শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দিনেন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বিপেন্দ্রনাথের পুত্র। রবীন্দ্রনাথের ‘বড়দা’ দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র তিনি। রবীন্দ্রনাথের থেকে একুশ বছরের ছোট। বয়েসে অনেক ছোট হলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর স্নেহময় বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল।

দিনেন্দ্রনাথ শৈশব-বাল্য থেকেই সংগীতমুখী। সংগীতে তাঁর সহজাত অনুরাগ। তখন দিনেন্দ্রনাথের বছর চারেক‌ বয়েস। ওই বয়সেই রবীন্দ্রনাথের ‘সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি’ গানটি সুর-তাল মেনে নির্ভুল গাইতে পারতেন। সেই শুরু, দিনে দিনে গানের প্রতি, বিশেষত রবীন্দ্রগানের প্রতি তাঁর আগ্ৰহ-আকর্ষণ বেড়েছে। তিনি কবিতা লিখতে পারতেন। একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল। পরে আর সেভাবে কবিতা লেখেননি। রবীন্দ্রনাথের গান‌ কণ্ঠে ধারণ করেই তাঁর ছিল যত আনন্দ। রবীন্দ্রগানের স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। রবীন্দ্রগান কণ্ঠে ধারণ করা, সেই গান স্বকণ্ঠে লালন করা— এ নিয়েই শুধু থাকেননি দিনেন্দ্রনাথ, অন্যের কণ্ঠেও সেই সংগীত সঞ্চারিত করেছেন। সংগীত-শিক্ষক হিসেবে তাঁর অভাবনীয় সাফল্য। এসব নিয়েই জীবনভর আনন্দে কাটিয়েছেন তিনি। শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথের সম্পর্কে ভাঙন ধরলেও রবীন্দ্রচর্চায়, রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসায় ভাঁটা পড়েনি। দিনেন্দ্রনাথের কণ্ঠে রবীন্দ্রগান আগের মতোই বাঙ্ময় হয়ে উঠত। পরের দিনেন্দ্রনাথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেওছিলেন, ‘তাঁর চেষ্টা না থাকলে আমার গানের অধিকাংশই বিলুপ্ত হতো।… আমার সৃষ্টিকে নিয়েই সে নিজের সৃষ্টির আনন্দকে সম্পূর্ণ করেছিল।’

গান শোনাচ্ছেন দিনেন্দ্রনাথ। পাশে রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদ।

রবীন্দ্রনাথ নিজের করা সুর তেমন মনে রাখতে পারতেন না। নিজেই জানিয়েছেন তাঁর ‘বিস্মরণের শক্তি অসাধারণ।’ এই সুর ভুলে যাওয়া নিয়ে সুধীন্দ্র-কন্যা রমা চক্রবর্তীর স্মৃতিচর্চায় একটি ঘটনার কথা আছে। রমা দিনেন্দ্রনাথের কাছে গান শিখতেন। তাঁর লেখা স্মৃতিচর্চাটির নাম ‘কাছের মানুষ দিনদা’। রমা লিখেছেন, ‘গুরুদেব নিজের গানের সুর নিজেই ভুলে যেতেন। দেখেওছি তাঁর সেবক বনমালী দিনদাকে বাড়িতে না পেলে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াত।’ আসলে রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘দিনদা’ ‘ভরসাস্থল’ হয়ে উঠেছিল। কবি গান শেখাতে বসে হামেশাই নিজের দেওয়া সুর ভুল করতেন। তেমনই এক সরসতায় ভরপুর ঘটনার কথা আছে রমা চক্রবর্তীর উল্লিখিত লেখায়। উত্তরায়ণে উৎসব উপলক্ষে গানের রিহার্সাল চলছিল। দিনেন্দ্রনাথ আসতে দেরি করায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে গুরুদেব স্বয়ং ব্যস্ত হয়ে বসে পড়েছিলেন গানের রিহার্সালে। বলেছিলেন, ‘তোরা গান শুরু করে দে। দিনু এসে পড়বে’খন।’
ছেলে মেয়েদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কবিও গান গাইছিলেন। খানিক পরেই শিক্ষার্থীদের একজন সাহস করে বলে উঠেছিল, ‘গুরুদেব আপনি যে অন্য সুরে গান করছেন!’ কথাটি অবশ্য গুরুদেব সহজ করে নিতে পারেননি।রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ও তোমাদের দিনদাই ঠিক সুর করেন, আর আমার সুর ভুল— কেমন? আরে, আমার পাঁঠা আমি ল্যাজায় কাটি কি মুড়োয় কাটি, তাতে তোদের কিরে?’

