মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।

জগদীশচন্দ্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভালো বন্ধু। সুগভীর সখ্য। মাঝে মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ আসতেন জগদীশচন্দ্রের আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। জগদীশচন্দ্র যেতেন জোড়াসাঁকোয়। কত আলোচনা, কখনও সাহিত্য, কখনও বিজ্ঞান। জগদীশচন্দ্র সব সময় উদ্বুদ্ধ করতেন রবীন্দ্রনাথকে। জগদীশচন্দ্র লিখেছেন, ‘আমরা উভয়ই অপ্রসিদ্ধ ছিলাম। তখন আমার চিরবন্ধু রবীন্দ্রনাথ আমার সঙ্গে ছিলেন। সেই সব সংশয়ের দিনেও তাঁহার বিশ্বাস কোনদিন টলে নাই।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ তখনও রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেননি। ইংরেজমহলে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করে তোলার জন্য জগদীশচন্দ্রই প্রথম তৎপর হয়েছিলেন। বিলেত থেকে ‘চিরবন্ধু’ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘তুমি পল্লীগ্রামে লুক্কায়িত থাকিবে আমি তাহা হইতে দিব না।… তোমার গল্পগুলি আমি এদেশে প্রকাশ করিব।’ আবেগতাড়িত হয়ে নিতান্তই মুখের কথা নয়। জগদীশচন্দ্র ততদিনে রবীন্দ্রনাথের গল্প তরজমা করা শুরু করে দিয়েছিলেন। তরজমা করা গল্প বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়, আলোচনায় শোনাতেন।‌ বিলেতের সাহেব-বন্ধুরা চোখের জল গোপন করতে পারত না। চোখের কোণ ছাপিয়ে জল পড়ত গড়িয়ে।

একবার রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিজ্ঞানী-বন্ধুকে শিলাইদহে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। কবির আহ্বানে রাজি হয়েছিলেন বিজ্ঞানী। অবশ্য শর্ত দিয়েছিলেন একটা, প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প লিখে শোনাতে হবে তাঁকে। বন্ধুর সেই আবদার-অনুরোধ রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিত্যনতুন গল্প লিখে, সেই আনকোরা গল্প শোনাতেন জগদীশচন্দ্রকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘কথা’ কাব্যগ্রন্থ আর ‘গোরা’ উপন্যাস।
জগদীশচন্দ্র তখন বিলেতে। গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। দুর্দিনে, সংকটে বারবারই মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথকে। অর্থ-সংকটের কথা জানালেন তাঁকে। ত্রিপুরারাজ বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে প্রথম স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই যে যোগাযোগের সূত্রপাত, তা দিনে দিনে দৃঢ় হয়েছে। রাজা বদলালেও সম্পর্কে চিড় ধরেনি। যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোরের তখন বিবাহের আয়োজন চলেছে। রাজকোষেও অর্থের বাড়-বাড়ন্ত। সেই রকম পরিস্থিতিতে কবির আহ্বানে মহত্তর কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছিলেন ত্রিপুরারাজ। রাজা রাধাকিশোরের মনে হয়েছে, ‘বর্তমানে আমার ভাবী বধূমাতার দু’ একপদ অলংঙ্কর নাই বা হইল, তৎপরিবর্তে জগদীশবাবু সাগরপার হইতে যে অলংকারে ভারতমাতাকে ভূষিত করিবেন, তাহার তুলনা কোথায়?’

ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।

ত্রিপুরারাজের ঔদার্যের কোনও তুলনা হয় না। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি, অর্থ দিয়েছিলেন, সেই অর্থে জগদীশচন্দ্রের গবেষণাকর্ম ত্বরান্বিত হয়েছিল। কবির সঙ্গে এই যে বন্ধুত্বের বন্ধন, এই বন্ধনে কোনও খাদ ছিল না। নিখাদ, অন্তর উচ্চারিত ভালোবাসার বন্ধন। জগদীশচন্দ্রকে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ পুরীতেও সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। গৃহনির্মাণে উৎসাহিত করেছিলেন। জগদীশচন্দ্র এক পত্রে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘পুরীর বর্ণনা শুনিয়া আমার মন সেখানে আছে। সমুদ্রগর্জন, বাতাস ও ঢেউ আমাকে ঘেরিয়া আছে। এই সংকীর্ণ নগর ত্যাগ করিয়া প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারাইতে চাই।’
আরও পড়ুন:

খাই খাই: চিতল মাছের তো খেয়েছেন, এবার চিংড়ির মুইঠ্যার স্বাদ নিন, রইল সহজ রেসিপি

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩১: অন্ধমুনির অভিশাপ কি ফলল তবে?

