
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ সমকালে কম নিন্দিত হননি। তাঁকে নিয়ে রঙ্গ-তামাশা করে দ্বিজেন্দ্রলালের মতো শক্তিমান কবি ও নাট্যকার নাটক লিখেছিলেন। সে নাটকের নাম ‘আনন্দ বিদায়’। নাটকটি স্টার থিয়েটারে অভিনয়েরও ব্যবস্থা হয়েছিল। শুধু দ্বিজেন্দ্রলাল নন, সুযোগ বুঝে তাঁর দিকে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছেন, কবিকে মানসিকভাবে আহত করেছেন, এমন মানুষজনের অভাব ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিচলিত হয়েছেন, প্রতিবাদমুখর হয়েছেন— না, তেমন ঘটেনি। প্রায়শই নীরবে সহ্য করেছেন অর্থহীন-যুক্তিহীন আক্রমণ। সে আক্রমণে মিশেছিল অসূয়া, ঈর্ষাকাতরতা। জীবনের শেষ বেলায় অবশ্য এমন আক্রমণ কবিকে সইতে হয়েছে, যা একেবারে মিথ্যাচারিতা, নিতান্তই ঈর্ষকাতরতা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আক্রমণে জেরবার হয়ে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা সচরাচর ভাবা যায় না। এই আক্রমণ অবশ্য ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ্য করে হয়নি, হয়েছিল তাঁর একটি বইকে কেন্দ্র করে
রবীন্দ্রনাথ আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিচলিত হয়েছেন, প্রতিবাদমুখর হয়েছেন— না, তেমন ঘটেনি। প্রায়শই নীরবে সহ্য করেছেন অর্থহীন-যুক্তিহীন আক্রমণ। সে আক্রমণে মিশেছিল অসূয়া, ঈর্ষাকাতরতা। জীবনের শেষ বেলায় অবশ্য এমন আক্রমণ কবিকে সইতে হয়েছে, যা একেবারে মিথ্যাচারিতা, নিতান্তই ঈর্ষকাতরতা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আক্রমণে জেরবার হয়ে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা সচরাচর ভাবা যায় না। এই আক্রমণ অবশ্য ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ্য করে হয়নি, হয়েছিল তাঁর একটি বইকে কেন্দ্র করে

জীবনানন্দ দাশ।
জীবনের বেলাশেষে, ১৯৩৮-এ প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’। বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তেমন কোনও সংকলন এর আগে প্রকাশিত হয়নি। নরেন্দ্র দেব ‘কাব্য দিপালী’ নামে এ ধরনের একটি সংকলন প্রকাশের, সম্পাদনার চেষ্টা করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, বইটি তেমন মানের হয়ে ওঠেনি। বুদ্ধদেব বসুর মনে হয়েছিল, ‘বইটি বোবা ও ব্যর্থ।’
এমনতরো প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় বাংলা কবিতা সংগ্রহ প্রকাশের সংবাদ কবিতা-প্রিয় পাঠকের কাছে আগ্রহের সঞ্চার করেছিল। সারা পৃথিবীর মানুষ যাঁর কাছে নতজানু হয়েছে, খ্যাতির শিখর যিনি স্পর্শ করেছেন, সেই মহাকবির নির্বাচন, ভালোলাগা না- লাগা জানার জন্য কৌতূহল হওয়াই তো স্বাভাবিক! কৌতূহলী পাঠকের আশাভঙ্গ ঘটেছিল সংকলনটি প্রকাশের পর।
এমনতরো প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় বাংলা কবিতা সংগ্রহ প্রকাশের সংবাদ কবিতা-প্রিয় পাঠকের কাছে আগ্রহের সঞ্চার করেছিল। সারা পৃথিবীর মানুষ যাঁর কাছে নতজানু হয়েছে, খ্যাতির শিখর যিনি স্পর্শ করেছেন, সেই মহাকবির নির্বাচন, ভালোলাগা না- লাগা জানার জন্য কৌতূহল হওয়াই তো স্বাভাবিক! কৌতূহলী পাঠকের আশাভঙ্গ ঘটেছিল সংকলনটি প্রকাশের পর।
মধ্যযুগের কবিদের কবিতা, এমনকি বাউলগান ও ছড়া এই কাব্য সংকলনে যুক্ত করে এক ভিন্নতর মাত্রা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গগন হরকরা, বাউল গঙ্গারাম বা মদন বাউলের মতো একতারা হাতে আপন খেয়ালে গান গেয়ে চলা লোককবিদের সম্ভ্রমের আসনে এর আগে কেউ বসাননি। রবীন্দ্রনাথ নাম না জানা লোককবিদের বাংলা কাব্যের মূল স্রোতে স্থান দিয়েছিলেন। এসব নিয়ে ভাবার মতো অবকাশ কারও তখন আর ছিল না। বইটি প্রকাশের পর পাঠকের মধ্যে, কবিদের মধ্যে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। উনিশ-কুড়ি শতকের কবি ও কবিতা নির্বাচন নিয়ে ঘোরতর বিতর্ক বেঁধেছিল। সকলের কণ্ঠে একই জিজ্ঞাসা, একি করলেন মহাকবি!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫১: বিয়েশাদির ঠাকুরবাড়ি

