শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ।

দ্বিজেন্দ্রনাথ পশুপাখিদের ভালোবাসতেন। ভালোবেসে তাদের অবশ্য খাঁচায় পুরে রাখেননি। খাবার সময় হলেই তারা গুরুপল্লির ‘নিচুবাংলো’য় ঠিক চলে আসত। প্রতিদিনই এমন ঘটত। গগনেন্দ্রনাথ জাপানি-কুকুর থেকে শুরু করে লাল-নীল মাছ কত কিছুই পুষেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কখনও পশু-পাখিদের খাঁচায় পুরে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। খাঁচায় বন্দি করে তাদের পোষার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনে সকালের দিকে বাগানে বসে বা বাড়ির সামনের চাতালে বসে খোলা হাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিনই চা খেতেন। পাখি সব করে রব, কোথা থেকে কত পাখি এসে ভিড় করত। কবি যেখানে বসে থাকতেন, তার চারপাশে চলত বকম বকম, রকম রকম ডাকাডাকি।
প্রতিদিনই সকালে কবি ছোলা ভেজানো খেতেন, কখনও বা মুগডাল ভেজানো। ভেজানো ডালের সঙ্গে সামান্য আদার কুচি বা আখের গুঁড়। রুটিতে মাখন মাখিয়েও খেতেন কখনোসখনো। প্রাত্যহিক এই জলযোগে মুড়ি তাঁর চাই। মুড়ি ছিল বাধ্যতামূলক। জড়ো হওয়া শালিক-চড়াই-পায়রাদের মুঠো মুঠো মুড়ি দিতেন রবীন্দ্রনাথ। ঘুরে ঘুরে পাখিরা আনন্দ করে মুড়ি খাচ্ছে দেখে কা-কা করে ক’টা কাক এসেও ভিড় করত। ঝাঁপিয়ে পড়ত মুড়ি সংগ্রহের প্রতিযোগিতায়। কাকদের আগমনে কবি খুব খুশি হতেন, তা নয়। একটু রেগেই যেতেন। হুশ-হুশ করে তাদের তাড়িয়ে দিতেন, তা নয়। বলতেন, ‘ও বেচারাদেরও তো কিছু দাবি আছে এই ভোজের সভায়, তাই আর তাড়া দিতে ইচ্ছে করে না।’

রবীন্দ্রনাথ ও নির্মলকুমারী মহলানবিশ।

পোষা ময়ূরও ছিল। খাঁচায় রাখা থাকত। সকালবেলা অবশ্য নিয়ম করে বের করা হত। খাঁচায় মোটেও ভালো লাগত না। যে ভৃত্যটি ছাড়ার পর আবার খাঁচায় রেখে দিত, তাকে দেখলেই ময়ূরটি ভয়ে কেমন শিউরে উঠত! ভয় পেয়ে রবীন্দ্রনাথের চেয়ারের পেছনদিকে গিয়ে আশ্রয় নিত। কবির চেয়ারের পেছনে পৌঁছে ভৃত্যটির দিকে তাকিয়ে এমন মুখের ভাব করত, মনে হত যেন বলছে, ‘ধরো দেখি এবার কেমন করে ধরবে?’ জানত সে, কবিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা পরম নিশ্চিন্তের। কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৮: ড. হীরালাল চৌধুরীর আবিষ্কার আজও পোনামাছ চাষীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ

রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ছিলেন কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন। তাঁর স্ত্রী নির্মলকুমারীকেও রবীন্দ্রনাথ খুব স্নেহ করতেন। বেলা-শেষের কবিজীবন নিয়ে তিনি মর্মস্পর্শী একটি বই লিখেছিলেন। সে বইয়ের নাম ‘বাইশে শ্রাবণ’। নির্মলকুমারীর লেখায় আছে, ময়ূর ধরতে আসা ভৃত্যটিকে কবি বলতেন, ‘রেহাই দে বাবু তোরা পাখিটাকে, ও কেমন নিজের মনে ঘুরে ফিরে বেড়ায়, আমার দেখতে ভালো লাগে। কেন তোরা বেচারাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াস?’ একদিন কবি ভৃত্যটিকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে নির্দেশ দিয়ে নির্মলকুমারীকে বললেন, ‘একটা মজা দেখবে?’