কবির কথায় সবাই হো-হো করে হেসে উঠেছিল। ঠিক তখনই দিনেন্দ্রনাথ এসে পড়েছিলেন। গানও পুরো দমে শুরু হয়ে গিয়েছিল। দিনেন্দ্রনাথের কাছে আশ্রমের ছেলেমেয়েরা যতটা সহজ হয়ে গান করতে পারত, গুরুদেবের কাছে তেমনভাবে সহজ হতে পারত না। উৎসব-অনুষ্ঠানের আগে, দুপুরবেলার দিকে দিনেন্দ্রনাথ আসতেন রিহার্সাল করাতে। শিশুবিভাগের সামনে দিয়ে মোটর চালিয়ে তাঁকে আসতে দেখলেই ছেলেরা হই হই করে বেরিয়ে পড়ত। গাড়ির ভেতরে, বাইরে, বনেটের ওপরে উঠে বসে পড়ত তারা। সারা গাড়িতে ছোটদের হইচই আর কিচিরমিচির মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। তিল ধারণের জায়গা থাকত না। রমা চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘দিনদা তখন শম্বুক-গতিতে গাড়ি চালাতেন। কিছুদূরে এসে তাদের নামিয়ে দিতেন।… তাঁর এমনই বিরাট ব্যক্তিত্ব ছিল যে ছোট বড় সবাই তাঁকে মান্য করতেন, ভালোও বাসতেন।’
আরও পড়ুন:

পর্ব-৪১: ঠাকুরবাড়িতে এসে সাহেব খেতেন ভাজা চিঁড়ের সঙ্গে কড়াইশুঁটি

সাজকাহন: স্টাইলিশ শাড়ি পরার হরেক কায়দা আছে, কিন্তু এ ভাবে শাড়ি পরা যায়, জানতেন?

হোমিওপ্যাথি: অর্শে কষ্ট পাচ্ছেন? রেহাই পেতে জেনে নিন কী করবেন, কী করবেন না

ছোটদের যত্নে: শিশুকে টনসিলের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে চান? মেনে চলুন শিশু বিশেষজ্ঞের এই সব টিপস

ছোটরা দিনেন্দ্রনাথকে কাছে পেলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হত। বিশাল বপু—দূর থেকে দেখে তারা হই হই করে উঠত। হোক না বিশাল চেহারার অধিকারী, এই বিশালত্বের পরতে পরতে কত মায়া জমে ছিল, সে খবর আমরা রাখি না। ছোটদের প্রতি দিনেন্দ্রনাথের সুগভীর ভালোবাসা ছিল, এমনকি পশু-পাখিদের প্রতিও ভেতর থেকে উঠে আসা ভালোবাসার অভাব ছিল। শুধু কুকুর নয়, পুষেছিলেন একটি হরিণও। হরিণটি হঠাৎই একদিন আপন খেয়ালে আশ্রম ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিল। হৃদয়হীন কয়েকজন গ্রামবাসী তাকে মেরেও ফেলে। এই নিদারুণ ঘটনাটি স্নেহকাতর দিনেন্দ্রনাথকে কষ্ট দেয়। তাঁর পত্নী কমল শোকে কাতর, পাথর হয়ে পড়েন। দুঃসহ সে বেদনা। রবীন্দ্রনাথকেও হরিণ-হত্যার মর্মান্তিক ঘটনাটি আলোড়িত করে। আলোড়িত কবি এই অভিঘাতে একটি গান লিখেছিলেন, ‘সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে।’
আরও পড়ুন:

যোগা-প্রাণায়াম: প্রসাধনী নয়, স্রেফ যোগাভ্যাসে বাড়ান ত্বকের জেল্লা!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৩: আশা-যাওয়ার পথের ধারে ‘নবীন যাত্রা’ [১১/০৯/১৯৫৩]

ইংলিশ টিংলিশ: আজকে এসো দেখি Prefix আর Suffix কাকে বলে

ট্রেনের টিকিট ‘কনফার্ম’ না হলে একেবারে বিনামূল্যে বিমানের টিকিট পাবেন যাত্রীরা! কোন অ্যাপে, কীভাবে পাবেন?

