শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাসুন্দরীর দ্বিতীয় সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ‘মেজদা’ তিনি। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পরের বছর আইসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। উজ্জ্বল তাঁর ছাত্রজীবন। শেষ পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান লাভ করেছিলেন। আড়াই বছর পরে দেশে ফিরে আসেন। চাকরি হয় মুম্বইতে। দেশে ফেরেন অক্টোবরে। পরের মাসে, নভেম্বরে স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে নিয়ে মুম্বই যাত্রা করেছিলেন। তখনও মুম্বাই যাওয়ার রেলপথ তৈরি হয়নি। সত্যেন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন জাহাজে। স্ত্রীকে নিয়ে মুম্বই যাত্রা খুব সহজ ছিল না। অনেক বাধানিষেধ, সংস্কার পেরিয়ে তবেই যেতে পেরেছিলেন। পিতৃদেবের বক্তব্যের অন্যথা করেন কী করে! মহাসংকটে পড়লেন সত্যেন্দ্রনাথ। গাড়ি করে গিয়ে যে জাহাজঘাটে পৌঁছোবেন, জ্ঞানদানন্দিনীকে নিয়ে জাহাজে উঠবেন, তেমনটি হওয়ার জো ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘আমি প্রস্তাব করলুম বাড়ি থেকেই গাড়িতে ওঠা যাক। কিন্তু বাবামহাশয় তাতে সম্মত হলেন না। বললেন মেয়েদের পালকি করে যাবার যে নিয়ম আছে, তাই রক্ষা হোক। অসূর্যস্পশ্যা কুলবধূ কর্মচারীদের চোখের সামনে দিয়ে বাড়ির দেউড়ি ডিঙিয়ে গাড়িতে উঠবেন, এ তাঁর কিছুতেই মনঃপূত হল না।’
ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউরাও তখন নিশ্চিন্তে গঙ্গাস্নানে যেতে পারতেন না। বেহারারা পালকি সুদ্ধ ডুবিয়ে আনত। জ্ঞানদানন্দিনী শাড়ি পরে সবার চোখের সম্মুখে গাড়িতে উঠবেন, এ তো হতে পারে না। মহর্ষিদেব তা কিছুতেই হতে দেবেন না। জ্ঞানদানন্দিনী মুখে মুখে তাঁর জীবনকথা শুনিয়েছিলেন কন্যা ইন্দিরাকে। কন্যা সে জীবনকথা লিখে রেখেছিলেন। সেই জীবনকথায় জ্ঞানদানন্দিনী জানিয়েছেন, ‘সে সময়ে আমাদের খালি এক শাড়ি পরা ছিল, তা পরে তো বাইরে যাওয়া যায় না। তাই উনি কোনো ফরাসী দোকানে ফরমাশ দিয়ে একটা কী পোশাক আমার জন্য করালেন।…কর্তামশায় আমাকে বম্বে নিয়ে যাবার অনুমতি দিলে, আমাকে ওই পোশাক পরিয়ে ঘেরাটোপ দেওয়া পালকি করে জাহাজে তুলে দেওয়া হল।’

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।

জ্ঞানদানন্দিনীকে শিক্ষিত করে তোলার‌ সত্যেন্দ্রনাথের প্রয়াস তখনও সেভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। সত্যেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মনোমোহন ঘোষ। তিনি সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছিলেন। অবশ্য পাশ করতে পারেননি। পরে মনোমোহন খুব বড়ো ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী মনোমোহনের স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘তিনি স্ত্রীর সম্বন্ধে বেশ ভালো ব্যবস্থা করেছিলেন। সমাজে বের করবার আগে তাঁকে কনভেন্টে দিয়ে ইংরেজি লেখাপড়া শিখিয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু আমার সে সুযোগ হয়নি।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৮: ভরত কি ফিরবে শূন্য হাতে?

মনোমোহনের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গতা কত গভীর ছিল, তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। নিজের স্ত্রীকে দেখাতে যেভাবে গোপনে তিনি বন্ধুকে অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা অভাবনীয়। সে ঘটনার কৌতুককর বর্ণনা আছে জ্ঞানদানন্দিনীর লেখায়।

বাইরের পুরুষ মানুষ বাড়ির ভেতর ঢুকবে, এ হতে পারে না। ছিল কঠোর বিধিনিষেধ। তাই সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধু মনোমোহনকে সবার চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে নিয়ে গিয়েছিলেন শোওয়ার ঘরে। বধূ হয়ে সবে আসা জ্ঞানদানন্দিনীর খাটে তুলেছিলেন। সত্যেন্দ্র-বধূর বিস্ময়ের শেষ ছিল না। হতবাক হয়েছিলেন তিনি। ‘মশারির মধ্যে জড়সড় হয়ে’ ঘোমটা দিয়ে বিছানার একপাশে বসেছিলেন। মনোমোহনের অবস্থাও তথৈবচ। ‘ভোম্বল দাসের মতো’ আরেক পাশে বসেছিলেন তিনি।

মনোমোহন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। একই মাস্টারমশায় মনোমোহন ও সত্যেন্দ্রনাথকে পড়াতেন। মনোমোহন সম্পর্কে মাস্টারমশায়ের ধারণা ছিল ‘যুবার ধড়ে বুড়ার মাথা।’ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল না হলেও বারবার তিনি তাঁর মেধার পরিচয় দিয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তিতে আছে সে তথ্য।

