেখার সঙ্গে ছিল পড়া। সুধীরচন্দ্র কর ‘কবিকথা’ নামে একটি বই লিখেছেন। আশ্রমে কবিকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে এ বই। জানা যায়, কবি মূলত সকালের দিকে লিখতেন। টানা অনেকটা সময়, অন্তত দশটা পর্যন্ত লেখার পর দুপুরের দিকে তেমন চাপ না থাকলে বই পড়তেন। শান্তিনিকেতনে খবরের কাগজ আসত বারোটায়। খাওয়া-দাওয়ার পর আরামকেদারায় কবি কাগজ নিয়ে বসতেন। মিনিট পাঁচেক চোখ বুলিয়ে কাগজ রেখে দিতেন। তারপর বই পড়তেন।
কবির কলম।
লেখা চাইলে দেওয়ার ব্যাপারে কবি কার্পণ্য করতেন না। হাতে লেখা থাকলে একটির বদলে একাধিক লেখাও দিতেন কখনো। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় এমন বহুবার ঘটেছে। লেখা চেয়ে কেউই প্রায় নিরাশ হতেন না। এমনকি শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের হাতে-লেখা পত্রিকার জন্যও তিনি অকাতরে লেখা দিতেন। ছোটরা ‘হাতেখড়ি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করত। আশ্রমের ছোটোরা গিয়ে গুরুদেবের কাছে একবার ‘হাতেখড়ি’র জন্য লেখা দেওয়ার আবেদন করেছিল। রবীন্দ্রনাথ পরের দিন আসতে বলেছিলেন। লিখে দিয়েছিলেন অনবদ্য কয়েকটি পঙক্তি। লেখাটি ছিল এরকম, ‘লেখার কথা মাথায় যদি জোটে/ লিখতে তখন পারি আমি হয়তো,/কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে/, যা-তা লেখা তেমন সহজ নয়তো।’
যা-তা লেখার কথা কবির কলমে, না, ভাবা যায় না। কত যত্নে, হৃদয় দিয়ে তিনি লিখতেন। যা আমাদের জাগিয়ে রাখে, জীবন রাঙিয়ে তোলে, এখনও পথ দেখায়।
যা-তা লেখার কথা কবির কলমে, না, ভাবা যায় না। কত যত্নে, হৃদয় দিয়ে তিনি লিখতেন। যা আমাদের জাগিয়ে রাখে, জীবন রাঙিয়ে তোলে, এখনও পথ দেখায়।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।