গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সাহেবসুবোরা গগনেন্দ্রনাথকে খুব খাতির করতেন। পরাধীন দেশের এই শিল্পীকে তাঁরা প্রাপ্য সম্মান জানাতে কখনও দ্বিধা করেননি। বসিয়েছিলেন সম্ভ্রমের আসনে। সাহেবসুবোরা অনেকেই গগনেন্দ্রনাথের কাছে আসতেন। সব থেকে বেশি হৃদ্যতা ছিল কারমাইকেলের সঙ্গে। লাটসাহেব ঠাকুরবাড়িতে আসতেন। গল্পগাছা করতেন। কথার পিঠে কথা। কথা আর ফুরোতে চাইত না। গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিপ্লবীদের সুসম্পর্ক ছিল। সমর্থন ছিল তাঁদের কর্মকাণ্ডে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তখন ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। চলেছে দমন-পীড়ন। বিপ্লবীরা ছেড়ে কথা বলার লোক নন, তাঁরাও ফুঁসে ওঠেন। সাহেবদের গাড়িতে বোমা ছোঁড়েন। চলে যথেচ্ছ গ্ৰেপ্তার। বিপ্লবী নরেন গোঁসাই জেলেই খুন হন। উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে বিলেত থেকে টেগার্ট নামে এক জাঁদরেল সাহেব আসে। দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো, অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। হঠাৎই একদিন জোড়াসাঁকোয় পুলিশ এলো। আসার উদ্দেশ্য একটাই বাড়ি সার্চ করবে তারা। বাড়িতে থাকার মধ্যে ছিল ‘আনন্দমঠ’, ছিল স্বাদেশিকতাবোধ-জাগানিয়া ওই ধরনের কয়েকটি বইপত্তর। গগনেন্দ্রনাথের কথা মতো সেসব লুকিয়ে ফেলা হয়। ইংরেজ সরকারের পুলিশকে হতাশ হয়ে কিছু না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। নানাভাবে গগনেন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের সাহায্যও করতেন। এসব কি গগনেন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব-প্রত্যাশী সাহেবসুবোরা জানতেন না? লাটসাহেব জানতেন না? জানতেন। তা সত্ত্বেও এসব নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাননি। শত্রু নয়, তাঁকে মিত্রই ভেবেছেন।
গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি।
জোড়াসাঁকোয় সাহেবসুবোরা গগনেন্দ্রনাথের কাছেই বেশি আসতেন। গগনেন্দ্রনাথ আবার তাঁদের সঙ্গে ‘রবিকাকা’-র পরিচয় করিয়ে দিতেন। রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ততা ভুলে মগ্ন হতেন আলাপচারিতায়।
লাটসাহেবরা অনেকেই জোড়াসাঁকোয় এসেছেন। সব থেকে বেশি এসেছেন কারমাইকেল। গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন কারমাইকেলের পূর্ব পরিচিত। ক্যালকাটা ক্লাবে হয়েছিল তাঁদের পরিচয়। সেই পরিচয় শুধু চেনা-জানার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জোড়াসাঁকোয় যাতায়াতের মধ্য দিয়ে দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে।
কারমাইকাল কলকাতা এলে তাঁর সেক্রেটারি ফোন করে গগনেন্দ্রনাথের কাছে জানতে চাইতেন, সাহেব দেখা করতে চান, সময় দিতে পারবেন কিনা! একদিন দুপুরে এলো তেমনই এক ফোন। সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, ‘সাহেব আপনাদের বাড়িতে যেতে চান, আপনার কোনও অসুবিধা হবে না তো!’ গগনেন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলেন, আসুন, কোনও অসুবিধা নেই তাঁর।
লাটসাহেবরা অনেকেই জোড়াসাঁকোয় এসেছেন। সব থেকে বেশি এসেছেন কারমাইকেল। গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন কারমাইকেলের পূর্ব পরিচিত। ক্যালকাটা ক্লাবে হয়েছিল তাঁদের পরিচয়। সেই পরিচয় শুধু চেনা-জানার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জোড়াসাঁকোয় যাতায়াতের মধ্য দিয়ে দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে।