মনোমোহন ঘোষ।

চোখে মুখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে আই. সি.এস পরীক্ষা দিতে নববধূকে জোড়াসাঁকোয় রেখে সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে পাড়ি দিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে এমন একটি ঘটনা ঘটে, যা এই স্বপ্ন সফল হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠেছিল। মহর্ষিদেব ঠিকই করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথকে আর বিলেতে পাঠাবেন না। সত্যেন্দ্রনাথেরই লেখা থেকে জানা যায়, বিলেতে যাওয়া তখন সবে ঠিক হয়েছে। হঠাৎ দুই বন্ধু, সত্যেন্দ্রনাথ ও মনোমোহন বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। গঙ্গা পার হওয়ার সময় আকস্মিক স্টিমারের ধাক্কা লাগে। উল্টে যায় তাঁদের নৌকো। সত্যেন্দ্রনাথ ভালো সাঁতার জানতেন। প্রথমে ভয় পেলেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। কেউ না কেউ উদ্ধার করবে ভেবে কোনোরকম নৌকোর একটি অংশ আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি। মনোমোহন পড়ে গিয়েছিলেন নৌকোর তলায়। হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। বন্ধুর অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। কী করে তাঁকে উদ্ধার করবেন, নিজের এমন করুণ অবস্থার মধ্যেও ভাবতে লাগলেন সে কথা। ভেবে অবশ্য কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না। বড়ো অসহায় লাগছিল। শেষে দুই বন্ধুতে ‘কে আছ, বাঁচাও’ বলে শুরু করলেন মরিয়া চিৎকার। ঠিক তখনই পানসিতে এক মাঝি যাচ্ছিল। দুই তরুণের দুর্গতি দেখে উদ্ধার করতে তৎপর হয়ে উঠল মাঝি। মাঝিই তাঁদের টেনে তুলল।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: বিকেল হলেই জমিয়ে প্রেম বা আড্ডা, সঙ্গে যদি থাকে ভেজিটেবিল চপ

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৯: আগে তো প্রাণে বাঁচি, তার পরে না হয় বিমার নিয়ম কানুনের কথা ভাবা যাবে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

ভেজা জপজপে সপসপে পোশাকে তো আর বাড়ি ফিরে আসা যায় না। ভেজা পোশাক শুকিয়ে তবেই তাঁরা বাড়ি ফেরেন। তাঁরা বাড়ি ফেরার আগেই মহর্যিদেবের কানে এই দুঃসংবাদ পৌঁছেছিল। তিনি উত্তেজিত শুধু নন, হয়েছিলেন প্রবলভাবে বিচলিত। আতঙ্কিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা এখানেই আপনাদের আপনারা সামলাতে পার না, তোমাদের ওই দূর দেশে পাঠানো যায় কি করে? তোমাদের কেউ সঙ্গী নেই, রক্ষক নেই, আপনার উপর নির্ভর করেই যেতে হবে, তোমরা তা পেরে উঠবে কিনা এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে।’

পিতৃদেব সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন। উৎকণ্ঠা তাঁর মনোমোহনকে নিয়েও। মনোমোহনের সঙ্গে বংশপরম্পরায় পারিবারিক সম্পর্ক। তাঁর পিতামহ রামলোচন ঘোষ ছিলেন দ্বারকানাথের পরম বান্ধব। সেই সূত্রেই মনোমোহনের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধুত্বের সূচনা। দিনে দিনে সেই সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কাছে মনোমোহনও ছিলেন পুত্রতুল্য।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর।

সে সময় ও দেশে যাওয়া সহজ কাজ ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথ নিজেও তা জানতেন। সে কারণেই বলেছেন, ‘বাস্তবিক ভেবে দেখতে গেলে আমরা অসমসাহসের কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম বলতে হবে। আমরা দুটি তরুণবয়স্ক বালক, আর তখন ইংলণ্ডে যাওয়া এখনকার মতো এপাড়া ওপাড়া নয়।’ সত্যিই তো তাই। বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে সেই দূর-দেশে পৌঁছানো সহজ কাজ ছিল না। বলা হত ‘কালাপানি’ পার হওয়া, তা ছিল অসাধ্যসাধন। সত্যেন্দ্রনাথের আগে রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ‌‌ ওদেশে গিয়েছিলেন। তাঁরা কেউই আর ফিরে আসেননি। তাই সকলেরই ধারণা ছিল ওদেশে একবার কেউ গেলে আর ফিরে আসে না। এমন ধারণা আর যাঁরই হোক, নিশ্চিতভাবে জ্ঞানদানন্দিনীর হয়নি। অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মহিলা ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: রোজ টক দই খাচ্ছেন? খাওয়ার আগে কোন বিষয়গুলি অবশ্যই মাথায় রাখবেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১০: পেটের গ্যাস সারা দেহেই ঘুরে বেড়ায়!

সুখের কথা দুই বন্ধু আইসিএস পরীক্ষার টানে নির্বিঘ্নে সাগর পেরিয়ে ওদেশে পৌঁছেছিলেন। সে দেশে থাকতেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর। জ্ঞানেন্দ্রমোহন ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবংশের প্রসন্নকুমারের পুত্র। তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের কন্যা কমলমণিকে বিবাহ করেছিলেন। খ্রিস্টান হওয়ার ফলে সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল তাঁকে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহনের পত্নী ও তাঁর সহচরী।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন ও দেশে অধ্যাপনার কাজে সে সময় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে জাহাজঘাটে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে। সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধু মনোমোহনকে নিয়ে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের বাড়িতেই প্রথম কয়েকমাস ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, তিনি ‘অভিভাবকের মতো’ তাঁদের ‘যত্ন’ করতেন। দূর-দেশে জ্ঞানেন্দ্রমোহনই ছিলেন বড়ো ভরসা। ভাগ্যিস, শেষ পর্যন্ত সত্যেন্দ্রনাথের ও দেশে যাওয়া হয়েছিল, তা না হলে পরাধীন ভারতবর্ষে যে পদমর্যদা, যে সম্ভ্রমের আসন তিনি পেয়েছিলেন, তা অধরাই থেকে যেত।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content