মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


বাঙালি সুযোগ পেলেই ছোটে পুরী। প্রকৃতিময় ওড়িশায় দেখার জায়গা, ঘোরার জায়গা কম নেই। পাহাড়-সমুদ্র-জঙ্গল—অভাব নেই কিছুরই। সূচনায় চাঁদিপুর, শেষপ্রান্তে গোপালপুর। না, আমরা অন্য কোত্থাও না। যেতে চাই পুরী। বারবার, ঘুরেফিরেই চলে যাই পুরী। পুরীর প্রতি এই আগ্রহ ইদানীংকালের নয়, আগেও ছিল‌। ঠাকুরবাড়ির মানুষজনও পুরী গিয়েছেন। কেউ কেউ তো বারবার গিয়েছেন। অবনীন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকতেই স্বস্তি বোধ করতেন বেশি। তেমন দূরে কোথাও যাননি। কখনও কখনও যেতেন কাছেপিঠে। তিনিও বারবার গিয়েছেন পুরীতে। পুরী থেকে কোনারকে যাবার পথে একবার নিদারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পুরীতে একটি বাড়িও ছিল তাঁদের। সে বাড়ির নাম ‘পাথারপুরী’।‌ অবনীন্দ্রনাথ ওই বাড়িতেই সেবার উঠেছিলেন সবান্ধবে। ক-দিন পুরীতে থাকার পর ইচ্ছে জাগে কোনারক যাওয়ার। ভাড়া করা হয় পালকি। বেরোলেন রাত আটটায়, ভোরবেলায় চন্দ্রভাগায় সূর্যোদয় দেখবেন, তাই সারা রাত পালকি-পরিক্রমা।
অনেক লোকজন। পালকির সংখ্যাও কম নয়। সব মিলিয়ে পাঁচটি। সমুদ্রের ধার বরাবর পালকি কাঁধে বেহারারা চলেছে। রাতের অন্ধকারে চাঁদের আলো মিলেমিশে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছিল। অবনীন্দ্রনাথের মনে হয় ‘ভূতুড়ে পথ’। সেই ভূতুড়ে পথে ভূতেরাও নাকি যাত্রাপথের সঙ্গী হয়েছিল। পালকির সঙ্গে সঙ্গে তেনারাও চলেছে। ছমছমে রাতে, থমথমে পথে সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সত্যি-মিথ্যের তর্কে না গিয়ে বলতে হয়, সেই ভূত-শিহরন সত্যিই দারুণ উপভোগ্য। সে বিবরণ ধরা আছে অবনীন্দ্রনাথের ‘ভূত-পতরীর দেশ’-এ।
রবীন্দ্রনাথ পুরীতে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। অভিজ্ঞতাও হয়েছে বিচিত্র। প্রথমবার ওড়িশায় গিয়েছিলেন বছর তিরিশ বয়সে। নিতান্তই ভ্রমণযাত্রা নয়, গিয়েছিলেন জমিদারি তদারকি করতে। কটকের কাছাকাছি পাণ্ডুয়া, বালিয়া ও পহরাজপুরে ঠাকুরপরিবারের জমিদারি ছিল। পরের বছর আবারও ওড়িশায়। সঙ্গী ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ। কটক এসে উঠেছিলেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু বিহারীলাল গুপ্তের বাড়িতে। তাঁর আতিথ্যে কয়েকদিন কাটিয়ে জমিদারি-পরিদর্শন করে আবার ফিরে এসেছিলেন কটকে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৬: ছোটদের, একান্তই ছোটদের ‘ভাই-বোন সমিতি’

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২: অনন্তের সন্ধান আর সেই দরজার তালা ও চাবি তো তাঁর কাছেই রাখা আছে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১: স্নানের আগে রোজ সর্ষের তেল মাখেন?