তখন ছিল শীতকাল। ফলে রোদ্দুরে বসে থাকা নিয়ে কোনও অস্বস্তি-অসুবিধা ছিল না। কবি ঠায় বসে রইলেন ওইখানে। ময়ূরও পরম নিশ্চিন্তে বসে রইল। চোখে মুখে সামান্যও ভয়ডরের চিহ্ন নেই। দৃশ্যটি দেখে নির্মলকুমারী মুখের হাসি চেপে রাখতে পারেননি। কবি তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই অবোধ জীবগুলো কেমন করে যেন টের পায় যে, আমার দ্বারা তাদের কোনো অনিষ্ট হবে না, তাই এমন নির্ভয়ে আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করে।’

রবীন্দ্রনাথ।

কবি সত্যিই পাখিদের ভালোবাসতেন। পশুদের ভালোবাসতেন। প্রতিদিন সকালবেলা ওই যে মুড়ি খাওয়ান, অনায়াসে ভৃত্য বনমালিকে সে দায়িত্ব দিতে পারতেন। বনমালিকে দায়িত্ব দিলে, সে দায়িত্ব পরম নিষ্ঠায় পালনও করত। বনমালি ছিল অত্যন্ত অনুগত। অনেক দায়িত্ব তাকে দিলেও এ দায়িত্ব তাঁকে রবীন্দ্রনাথ দেননি। নিজের হাতে পাখিদের মুড়ি খাওয়াতেন তিনি, জলের সরাতে জল ঢেলে রাখতেন। পশুদের প্রতিও কবির গভীর ভালোবাসা ছিল। সামান্য এক রাস্তার কুকুর, সেও বিশ্বকবির অকৃপণ ভালোবাসা পেয়েছিল।

লাল রঙের এক পথের কুকুর, কবি তার নাম দিয়েছিলেন ‘লালু’। রবীন্দ্রনাথ কুকুরটির জন্য কত রকমের খাবারই না বরাদ্দ করেছিলেন! কখন কী খাওয়াতে হবে, সে লিস্টি দিয়ে রেখেছিলেন বাড়ির কাজের লোকদের। সকালে চায়ের টেবিলে তার জন্য চাই স্লাইস রুটি। সে পাউরুটি দিতে হত টোস্ট করে, মাখন মাখিয়ে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১২: বাইগা রিসর্ট ও বস্তি

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪: পঞ্চমকে সিনেমা হলে বসিয়েই বেরিয়ে যান রীতা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’

লালু ছিল একেবারে শিক্ষিত কুকুর। কার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হয়, আদবকায়দা, নিয়মকানুন তার জানা ছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন খেতেন, তখন সে খাবারের দিকে নয়, তাকিয়ে থাকত অন্যদিকে, রাস্তার দিকে। তার কাণ্ড দেখে রবীন্দ্রনাথও মজা করতেন। একবার নির্মলকুমারীকে বলেছিলেন, ‘দেখেছ? কত সভ্য কুকুর আমার। ওর কোনওরকম হ্যাংলামি নেই। ধৈর্য ধরে চুপ করে আমার ডাকের অপেক্ষায় থাকে, তারপর খাওয়ার শেষে যখন লালু বলে ডাক দিই, তখন পাশে এসে বসে মুখের দিকে চোখ তুলে চায় আর আমার হাত থেকে নিয়ে ওই রুটিটুকু শান্তভাবে খেয়ে আবার ধীরে ধীরে চলে যায়।… একেই বলে আসল আভিজাত্য। সেই জন্যেই তো আমি ওকে এত ভালোবাসি।’