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে, সামনে পরীক্ষা? চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য রইল ১০টি জরুরি পরামর্শ

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৬: উত্তম কাছে এসে বললেন, “তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি সাবু, এ বার আমায় মাফ করে দে”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিদি স্বর্ণকুমারীরও কবিতা রাখেননি। স্বর্ণকুমারী গদ্যরচনার পাশাপাশি কবিতা লিখতেন নিয়মিত। রবীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন তাঁর এই অগ্রজা। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁকে পছন্দ করতেন না, তা অবশ্য নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট, সে তথ্য আমাদের অজানা নয়। সে কারণেই কি স্বর্ণকুমারী বাদ পড়ে গিয়েছিলেন? কবিতা নেই প্রসন্নময়ী দেবীর, নেই মানকুমারী বসুরও। সমকালে তাঁদের যথেষ্টই কবিখ্যাতি ছিল। অতুলপ্রসাদ সেন ও বিজয়চন্দ্র মজুমদারও অনুপস্থিত। চিত্তরঞ্জন দাশের ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের গল্পকে সামনে রেখে পাল্টা গল্পও তৈরি করা হয়েছে। গোপন থাকেনি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। খুব সংগত কারণে সেসব কবি মেনে নিতে পারেননি। তাই চিত্তরঞ্জন একাধিক কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা হওয়া সত্ত্বেও বাদ পড়ে গিয়েছিলেন।

বিষ্ণু দে।
অনেকের কবিতাই মর্যাদার সঙ্গে ছাপা হয়নি, নিতান্তই ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছিল। গোবিন্দচন্দ্র দাস বা অক্ষয়কুমার বড়ালের একটি করে কবিতা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সব মিলিয়ে দুটি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে, অথচ নন্দগোপাল সেনগুপ্ত বা উমা দেবী দু-জনেরই কবিতা রয়েছে পাঁচটি করে। তাঁরা যে কবিতা লিখতেন, এ তথ্য বৃহত্তর পাঠকেরই জানা ছিল না, তাঁদের প্রতি কবির এই সীমাহীন আনুগত্য সাধারণ পাঠক মেনেই বা নেবেন কেন! রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকা আশ্রমের মানুষজনও বাদ পড়েননি। ক্ষিতিশ রায় বা সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর কবিতাও রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন। তাঁরা যে কবিতা লিখতেন, তা সমকালের পাঠকেরও অজানা ছিল। স্বজনপোষণ ও পক্ষপাতের এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ নামের এই সংকলনটি।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: সকালে জলখাবারে থাক নতুনত্ব, বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালক পনির পরোটা