কটকে ফেরার পরে বিহারীলালের পরিবারের সঙ্গে পুরীর উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন‌ রবীন্দ্রনাথ। তখন পুরী যাওয়া সহজ ছিল না। রেললাইন বসেনি। যেতে হতো স্থলপথে। স্টিমারে বা নৌকোয়। কটকে আসাও সহজ ছিল না। পুরী যেতে কটক থেকে কত সময় লাগত, তার আভাস আছে মৃণালিনী দেবীকে লেখা এক চিঠিতে। সে চিঠি থেকে জানা যায়, সকাল এগারোটায় বেরিয়ে রাতে ডাকবাংলায় থেকে পরের দিন সন্ধের দিকে পুরীতে পৌঁছনোর সম্ভাবনা। কেমন ছিল পুরীর পথ, সে বর্ণনা আছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়, ‘কটক থেকে পুরী পর্যন্ত পথটি খুব ভালো। এমনি যত্ন করে রাখা হয়েছে যে কোথাও চাকার চিহ্ন পড়তে পায় না। পথটা উঁচু— তার দুই ধারে নিম্নক্ষেত্র। বড় বড় গাছে ছায়াময়। অধিকাংশই আমগাছ। এই দীর্ঘ তরুশ্রেণীর মাঝখান দিয়ে গাঢ় গেরুয়া রঙের দিব্যি তকতকে পরিষ্কার পথে চলে গেছে— দুধারে চোষা মাঠ নেমে গেছে। আম অশ্বত্থ বট নারিকেল এবং খেজুর গাছ-ঘেরা এক-একটি গ্রাম দেখা যাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের মতো জঙ্গল পানাপুকুর ডোবা এবং বাঁশঝাড় নেই— সমস্ত দেশটি যেন ব্রাহ্মণভোজন জন্যে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে, সবসুদ্ধ বেশ একটা তীর্থের ভাব আছে।’
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সহজে শিখে নাও Transformation of Sentences by changing the DEGREES of Adjectives

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-১: চলার পথে খানিক ভণিতা

অনেক ঝকমারির পর শেষে পুরীর কাছাকাছি পৌঁছলেন। সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পথের দু’ধারের দৃশ্য বদলে গেল। মাঝে মাঝে মন্দির, রাত কাটানোর, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য পান্থশালা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুষ্করিণী। এই পরিবর্তন না হয় মেনে নেওয়া গেল। রবীন্দ্রনাথ এরপরে যা বলেছেন, তা অভাবনীয়। ফিটনগাড়িতে কবি চলেছেন। চারদিকে সন্ন্যাসী, অনেক অনেক ভিক্ষুক। ভিক্ষুকরা গাড়ির পেছন পেছন অবিশ্রান্ত দৌড়াচ্ছে, জগন্নাথ মঙ্গলবিধান করবেন, এমন আশ্বাস দিচ্ছে। অন্তত আধঘণ্টা ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে পিছু পিছু অবিশ্রান্ত দৌড়লেও এরা কেউই ভিক্ষুক নয়, ‘হৃষ্টপুষ্ট সুস্থ সবল ব্রাহ্মণ’। ব্রাহ্মণ পাণ্ডাদের দৌরাত্ম্য তখন কত তীব্র ছিল, তা এই বর্ণনার মধ্য দিয়ে টের পাওয়া যায়।
সমুদ্র রবীন্দ্রনাথের কাছে নতুন নয়। ভারতবর্ষের অন্যত্র দেখেছেন, দেখেছেন ইউরোপেও। তা সত্ত্বেও পুরীর সমুদ্র দেখে তাঁর ভালো লেগে যায়। ভাবেন সমুদ্রতীরে যদি একটি নিজের বাড়ি থাকত। এই ভালো-লাগার কথা নিজের মুখেতেই স্বীকার করেছেন, ‘পুরীর সমুদ্র যে আমার কত ভালো লেগেছে সে আমি প্রকাশ করে বলতে পারব না— এই পর্যন্ত বললেই যথেষ্ট হবে আমার মত দরিদ্র ব্যক্তি ধার করে এখানে সমুদ্রের ধারে একটা বাংলো তৈরি করবার উদ্যোগ করেছে।’