রবীন্দ্রনাথ সেদিন ছিলেন খোশমেজাজে। চলছিল হাসি-তামাশা। বনমালি লালুর আরও গুণপনার কথা বলতে থাকে। জানায়, ওকে কেউ বকলে, হ্যাংলা বললে খাবার ফেলে রেখে চলে যাবে।

রবীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী ও নির্মলকুমারী।

শুনে তো রবীন্দ্রনাথ ভীষণ খুশি। রামধনুর রং খেলে যায় চোখেমুখে। বললেন, ‘এ কি আমার যে সে কুকুর, একটু খাবারের লোভে অপমান সহ্য করবে?’ লালুকে নিয়ে অনেক প্রশংসা অনেক প্রশস্তি, তারপর কবি কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘নাই বা হল পাঁচশ টাকা দাম।’

সত্যতা প্রমাণ করার জন্য বনমালি লালুকে খুব বকা দিয়েছিল। বকা খেয়ে লালু আস্তে আস্তে উঠে গিয়েছিল। মাঠ পেরিয়ে কোথায় যে সে চলে গেল! দুপুরের খাবার আর খাওয়া হল না তার। বিষাদে, বিষণ্ণতায় মন ভরে গিয়েছিল কবির। পরে অবশ্যই লালু ফিরে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের মুখেও হাসি ফুটেছিল।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: দাঁতকে অবহেলা নয়, শিশুর দাঁতের যত্ন নিন গোড়া থেকেই, সতর্ক হন এই সব খাবারে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১২: ঘাম কমাতে পাউডার ব্যবহার করেন?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

নির্মলকুমারীদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের বাড়িতে কখনও কখনও অতিথি হয়েও গিয়েছেন। সেই কুকুরটির সঙ্গেও কবির খুব ভাবসাব হয়ে গিয়েছিল। একবার দুষ্টুমি করে সম্ভাব্য বকাঝকা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য কুকুরটি রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাকে বড়ো ভালোবেসে ফেলেছিলেন। কুকুরটিকে বাড়িতে রেখে একবার প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে নির্মলকুমারী বাইরে গিয়েছিলেন। প্রভু ভক্ত কুকুর, প্রভু না থাকায় বোধহয় একটু ভয়ই পেয়েছিল। তেমনই মনে হয়েছিল কবির। তাঁরা ফেরার পর তাঁদের কবি তিরস্কার করতেও ছাড়েননি। বলেছিলেন, ‘কেন তোমরা জানোয়ারকে এরকম কষ্ট দাও? তোমরা চলে যাওয়ার পর ও কীরকম কষ্ট পাচ্ছিল। ভেবেছে, তোমরা বুঝি ওকে একেবারেই ত্যাগ করে চলে গেছ।’ শুধু তাই নয়, কবি জানিয়েছিলেন, পোষা কুকুরটি বারান্দার রেলিংয়ের ভেতর মুখ গুঁজে পথের দিকে চেয়ে বিমর্ষ হয়ে বসেছিল।

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।

কবির কাছে তিরস্কৃত হয়েও মুখে কিছু বলেননি নির্মলকুমারী। মনে হয়েছিল তাঁর, কুকুরকে তো আর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় না! কী করবেন তিনি! কবি তাঁর মুখে সেই কৈফিয়ত শুনে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তাহলে পোষো কেন?’

তিরস্কারই শুধু নয়, কবির কণ্ঠে অসহায়তাও ঝরে পড়েছিল। জানিয়েছিলেন, ‘কোনো জানোয়ারকে এরকম কষ্ট পেতে দেখলে আমার ভারি খারাপ লাগে। কোনোরকম সান্ত্বনা দিতে পারি না, অথচ কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারি।’

হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ পারতেন এ ভাবে পশু-পাখিদের ভালোবাসতে। এ ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না, ভেতর থেকে উৎসারিত।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content