কারমাইকাল কলকাতা এলে তাঁর সেক্রেটারি ফোন করে গগনেন্দ্রনাথের কাছে জানতে চাইতেন, সাহেব দেখা করতে চান, সময় দিতে পারবেন কিনা! একদিন দুপুরে এলো তেমনই এক ফোন। সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, ‘সাহেব আপনাদের বাড়িতে যেতে চান, আপনার কোনও অসুবিধা হবে না তো!’ গগনেন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলেন, আসুন, কোনও অসুবিধা নেই তাঁর।
লাটসাহেব আসবে বলে কথা! মুহূর্তে বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। দারোয়ান- চাকরবাকর- বেয়ারা সবাই মিলে ঘরদোর পরিষ্কার করতে শুরু করে দিল। ভেতরের বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা হইহল্লা করবে, তা তো আর মেনে নেওয়া যায় না। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাগানে। সাহেব বলে কথা, তাঁকে বসানোর ব্যবস্থা কোথায় হবে, কেন লাইব্রেরি ঘরে। হ্যাঁ, প্রতিবারই এমন ঘটতো। সে বর্ণনা আছে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা পূর্ণিমা দেবীর লেখায়। লাটসাহেব তো মাঝে মাঝেই আসতেন। তিনি এলে ঘরের বসার জায়গার কিছু অদল-বদল করা হতো। তক্তপোষে গদি সাজানো বিছানা, বিছানায় সাদা চাদর, আরামকেদারা। আরও কত কী। নতুন সংযোজনের পাশাপাশি আবার পুরনোকে ঝকঝকে করার ব্যবস্থা চলত। ভেজা কাপড় দিয়ে আসবাবপত্র মোছা হতো।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪০: রবীন্দ্রনাথকে দারোয়ান ভেবে দৌড়ে পালিয়েছিল চোর
ছোটদের যত্নে: শিশুকে টনসিলের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে চান? মেনে চলুন শিশু বিশেষজ্ঞের এই সব টিপস
বাইরে দূরেঃ অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি
গগনেন্দ্রনাথ পাটভাঙা কাপড়ের ওপর জোব্বা পরে লাটসাহেবকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রতিবারই তৈরি থাকতেন। লাটসাহেব ঘড়ি মিলিয়ে আসতেন। গগনেন্দ্রনাথ নিচে গিয়ে স্বাগত জানিয়ে, পথ দেখিয়ে তাঁকে ওপরে নিয়ে আসতেন। কারমাইকেল সাহেব আরামকেদারায় বসতেন না, বসতেন বিছানায়, ঠিক গগনেন্দ্রনাথের পাশে। গড়গড়ায় তামাক খেতেন। বাড়িতে চিঁড়েভাজা হলে সেই চিঁড়েভাজার সঙ্গে কড়াইশুঁটি দিয়ে খেতে তিনি খুব ভালবাসতেন। গগনেন্দ্রনাথের কন্যা পূর্ণিমা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, একবার চিঁড়েভাজা টিনের কৌটোয় করে বিলেতের বাড়িতে কারমাইকেল সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন। সে দেশের বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়পরিজন বাংলার চিঁড়েভাজা খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিল।
গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি।
গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে এত সখ্য, অথচ সে বন্ধুত্বের কোনও ছবি তুলে রাখেননি তিনি। কন্যা পূর্ণিমা লিখেছেন, ‘অনেক লোক ছিল যারা লাটসাহেবের পাশে নিজের ছবি তোলাতে খুব গর্ববোধ করত। বাবা কিন্তু বিদেশি লাটের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভালোবাসলেও তাঁর সঙ্গে ছবি তুলে গর্ব করা পছন্দ করতেন না। ছবি তোলার অনেক সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু কখনও ছবি তোলাতে চেষ্টা করতেন না।’
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৪: শোকবিহ্বল মা, ক্ষোভে উত্তাল ভাই — তবুও কি বনবাস?
খাই খাই: অতিথি আপ্যায়নে চাই পাঁঠার মাংসের লোভনীয় পদ? চিন্তা নেই ১০ মিনিটেই জমে যাবে পুজোর ভূরিভোজ! কেমন করে?
দশভুজা: আমার উড়ান— থামতে শেখেননি ইন্দুবেন, বড়া পাও-তেই বাজিমাত!