প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার টানে, প্রিয়বন্ধুর সঙ্গ-সুখের প্রত্যাশায় জগদীশচন্দ্র মাঝেমধ্যেই শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে চলে যেতেন। ক-টা দিন নগরযন্ত্রণার বাইরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আনন্দে কাটিয়ে আসতেন।

শিলাইদহ যাত্রাকালে পত্নী অবলা বসুও কখনও কখনও জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও অবলার অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। তাঁর সমাজসেবামূলক নানা কর্মকাণ্ডে কবির সমর্থন ছিল। উৎসাহিত করতেন। অবলাকে লেখা কবির বেশ কয়েকটি চিঠির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে কখনও তাঁকে ‘বউঠাকুরাণী’ও সম্বোধন করেছেন। তাঁর লেখা ‘সস্নেহ পত্র’ রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করত। আনন্দ-কৌতুক মিশে থাকত।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৮: মাছের ডিম বার্ধক্যের ছাপ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়! মাছের ডিমের এই অবাক করা গুণের কথা জানতেন?

শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে জগদীশচন্দ্র সেবার পত্নী অবলাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যোদ্ধারে‌ শিলাইদহযাত্রা। কিছুদিন পদ্মাবক্ষে নৌকোতে থাকবেন, এমনই ছিল পরিকল্পনা, সে পরিকল্পনার কথা তাঁরা আগেভাগেই জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথও রাজি হয়েছিলেন।

কুঠিবাড়িতে যারা কাজকর্ম করত, তাদের কাছে অতিথি আগমনের বার্তা পৌঁছল, ক-দিন পরে এলেন কবির বন্ধু ও বন্ধুপত্নী। কর্মচারীদের ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠল। বাবামশায়ের কোনও অসুবিধা যাতে না হয়, তা নিয়ে চলল নজরদারি, আগত অতিথির জন্য হল সুব্যবস্থা।

কুঠিবাড়িতে ‌দু-একদিন থাকার পরই লক্ষ্য পূরণের‌ ব্যবস্থা হল। হাসি ফুটল জগদীশচন্দ্র ও অবলার মুখে। ঘাটে নৌকো এসে লাগল। জলে জলে টানা ক-দিন থাকা হবে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব সঙ্গে দেওয়া হল। নানা কাজে সাহায্যের জন্য বিশ্বস্ত কয়েকজন কর্মীও রইল সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র ও অবলা তিনজন উঠলেন নৌকোয়। নৌকো দুলে উঠল। পদ্মার ফুরফুরে বাতাস মুহূর্তে প্রাণ মন জুড়িয়ে দিল। মাঝি তৈরি হয়েই ছিল। দাঁড় বাইতে শুরু করল। পদ্মার স্রোতধারায় এগিয়ে চলল নৌকো।

অবলা বসু।

নৌকো ছেড়ে দেওয়ার পর কুঠিবাড়িতে ফিরে এক কর্মচারীর নজরে পড়ল, অতিথিরা যে ঘরে ছিলেন, সে ঘরের বিছানায় একটি শিশু ঘুমিয়ে আছে। দেখে তো সে হতবাক। ভাবল, এ যে সর্বনাশা কাণ্ড! ঘুমিয়ে থাকা শিশুটাকে নিয়ে যেতে বেমালুম ভুলে গিয়েছে তার মা! এ কেমন মা, কণ্ঠে ঘোরতর বিস্ময় ঝরে ঝরে পড়ল। মনে হল তার, একটু পরেই তো ঘুমিয়ে থাকা শিশুটির ঘুম ভাঙবে, কান্নাকাটি জুড়ে দেবে, তখন কী হবে! চিন্তায় দুশ্চিন্তায়‌‌ লোকটি চেঁচামেচি জুড়ে দিল। আশেপাশে যে‌সব কর্মচারী ছিল, তারা এসে তখুনি জড়ো হল।