দিনেন্দ্রনাথ প্রয়াত হওয়ার পরে তার স্ত্রী কমল উদ্যোগী হয়ে ‘দিনেন্দ্র রচনাবলি’ প্রকাশ করেছিলেন। দিনেন্দ্রনাথের লেখা ছাড়াও এই সংকলনে গুণমুগ্ধ প্রিয়জনের স্মৃতিচারণ গ্রন্থিত হয়েছিল। বইটির মালাট এঁকে দিয়েছিলেন নন্দলাল বসু। হ্যাঁ, সেই মলাট অঙ্কিত হয়েছিল ‘সে কোন বনের হরিণ’ গানটি অবলম্বনে।

সংগীতময় দিনেন্দ্রনাথের জীবন। রবীন্দ্রনাথের গানকে ভালোবেসে সে গান কণ্ঠে ধারণ করে, লালন করে নিজের কবিতাকে তিনি বিদায় জানিয়েছিলেন। একটিই দিনেন্দ্রনাথের বই, আর কখনও কবিতা লেখেননি। প্রথম জীবনে লেখা তাঁর কবিতায় যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি ছিল, তাও কেউ মনে রাখিনি। নিজের জীবনটুকু দিনেন্দ্রনাথ সঁপে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথে। শেষের দিকে এই সম্পর্কে যখন ভাঙন ধরে, শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসেন, তখনও তিনি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, সম্পত্তি থেকে দিনেন্দ্রনাথের এই বঞ্চিত হওয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথ উচ্চ-বাচ্য করেননি।

আশ্রম বালকদের মাঝে সংগীত- শিক্ষক দিনেন্দ্রনাথ।

‘রবিদাদা’-র সেই নিরুত্তাপ আচরণ তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল। চিরদিনের মতো শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন‌ দিনেন্দ্রনাথ। কলকাতায় ফিরে এসে মাসে মাসে ভাড়া দিয়ে পত্নী কমলকে নিয়ে ‘বিচিত্রা’য় থাকতেন তিনি। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন। হই হই করে শান্তিনিকেতনে যিনি দিন কাটাতেন, তাঁর পক্ষে এই বন্দিজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল। মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এই সময় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আসে এক অপমানকর প্রস্তাব। বলা হয়, দিনেন্দ্রনাথ যদি মাসমাইনের বিনিময়ে শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন। প্রস্তাবটি নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বভারতী কর্মী চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। সে প্রস্তাব শুনে দিনেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আপনি নতুন মানুষ তাই আপনাকে পাঠিয়েছে বলতে, ওদের কারও সাহস হয়নি এসে আমায় বলতে।’
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৬: ‘সত্যেরে লও সহজে’—রাজসুখ ছেড়ে কি তবে বনবাসী মন?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৫: পরশুরামের আশ্রমে এসে পৌঁছলেন পাণ্ডবেরা

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব -২৪: ন্যাশনাল থিয়েটারে মধুকবির ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র গিরিশচন্দ্রের নাট্যরূপ মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩০: ডাঙার প্রাণীরা পর নির্ভরশীল হলেও সামুদ্রিক প্রাণীরা কিন্তু স্বনির্ভর

রবীন্দ্রনাথ গানের ভাণ্ডারীকে জীবন-সায়াহ্নে ভুলই বুঝেছিলেন। দিনেন্দ্রনাথ তখন‌ কলকাতায় প্রায়-নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। কর্মমুখর রবীন্দ্রনাথের ভুলেও মনে পড়েনি তাঁকে। সংগীত-সংকলন প্রকাশকালে দিনেন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা স্মরণ করে একটি-দুটি শব্দও ব্যয় করেননি কবি। দিনেন্দ্রনাথ প্রয়াত হবার পরে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, সমূহ ক্ষতি হয়ে গেল তাঁর। অমিতা সেনকে লিখেছিলেন, ‘মনে হচ্চে আমার জীবনের একটা অংশ যেন ভেঙে পড়ে গেল।’ বেদনা আরও গভীর, আরও ঘণীভূত হয়েছিল। নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখেছিলেন, ‘দিনুর হাতে ছিল আমার সব গানগুলো— মনে হচ্ছে যেন গানের জাহাজ ডুবি হয়ে গেল। আমার গানের পালা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছিল। অনেকদিন গান তৈরি করিনি—এইবার বোধ হচ্চে থামল।’

দিনেন্দ্রনাথের একমাত্র কাব্যগ্রন্থ, 'বীণ'। সে বইয়ের আখ্যাপত্র।

দিনেন্দ্রনাথ আত্মগৌরব চাননি, খ্যাতি চাননি। চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংগীত সম্প্রসারিত হোক, সংরক্ষিত হোক, এটাই তাঁর জীবনের ব্রত হয়ে উঠেছিল। নিজেকে আড়ালে রাখা দিনেন্দ্রনাথের উদারতার কথা, মহত্ত্বের কথা আমাদের জানা হয়নি। শিশুদের সঙ্গে তিনি মিশতে ভালোবাসতেন। শিশুর সারল্যে তাঁর জীবন ভরপুর হয়ে উঠেছিল। সেই সারল্যের সঙ্গে কাঠিন্যের লড়াইয়ে অবশ্য দিনেন্দ্রনাথ পরাজিতই হয়েছিলেন।
ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content