শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


পাঠক রবীন্দ্রনাথ।

একজন লেখক শুধুই লিখবেন, তা নয়, তাঁকে ভালো পাঠকও হতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ব্যস্ততার শেষ ছিল না। শুধু লিখে যাওয়া নয়, তাঁর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড আমাদের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। সেই প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও কবি ডুব দিতেন বইয়ের পাতায়। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে লেখার খাতায়। রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার জগৎ বহু দূর বিস্তৃত ছিল। তাঁর আগ্রহ কখনও সুনির্দিষ্ট গণ্ডিতে ঘুরপাক খায়নি।‌ নিতান্তই শৈশব-বাল্যে গড়ে উঠেছিল পড়াশোনার এই অভ্যাস। মগ্ন হতেন বইয়ে, তাতেই আনন্দ, নব আনন্দে জেগে ওঠা। বোঝা না-বোঝা নিয়ে ভাবনা-দুর্ভাবনা ছিল না তাঁর।
রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে তাঁর ছেলেবেলার পড়াশোনা নিয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। নিতান্তই বালক বয়সে ‘কুমারসম্ভব’ ও ‘ম্যাকবেথ পড়া হয়ে গিয়েছিল‌ তাঁর। পড়া হয়ে গিয়েছিল ‘শকুন্তলা’ও। শুধু পড়া নয়, ছন্দচর্চাও চলেছে‌ সমানতালে। রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য, তাঁর পণ্ডিতমশায়, ম্যাকবেথের গল্প বলে যেতেন, বালক রবীন্দ্রনাথকে তা ছন্দে রূপান্তরিত করতে হতো। কবিতায় রূপান্তরিত ম্যাকবেথের অংশবিশেষ বিদ্যাসাগরকে শোনানোর জন্য বালক কবিকে নিয়ে রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই যে, বালক রবীন্দ্রনাথের কাছে তা ছিল এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। আতঙ্ক আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই—অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪০: শুধু খাল-বিল ঝিল নয়নজুলিতে মৌরালা মাছ করে প্রায় ২০ লক্ষ শিশুর অনুপুষ্টির ঘাটতি মেটানো সম্ভব

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২১: কে তুমি নিলে আমার চিরসবুজের ‘অগ্নিপরীক্ষা’

রবীন্দ্রনাথ বাল্য-কৈশোরে ‘পাঠ্য-অপাঠ্য বাংলা বই’ সবই প্রায় পড়ে ফেলেছিলেন। হয়তো বড়োদের বই, সে বই পড়তেও কোনও দ্বিধা ছিল না। বরং একটু বেশি রকমেরই আগ্রহ ছিল। ‘নীলদর্পণ’-এর দীনবন্ধু মিত্র ‘জামাই বারিক’ নামে একটি প্রহসন লিখেছিলেন। বইটি অবশ্য ছোটোদের নয়, রবীন্দ্রনাথের এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়া ‘জামাই বারিক’ সেদিন পড়ছিলেন। তাঁকে পড়তে দেখে রবীন্দ্রনাথেরও পড়তে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে ক্রমেই প্রবল হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ অনুনয় করলেন, বিনয় দেখিয়ে সেই বইটি চাইলেন। না, সেই আত্মীয়া ‌দেননি। উল্টে শোনালেন হাজারো জ্ঞানের কথা। শেষে বইটি বাক্সে রেখে তালা দিয়ে দিলেন। নিষিদ্ধ এ বই, কিছুতেই ছোটোদের হাতে দেওয়া যাবে না। এমন এক ভাব করায় রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ-কৌতূহল বহুগুণ বেড়ে গেল। ‘এ বই আমি পড়বোই,’ বই না-দেওয়ায় আত্মীয়াকে এই বলে প্রায় চ্যালেঞ্জ জানালেন, ভাবা যায়!