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৫: রাজ সিংহাসন কি মন ভোলাল ভরতের?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ
সংকলনটি যেদিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিন সন্ধে থেকেই কবির কাছে আসতে থাকে প্রতিবাদপত্র। অসন্তোষ-ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা শোভনতা হারায়। সেসময় দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী নামে এক কবি ছিলেন। এই সংকলনে তাঁর একটি কবিতাও ছাপা হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রনারায়ণের পুত্র কবির কাছে এক হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে বসেছিলেন। এক হাজার টাকা সে সময়ের বিচারে যে বিপুল টাকা, তা সহজে অনুমেয়। পুত্রের অভিযোগ, তাঁর পিতৃদেবের কবিতা অনুমতি না নিয়ে গুরুদেব ছেপেছেন। কেন ছেপেছেন, টাকা তাঁর চাই। এই দাবি প্রকাশের ভাষাও শোভনতা হারিয়েছিল।
জীবনময় রায় নামে আরেক কবি এমন ভাষায় তাঁর প্রকাশিত কবিতা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, কবিকে আক্রমণ করেছিলেন, কবি তখনই বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেভাবেই হোক জীবনময়ের কবিতা বাদ দিতে হবে। কার কবিতা রাখা যায়, কবি নিরুপমা দেবীর নাম ভাবলেন। নিরুপমা গল্প-উপন্যাস লেখেন, কবিতা তেমন নয়। কবি চাইলে কে বিরোধিতা করবেন, অগত্যা তাঁর কবিতা ছাপার ব্যবস্থা হল। জীবনময়ের কবিতার পাতাটি ছিঁড়ে স্বতন্ত্র পৃষ্ঠায় ছাপা নিরুপমা দেবীর কবিতা আঠা দিয়ে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বইয়ের সূচিপত্রও নতুন করে ছাপা হয়েছিল।
শুধু দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বা জীবনময়কে নিয়ে সমস্যা, তা নয়। সমস্যা আরও গভীরে। ‘কাজলাদিদি’র কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর নাম বইতে ছাপা হয়েছিল যতীন্দ্রনাথ। স্বভাবতই তিনি ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত। জীবনানন্দ তখনই সুপরিচিত। ‘ঝরা পালক’-এর পর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বই হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। সেই জীবনানন্দের একটি গোটা কবিতাও ছাপা হয়নি। হয়েছিল অংশবিশেষ। এমনকি তাঁর পদবীর নামের বানান যথাযথভাবে মুদ্রিত হয়নি, তা নিয়ে জীবনানন্দ কিছু না বললেও বাংলা কবিতার পাঠক ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাঁচা বয়সে লেখা একটি দুর্বল কবিতা এই সংকলনে ছাপা হয়েছিল। নিজের ক্ষোভের কথা তখনই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ স্বয়ং।
জীবনময় রায় নামে আরেক কবি এমন ভাষায় তাঁর প্রকাশিত কবিতা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, কবিকে আক্রমণ করেছিলেন, কবি তখনই বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেভাবেই হোক জীবনময়ের কবিতা বাদ দিতে হবে। কার কবিতা রাখা যায়, কবি নিরুপমা দেবীর নাম ভাবলেন। নিরুপমা গল্প-উপন্যাস লেখেন, কবিতা তেমন নয়। কবি চাইলে কে বিরোধিতা করবেন, অগত্যা তাঁর কবিতা ছাপার ব্যবস্থা হল। জীবনময়ের কবিতার পাতাটি ছিঁড়ে স্বতন্ত্র পৃষ্ঠায় ছাপা নিরুপমা দেবীর কবিতা আঠা দিয়ে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বইয়ের সূচিপত্রও নতুন করে ছাপা হয়েছিল।
শুধু দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বা জীবনময়কে নিয়ে সমস্যা, তা নয়। সমস্যা আরও গভীরে। ‘কাজলাদিদি’র কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর নাম বইতে ছাপা হয়েছিল যতীন্দ্রনাথ। স্বভাবতই তিনি ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত। জীবনানন্দ তখনই সুপরিচিত। ‘ঝরা পালক’-এর পর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বই হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। সেই জীবনানন্দের একটি গোটা কবিতাও ছাপা হয়নি। হয়েছিল অংশবিশেষ। এমনকি তাঁর পদবীর নামের বানান যথাযথভাবে মুদ্রিত হয়নি, তা নিয়ে জীবনানন্দ কিছু না বললেও বাংলা কবিতার পাঠক ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাঁচা বয়সে লেখা একটি দুর্বল কবিতা এই সংকলনে ছাপা হয়েছিল। নিজের ক্ষোভের কথা তখনই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ স্বয়ং।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: ডার্ক চকোলেট হার্টের অসুখ-সহ নানা রোগের দাওয়াই, কতটা খাবেন, কেন?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২: এসেছে দৈব পিকনিকে