শুধু তাৎক্ষণিক ভাবনা নয়, বছর কয়েকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পুরীতে একটি বাংলো-বাড়ি কিনেছিলেন। বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ‘পোড়াবাড়ি’। সে বাড়ি দেখে উৎসাহিত হন গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথরা। তাঁরাও জমি কিনেছিলেন। বাড়ি তৈরি করেছিলেন। পুরী-ভ্রমণে গেলে ‘পাথারপুরী’তেই উঠতেন। সে বাড়ি পরে ওড়িশা সরকার অধিগ্রহণ করে ছাত্রাবাস বানিয়েছে। গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের সামান্যও স্মৃতিচিহ্ন নেই আজ আর সেখানে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১: ছুটি ও ছোটা ছুটি

খাই খাই: সন্ধেবেলা খিদে পেলে শুধুই মুড়ি মাখা? স্বাদ বদলে মুড়ি দিয়েই তৈরি করে ফেলুন এই ৩ মুখরোচক নাস্তা

রবীন্দ্রনাথও সে বাড়ি রাখতে পারেননি। অর্থ-সমস্যায় জর্জরিত তখন কবি, নিরুপায় হয়েই সাধের বাড়িটি বেচে দিতে হয়েছিল তাঁকে। বিহারীলাল গুপ্তের সঙ্গে যে বার এসেছিলেন, সে বার রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রে স্নানও করেছিলেন। ‘পুরীতে স্নানের একজোড়া ধুতি’ কেনার খরচের কথা লেখা আছে ‘নোটবহি’তে। পুরীর সমুদ্র ঘিরে মুগ্ধতা তৈরি হলেও এক পদস্থ সাহেবের আচরণ তাঁকে পীড়িত করেছিল বিহারীলালের অনুরোধে পুরীর ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অভিজ্ঞতা একেবারে সুখকর হয়নি। বিরক্ত ও অপমানিত হয়েছিলেন তিনি। সাহেবের বাড়ি পৌঁছনোর পর তার চাপরাশি এসে কবিকে জানায়, আজ নয়, পরের দিন সকালের দিকে এলে কবির সঙ্গে সাহেব দেখা করবেন। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে কবি তখনই ফিরে এসেছিলেন। বুঝেছিলেন, ‘নেটিভ’ বলেই এমন অপমানকর আচরণ তাঁর সঙ্গে সাহেব করলেন। এই অপমানের কথা রবীন্দ্রনাথ ভুলতে পারেননি। দেড় বছর পরে ‘অপমানের প্রতিকার’ শিরোনামে ‘সাধনা’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সে প্রবন্ধে এই ঘটনার কথা, মনঃপীড়ার কথা প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে।

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৭: মাছ বাজারের বর্জ্যই এখন মূল্যবান সামগ্রী প্রস্তুতের অন্যতম সেরা উপাদান হতে চলেছে

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১: অমৃতের সন্ধানে…

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১: নারী কি আলাদা? তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে বসতে ভয় পান? তাহলে কি এত আয়োজন শুধু তাঁদের ভয় দেখাতে…

রবীন্দ্রনাথ জীবন-সায়াহ্নেও একবার পুরী এসেছিলেন। সঙ্গে‌ এসেছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। ছিলেন পৌত্রী নন্দিনী, ‘পুপে’ নামেই অধিক পরিচিত তিনি। রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ দাসের আমন্ত্রণে। সেবার পুরীতে রবীন্দ্রনাথকে রাজকীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সেই সঙ্গে উদযাপিত হয়েছিল কবির‌‌ উনআশিতম জন্মদিবস। জীবন-সায়াহ্নে আগের মতো আর সমুদ্র কবিকে টানেনি। হয়তো অসুস্থতার কারণেই সমুদ্র-সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেননি। অমিয় চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে এসেছি কলকাতা থেকে; সার্কিট হাউসের দোতলায় সমুদ্রের সামনে বসে আছি একটা কেদারায়। এ সমুদ্রের প্রাণটা যেন পাণ্ডুবর্ণ, নীলিমার নিবিড়তা নেই এই জলে, ঢেউগুলো কি আমারি বুকের রক্তদোলনের মতো হাঁফধরা, শ্রান্ত একঘেয়ে শব্দ…।’ বোঝা যায়, সমুদ্রের কাছে গিয়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, অসুস্থ কবির মধ্যে মৃত্যুচেতনা গাঢ় হয়েছে।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content