প্রিয়নাথ সেন ও রবীন্দ্রনাথ।

বই যাঁর, তিনি আঁচলে চাবি বেঁধে দুপুরে তাস খেলায় মগ্ন হলেন। রবীন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে কৌশলে আঁচল থেকে চাবি খুলে নিতে চেষ্টা করলেন বটে, সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হল না। ব্যর্থ হয়ে ধরাও পড়ে গেলেন। তিনি আঁচল থেকে চাবির গোছা নামিয়ে কোলে রেখে আবার খেলায় মগ্ন হলেন। এত চেষ্টা করেও বই না পেয়ে রবীন্দ্রনাথ একটু বিপন্নই বোধ করলেন।

আত্মীয়া দোক্তা খেতেন। রবীন্দ্রনাথ কোথা থেকে খানিক দোক্তা সংগ্রহ করে এনে তাঁর সামনে রাখলেন। নেশার জিনিস, না খেয়ে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গেই সদ্ব্যবহার করলেন। একটু পরই পিক ফেলতে তাঁকে উঠতে হল। চাবি সমেত আঁচল কোল থেকে পড়ে গেল। এরপর পড়ে যাওয়া আঁচল তুলে কোলে না রেখে তিনি রাখলেন পিঠে। এবার আর ব্যর্থ হননি রবীন্দ্রনাথ। বইয়ের জন্য চাবি চুরি!

শেষ পর্যন্ত সে বই পড়ে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। কৌতূহল নিরসন, স্বস্তি। কবি লিখেছেন, ‘আমার আত্মীয়া ভর্ৎসনা করিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু তাহা যথোচিত কঠোর হইল না; তিনি মনে মনে হাসিতেছিলেন— আমারও সেই দশা।’
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: সামনেই জন্মদিন? বিশেষ দিনের ভূরিভোজে বানিয়ে ফেলুন কাশ্মীরি পদ মটন রোগান জোস!

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩: বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই উইসকনসিনের সঙ্গে পার্থক্যটা টের পেলাম, মুহূর্তে ঠোঁট, গাল জমে যেতে লাগল

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪: যেখানে অর্জিত ভক্তি ও বিশ্বাস আছে, সেখানেই ভগবান আছেন

রবীন্দ্রনাথ ওই বালক বয়সে, কৈশোরে আরও কত বই পড়েছেন। পত্রিকা পড়েছেন। সেজদা হেমেন্দ্রনাথের আলমারিতে ‘বিবিধার্থ- সংগ্রহ’ নামে ছবিওয়ালা মাসিকপত্র বাঁধানো ফাইল ছিল। বড়োসড়ো সাইজের সেই বাঁধানো পত্রিকা-ফাইলটিকে সঙ্গী করে শোবার ঘরে তক্তপোষের ওপর চিত হয়ে শুয়ে কত দুপুর কাটিয়েছেন। বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের আলমারি থেকে নিয়ে পড়তেন ‘অবোধ-বন্ধু’। এ পত্রিকাটি প্রকাশ করতেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। বিহারীলালের কবিতা ঘিরে রবীন্দ্রনাথের যে মুগ্ধতা, এই পত্রিকাতে কবিতা পড়তে গিয়েই‌ তার সূত্রপাত। বাড়িতে আসত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’, তা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন কবি। বড়োদের পড়া কবে, কখন শেষ হবে, তার অপেক্ষায় থাকতেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। এই অপেক্ষার কালটি ছিল বড় দুঃসহ। ‘বঙ্গদর্শন’-এর পাতাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রথম ‘বিষবৃক্ষ’ পড়া, ‘চন্দ্রশেখর’ পড়া।

রবীন্দ্রনাথ বড় হয়েছেন সাহিত্যের আবহাওয়ায়। ‘বাড়িতে দিনরাত্রি সাহিত্যের হাওয়া বহিত।’ বৈঠকখানায় চলত বড়োদের আলাপ-আলোচনা, নানা পরিকল্পনার গ্রহণ-বর্জন। রবীন্দ্রনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপ করে সে সব শুনতেন। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ রচনারও তিনি ছিলেন সাক্ষী। নিকট থেকে দেখেছেন।

রবীন্দ্রনাথ, প্রিয়নাথ সেন, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও কবির বন্ধুরা।

রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার পরিধি‌ পরিণত বয়েসে আরও বিস্তৃত হয়। পড়ার বইয়ের বাইরে তাঁর ভিন্নতর বই পড়ার অভ্যাস ও আগ্ৰহ তো বাল্য-কৈশোরেই গড়ে উঠেছিল। পিতৃদেবের সঙ্গে ডালহৌসি পাহাড়ে গিয়ে পড়েছিলেন ‘ঋজুপাঠ’ ও ‘উপক্রমণিকা’। হ্যাঁ, মহর্ষির কাছেই পাঠ নিয়েছিলেন তিনি।‌ ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ও পড়া হয়ে গিয়েছিল। পড়েছিলেন উপনিষদও।