ত্বকের পরিচর্যায়: চুল পড়ার কারণগুলো জানলেই তা রুখে দেওয়া যায়, রইল ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত বাংলা কবিতার এই সংকলনটি হাতে নিয়ে পাঠক শুধু আশাহত হননি, হতবাক হয়েছিলেন। তরুণ কবিসমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু তীব্র ভাষায় সংকলনটির বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। ব্যর্থতার দায় কবির উপরই চাপিয়েছিলেন। সে সময় বাংলা কবিতা যাঁদের হাত ধরে বাঁক নিচ্ছিল, তাঁদের কারও কারও একআধটা কবিতা রাখা হলেও অনেকের কবিতা রাখাই হয়নি।
বিষ্ণু দে ও সমর সেন কবি হিসেবে তখনই যথেষ্ট পরিচিত। তাঁদের কবিতা রবীন্দ্রনাথের অনুগ্রহ পায়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় থেকে অরুণ মিত্র, না, তাঁদের কবিতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও বাদ দিয়েছিলেন, উপেক্ষা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ কবিতা রেখেছিলেন সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী বা হাসিরাশি দেবীর মতো কারও কারও। দূর-অতীতে তো বিস্মৃত, সমকালেও তাঁদের তেমন কবিখ্যাতি ছিল না। সমকালে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ শুধু সমালোচিত নয়, ধিক্কৃত হয়েছিল।
বিষ্ণু দে ও সমর সেন কবি হিসেবে তখনই যথেষ্ট পরিচিত। তাঁদের কবিতা রবীন্দ্রনাথের অনুগ্রহ পায়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় থেকে অরুণ মিত্র, না, তাঁদের কবিতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও বাদ দিয়েছিলেন, উপেক্ষা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ কবিতা রেখেছিলেন সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী বা হাসিরাশি দেবীর মতো কারও কারও। দূর-অতীতে তো বিস্মৃত, সমকালেও তাঁদের তেমন কবিখ্যাতি ছিল না। সমকালে রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ শুধু সমালোচিত নয়, ধিক্কৃত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত সেই বই।
পরবর্তীকালেও কবির এই প্রয়াসকে কেউ স্বীকৃতি দেননি। নিন্দেমন্দ করেছিলেন। শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘উর্বশীর হাসি’ বইতে বলেছেন ‘রোমাঞ্চকর এক সংকলন’।
রবীন্দ্রনাথের এই সম্পাদনাকর্মে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছিলেন কাননবিহারী মুখোপাধ্যায়। কাননবিহারী ‘মানুষ রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, সে বইতে আছে তাঁর সক্রিয় সাহায্যের স্মৃতিমিশ্রিত বিবরণ। রবীন্দ্রনাথও বইয়ের ভূমিকায় কাননবিহারী মুখোপাধ্যায় ও নন্দগোপাল সেনগুপ্তের সাহায্যের কথা বলেছেন। এরপরও প্রশ্ন রয়ে যায়, তাঁরা কবির হাতে যে কবিতা ধরিয়ে দিয়েছেন, যে কবির নাম বলেছেন, তা কি অকাতরে গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ?
রবীন্দ্রনাথের এই সম্পাদনাকর্মে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছিলেন কাননবিহারী মুখোপাধ্যায়। কাননবিহারী ‘মানুষ রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, সে বইতে আছে তাঁর সক্রিয় সাহায্যের স্মৃতিমিশ্রিত বিবরণ। রবীন্দ্রনাথও বইয়ের ভূমিকায় কাননবিহারী মুখোপাধ্যায় ও নন্দগোপাল সেনগুপ্তের সাহায্যের কথা বলেছেন। এরপরও প্রশ্ন রয়ে যায়, তাঁরা কবির হাতে যে কবিতা ধরিয়ে দিয়েছেন, যে কবির নাম বলেছেন, তা কি অকাতরে গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ?

কাননবিহারী মুখোপাধ্যায়ের 'মানুষ রবীন্দ্রনাথ'।
রবীন্দ্রনাথ নতুন প্রজন্মের কবিদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই তো মনে হয়। তাঁদের কাব্যচর্চা যে বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা যে নতুনতর ভঙ্গিতে লিখছেন, কেউ কেউ যথেষ্ট শক্তিমান, এসব কবির জানা ছিল না, তা হতে পারে না। তাঁর মতো সচেতন মানুষ এসব জানতেন না, তিনি অন্য কারও দ্বারা চালিত হয়েছেন, এমনটি ভাবতেও কেমন যেন মনে দ্বিধা জন্মায়। রবীন্দ্রনাথ চেনা-জানা মানুষকে একটু বেশি স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছিলেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি কি কাউকে কাউকে আড়াল করতে চেয়েছিলেন, কে জানে! এ বইটি প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ করে এতই আক্রমণ হয়েছে, কোনওরকমে কবি নিস্তারের পথ খুঁজেছেন। প্রথমে মুদ্রিত কবিতা বাদ দিয়ে, নতুন করে সূচিপত্র ছেপে নতুনতর সংস্করণ প্রকাশ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। বেনোজল রয়েই গিয়েছিল। কবিকে ঘিরে নিন্দা-বর্ষণ, আক্রমণ অব্যাহত থেকেছে। শেষে খানিক নিরুপায় হয়েই মুদ্রিত ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’-এর সমস্ত কপি বাজার থেকে তুলে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
মহাকবির সম্পাদনাকর্মের এ দৃষ্টান্ত মোটেই আনন্দময় সুখকর নয়। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কবির ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে এ বইয়ের আর পুনর্মুদ্রণ করেননি।
ছবি সৌজন্যে: লেখক
মহাকবির সম্পাদনাকর্মের এ দৃষ্টান্ত মোটেই আনন্দময় সুখকর নয়। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কবির ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়ে এ বইয়ের আর পুনর্মুদ্রণ করেননি।
ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।