সাহেব এলে তাঁর দুজন বডিগার্ড ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির সামনে রাস্তায় টহল দিত। টহল দিতে দিতে ক্লান্ত বা বিরক্ত হয়ে পড়লে বাড়িতে খবর পাঠাত। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, জানতে চাইত তারা। সাহেব এলে আশপাশে ঘোরাঘুরি করতেন গগনেন্দ্রনাথের পুত্র কনকেন্দ্রনাথ। যদি প্রয়োজন হয়, গগনেন্দ্রনাথ প্রতিবারই তাঁকে থাকতে বলতেন। বডিগার্ডের বার্তা লাট সাহেবের কাছে তিনিই জানাতেন। কনকেন্দ্রনাথের কথা কানে তুললেও লাট সাহেব একটুও বিরক্ত হতেন না। মুখে হাসি ছড়িয়ে বলতেন, ‘পরে যাব।’ এ কথা বলে আবার তিনি গল্প করতে শুরু করতেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। সে গল্প থামত না। শেষে লাট সাহেবের লাট ভবন থেকে সেক্রেটারি ফোন করতেন। বলতেন, ‘ডিনারের টাইম হয়ে গিয়েছে। আসুন।’ যাচ্ছি-যাচ্ছি করে সাহেব আরও কিছুটা সময় ব্যয় করে ফেলতেন।
গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
কারমাইকেল সাহেব গগনেন্দ্রনাথকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। হয়তো দার্জিলিংয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা। সপরিবারে পাহাড়িপথে গগনেন্দ্রনাথ হেঁটে চলেছেন। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা সাহেব তাঁকে দেখতে পেয়েই হেসে টুপি খুলতেন। গগনেন্দ্রনাথ প্রতিনমস্কার করতেন। সে সব দেখে পূর্ণিমার মনে হয়েছিল, ‘দেশি মনোভাব থাকলেও বিদেশিদের সঙ্গে বাবার কোনও সহজাত শত্রুতা ছিল বলে মনে হতো না।’
গগনেন্দ্রনাথ সিল্কের রুমাল ব্যবহার করতেন। কারমাইকেল সাহেব একবার সেই রুমাল দেখে বলেছিলেন, ‘আমার ওই রকম রুমাল এক ডজন দরকার।’ কোথায় পাওয়া যায় জানা ছিল, গগনেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে এক ডজন রুমাল দোকান থেকে আনিয়ে সাহেবকে উপহার দিয়েছিলেন।
খুশি হয়ে কারমাইকেল জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় এ জিনিস তৈরি হয়। গগনেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সে খবর তার জানা নেই। গগনেন্দ্রনাথের উত্তরে সাহেব সন্তুষ্ট হননি। বলেছিলেন, ‘দেখো তোমাদের দেশের জিনিস, অথচ তোমরা জানো না কোথায় তৈরি হয়!’
গগনেন্দ্রনাথ সিল্কের রুমাল ব্যবহার করতেন। কারমাইকেল সাহেব একবার সেই রুমাল দেখে বলেছিলেন, ‘আমার ওই রকম রুমাল এক ডজন দরকার।’ কোথায় পাওয়া যায় জানা ছিল, গগনেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে এক ডজন রুমাল দোকান থেকে আনিয়ে সাহেবকে উপহার দিয়েছিলেন।
খুশি হয়ে কারমাইকেল জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় এ জিনিস তৈরি হয়। গগনেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সে খবর তার জানা নেই। গগনেন্দ্রনাথের উত্তরে সাহেব সন্তুষ্ট হননি। বলেছিলেন, ‘দেখো তোমাদের দেশের জিনিস, অথচ তোমরা জানো না কোথায় তৈরি হয়!’
আরও পড়ুন:
ইংলিশ টিংলিশ: Appropriate Prepositions কাকে বলে জানো কি?
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৩: সমুদ্রশোষণ তো হল, এবার পূরণ করবে কে?
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে
সাহেবের কথা শুনে গগনেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, সত্যিই জানা দরকার। এ তো ঘোরতর অন্যায়! তখুনি খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষে জানা গেল, এই সিল্কের রুমাল মুর্শিদাবাদে তৈরি হয়। জানার পর কারমাইকেল সাহেবকে গগনেন্দ্রনাথ সেকথা জানিয়েছিলেন। শুনে সাহেব গগনেন্দ্রনাথকে সচেতন করার চেষ্টা করে বলেছিলেন। ‘কোথায় তৈরি হয়, কারা তৈরি করে, সেসব তোমাদের জানা দরকার। স্বদেশি জিনিস তো!’
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।
* কিম্ভূতকাণ্ড (Kimbhoot kanda – Horror Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।