সংস্কৃতসাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথের প্রবল আগ্ৰহ। পড়েছেন কালিদাস, বানভট্ট ও ভবভূতি। মধ্যযুগের সাহিত্য, বিশেষত বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে প্রবল আকর্ষণ ছিল, তা আমাদের অজানা নয়। এই আকর্ষণের ফলেই লেখা হয়েছিল ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। ‘পদরত্নাবলী’ সংকলনটিকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের সাহিত্য খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। পরবর্তীকালে, পরিণত-বয়সে সমসাময়িক সাহিত্য যেমন পড়েছেন, অগ্রজজনের বইপত্রও তেমন পড়তে হয়েছে তাঁকে। বিদেশিসাহিত্য নিয়মিত পড়তেন। ও দেশে কেমন লেখা হচ্ছে, সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল কবির। সমকালের অনেকের বইই শুধু পড়া নয়, পড়ার পর পত্রিকার জন্য পাঠ-প্রতিক্রিয়াও লিখতে হয়েছে। শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘যুগান্তর’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’, সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’—এমন অনেক বইয়ের কথাই এ প্রসঙ্গে বলা যায়।
আরও পড়ুন:

ক্লাসরুম: মাধ্যমিক ২০২৩: ইংরাজি পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে নিলে ভালো ফল করা সম্ভব, তা দেখে নাও একঝলকে

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন: শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? প্রাকৃতিক উপায়েই সহজে জব্দ হবে এই রোগ, কী ভাবে?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫২: উশীনরের ধর্মভাব পরীক্ষা করলেন বাজরূপী ইন্দ্র

সমসাময়িক কবি-লেখকরা রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠাতেন। মতামত প্রত্যাশা করতেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর, জীবনানন্দ কার না তিনি বই পেয়েছেন! পরবর্তী প্রজন্মের কবি-লেখকদের বই যত্ন করে পড়েছেন, মূল্যবান মতামতও দিয়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যেরও নিষ্ঠাবান পাঠক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অল্প বয়সেই সাহেবসুবোদের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে যে আগ্রহের সূচনা, তা দিনে দিনে আরও গভীর ও ব্যাপক হয়েছিল। যৌবনে এই আগ্রহকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তাঁর সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল কবির। মাধুরীলতার বিবাহের ক্ষেত্রেও প্রিয়নাথের‌ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শেলি, দোদে, মলিয়্যার, টলস্টয়, ‌আনাতোল ফ্রাঁস, ম্যাকসমূলর ও গ্রিয়ার্সনের বই প্রিয়নাথ পড়িয়েছেন। কোনও বিলেতি বই পড়তে হলে রবীন্দ্রনাথ প্রিয়নাথকে চিঠি লিখতেন। বই জোগাড় করে দিতে বলতেন। কখনও মার্ক টোয়েনের বই, কখনও হেনরি হাডসনের বই, কখনও-বা গোর্কির বই। রবীন্দ্রনাথের বই-দাবি সানন্দে প্রিয়নাথ মেটাতেন। দু-জনের চিঠিতেও আসত সাহিত্য-প্রসঙ্গ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ-শেলি-কিটস-টেনিসন সকলেই এসে পড়তেন পত্রে, সাহিত্যালোচনায়।

বন্ধু প্রিয়নাথকে লেখা কবির কৌতুকপত্র।

বিজ্ঞানের বই, সংগীতের বই, দর্শনের বই— পাশ্চাত্যের নানা বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের গভীর কৌতূহল ছিল। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনের সংরক্ষিত কবির ব্যবহৃত গ্রন্থাবলি দেখলে চমকিত হতে হয়। কী গভীর পড়াশোনা! নানা দিকে ছিল রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ-আকর্ষণ, জ্ঞানতৃষ্ণা। কলকাতায় বসে তিনি যে বই সংগ্রহ করতেন, তা নয়। প্রিয়নাথের মতো বন্ধুজনরা বই উপহার দিতেন, ধার দিতেন, আবার তিনি নিজেও কিনতেন। রবীন্দ্রনাথ তো বিশ্ব-পরিক্রমা করেছেন। যখন যে দেশে গিয়েছেন, সে দেশের অনেকে তাঁকে বই উপহার দিয়েছেন। সেসব কবি পড়েছেন, ভালো বই সযত্নে রেখেও দিয়েছেন।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content