সব শুনে, জেনে তাদের বিস্ময়ের শেষ রইল না। নৌবিহার সেরে কবে ফিরবে, তাও তো তাদের জানা নেই। এ ভাবে দুধের বাছাকে ফেলে রেখে কেউ চলে যায়, চলে যেতে পারে? এ কেমন বাবা-মা? একেবারে দায়িত্বজ্ঞানহীন যে! এসবই তাদের মনে হয়। গালমন্দ তিরস্কার কিছুই বাকি রইল না। সকলেই বিস্মিত, হতবাক। সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে তখনই এক কর্মচারী ছুটলেন নদীঘাটে। পিছু পিছু আরও কয়েকজন কর্মচারী।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২: ন্যাড়া মাথায় ভালো চুল গজায়?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২: গণমাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য এবং রাজনীতি

ততক্ষণে বেশ কিছুটা এগিয়েছে নৌকো। ঘাটে দাঁড়িয়ে তারা হই হই করছে, বলছে, সর্বনাশ হয়েছে! সে কথা রবীন্দ্রনাথের কানে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নৌকো ফেরানোর নির্দেশ দিলেন তিনি। নৌকো নদীপাড়ে ফেরা মাত্র তিনজনে একসঙ্গে নেমে এলেন। রবীন্দ্রনাথ কর্মচারীদের কাছে জানতে চাইলেন, কী হয়েছে, কী ব্যাপার!

একজন রাগত স্বরে চেঁচিয়ে বলল, দুধের বাচ্চা কুঠিবাড়িতে পড়ে রয়েছে। তাকে নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছেন।
লোকটি এ কথা অবলা বসুর মুখের দিকে তাকিয়েই বলল। শুনে জগদীশচন্দ্র মুখে কিছু বললেন না। শুধু রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে চাইলেন। অবলার মুখের দিকে তিনি ইচ্ছে করেই তাকালেন না। হয়তো পত্নীর মুখের দিকে তাকাতে পারলেন না। ততক্ষণে রবীন্দ্রনাথের কাছে সব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তিনি অন্য কোনও মন্তব্য না করে কর্মচারীদের বললেন, ভুল হয়ে গিয়েছে। যাও, খোকাকে নিয়ে এসো। সাবধানে এনো। দেখো, যেন বাছার ঘুম না ভাঙে যায়!

কবির চিঠি, বিজ্ঞানীকে।

কর্মচারীরা দ্রুত দৌড়ে কুঠিবাড়ির দিকে ফেরত গেল। তারা দৃষ্টির বাইরে চলে যেতেই রবীন্দ্রনাথ নৌকোয় উঠে বসলেন। বললেন, ভাসাও নৌকো। চলো, ও মাঝি, চলো।

জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু দু-জনেরই মুখ থমথমে। বিষাদ-অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছে। কোনোরকমে নৌকোয় উঠলেন তাঁরা। খানিক আগে যারা নদীঘাটে দৌড়ে গিয়েছিল, কুঠিবাড়িতে ফিরেই তাদের‌ ভুল ভাঙল। ভালো করে না দেখেই এত কিছু ভেবে নিয়েছিল, নদীঘাটে ছুটে গিয়েছিল, এ বার কবিকে কী বলবে, সে সব ভেবে কুঠিবাড়ির কর্মচারীরা সকলে বড়ই দিশেহারা বোধ করল।
বুঝতে পারল এটি ভুল, মহাভুল। বিছানায় যে শুয়ে আছে, সে খোকা নয়, খুকি নয়, আস্ত একটা ডলপুতুল।

অবলা বসু ছিলেন নিঃসন্তান। অনেক সময় তিনি বড় ডলপুতুলকে সঙ্গে নিয়ে সময় কাটাতেন। এই দীর্ঘ ভ্রমণে কী করে সময় কাটাবেন, তা ভেবেই হয়তো ডলপুতুলটিকে সঙ্গী করেছিলেন। তাঁর মাতৃহৃদয়ের আকুলতা কতখানি তীব্র ছিল, সন্তানহীনতার যন্ত্রণা কী ভয়ঙ্কর ছিল, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা তা সহজেই বুঝতে পারি।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content