মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


হেমন্তবালা দেবী।

‘কবি আষাঢ় মাসে কলকাতায় এলেন। আমার ভাই গিয়েছিলেন দেখা করতে। কবি বললেন, ‘বীরেন্দ্রকিশোর, তোমার দিদি ইস্কুল-কলেজে পড়েননি, কিন্তু তাঁর লেখা দেখে তা বোঝা যায় না।’…আমাকে একবার দেখতে চাইলেন। আমার ছেলে, বাড়ির অন্য সকলের প্রতিকূলতায় পাছে বিঘ্ন ঘটে এ জন্য অন্য সকলের অগোচরে… আমাকে নিয়ে জোড়াসাঁকোয় যান, সেই প্রথম দর্শন। সেই মুহূর্ত থেকেই আমার জীবনে একটি স্মরণীয় পরিবর্তন আসে।… মনে হয়েছিল, আমি ‌তীর্থস্নান করে উঠলাম।’

নিজের হৃদয়ানুভূতির কথা এ ভাবেই প্রকাশ করেছিলেন হেমন্তবালা দেবী। তাঁর মনের কোণে আলোর পিদিম জ্বেলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে আলো নিভে যায়নি। গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। অভিজাত হয়েও রক্ষণশীল, এমনই এক জমিদার পরিবারের কন্যা তিনি। হেমন্তবালার পিতা ছিলেন ময়মনসিংহের দানবীর সংস্কৃতিমনস্ক সঙ্গীতপ্রিয় জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। বধূ হিসেবে যে পরিবারে গিয়েছিলেন, নাটোরের সে পরিবারটিও ছিল চিন্তায় চেতনায় রক্ষণশীল। আভিজাত্য-বৈভব কম ছিল না তাঁদের। হেমন্তবালা বিয়ের আগে তো বটেই, বিয়ের পরেও মানসিক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়েছেন। দম-বন্ধ করা সেই জীবনের বাইরে এসে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। সংসার-জীবনের‌ সীমাবদ্ধতা হেমন্তবালাকে ক্লান্ত করেছিল। ধর্মজীবনে চিন্তার প্রসারণ ঘটে, এমনই মনে হয়েছিল তাঁর, তাই আঁকড়ে ধরেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ : যখন হেমন্তবালাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন।

সংসারজীবন ও ধর্মজীবনের টানাপোড়েনে মনের অস্থিরতা তখন তীব্র, ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমন্তবালার যোগাযোগ। দিশাহীন জীবনে‌ দিশা মেলে, ক্রমেই কবির প্রতি তাঁর নির্ভরতা বাড়ে। হেমন্তবালা লিখেছেন, ‘আমার প্রয়োজন ছিল একটা দৃঢ় অবলম্বন লাভ করবার। আমি তখন হাল-পাল-বিহীন নৌকার অবস্থায় আছি।’

রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ-বেলায় হেমন্তবালাকে লেখা অজস্র চিঠিতে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। টানা দশ বছর চলছে‌ এই পত্রচর্চা, পত্রের আদানপ্রদান।

হেমন্তবালা উপলক্ষ, এই সব চিঠিতে কবি আসলে বৃহত্তর পাঠকের কাছে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। হেমন্তবালা কত না জটিল প্রশ্নের, ভাবনার অবতারণা করেছেন! কবিও নিজের মতো করে উত্তর দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মনোজগৎ উন্মোচিত হওয়ায় তাঁকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হয়েছে। জীবনবোধের কথা, ধর্মবোধের কথা কবি যেমন জানিয়েছেন হেমন্তবালাকে, তেমনই নিজের জীবনকাহিনি, নানা ঘটনাবলিও বলেছেন। হেমন্তবালার লেখা থেকে জানা যায়, কখনও কবি তাঁকে বলেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কথা, কখনও-বা জানিয়েছেন প্রদেশান্তর থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল তাঁর, সে-আখ্যান। অফুরান কবির গল্প-ভাণ্ডার। প্রশান্ত মহালানবিশের বাড়িতে ডাকাত পড়ার গল্প। বিছে কামড়ানোর গল্প। কোচবিহারের মহারানির অনুরোধে গল্প লেখার কথা, এমনকি ভূত দেখার গল্পও হেমন্তবালাকে জানিয়েছেন কবি।
হেমন্তবালা অকপটে লিখেছেন, ‘আমি তো শিক্ষিত নই, আদব-কায়দা জানি না, আমার কথাবার্তায়-চিন্তায়-আচরণে যথেষ্ট মূঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে, সন্দেহ নাই। তবু আমি তাঁকে ছাড়তে বা ভুলতে পারিনি। সে এক অনিবার্য আকর্ষণে।’

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, কখনও-বা চিঠিতে নানা জিজ্ঞাস্য জেনে নিয়ে হেমন্তবালা নিজেকে যেন ফিরে পেয়েছিলেন। চিন্তা-ভাবনা, বোধ-অনুভবের উত্তরণ ঘটেছে। তাঁর লেখায় আছে, ‘কেমন করিয়া ধীরে ধীরে আমি তাঁহার নিকটস্থ হইলাম — একদিন দর্শনও পাইলাম। ক্ষুব্ধ-অশান্ত মন লইয়া তাঁহার কাছে আসিয়াছিলাম, আমি তাঁহার পথের পথিক ছিলাম না, তাহার আপনজন বা অন্তরঙ্গ ছিলাম না, আমি অন্যমতের জীব, ক্ষণিকের অতিথি, অন্য পথের পান্থ আমি, ক্ষণিকের জন্য আসিয়া মায়ায় জড়িত হইয়া পড়িলাম। একটু স্নেহ, একটু করুণা, একটু সমবেদনা ও সহানুভূতির স্পর্শ, একটু সৌহার্দ্য, যাহা তখন আমার ক্ষুধিত পিপাসিত প্রবঞ্চিত আর্তচিত্তের কাম্য ছিল, তাহাই তাঁহার কাছে পাইয়াছিলাম।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-২: তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পর্যটন স্পট কক্সবাজার

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২০: আকস্মিক অভিঘাত-আনন্দের পাত্রে বিষাদবিষ

এ তো পরম প্রাপ্তি! রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালাকে বলতেন ‘জোনাকি’। খ্যাতির শিখরস্পর্শী তিনি, সেই বোধ কবির মনে কখনও জেগে ওঠেনি। হেমন্তবালার সঙ্গে প্রিয়জনের মতোই তিনি মিশতেন। চরম জাগতিক যন্ত্রণায় বুলিয়ে দিয়েছেন সান্ত্বনার প্রলেপ। প্রাণরসে উজ্জীবিত হয়েছেন‌ হেমন্তবালা। রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হওয়ার পর আবেগতাড়িত হয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘উঁহার সংস্পর্শে আমি মুক্তির আনন্দ পাইতাম।’ সেই আনন্দ উপভোগ করার জন্য জোড়াসাঁকোয়, বরানগরে, খড়দহে, বেলঘরিয়ায়, কোথায় না গিয়েছেন হেমন্তবালা! পুরনো স্মৃতি হাতড়ে মনে বিস্ময় জেগেছে‌ তাঁর।‌ বিস্ময়াচ্ছন্ন হয়ে বলেছেন, ‘আমার মত ঘোর বিরুদ্ধপক্ষীয়া, অশিক্ষিতা, শিষ্টাচারে অনভিজ্ঞা, মূর্খ স্ত্রীলোককে দীর্ঘদিন ধরিয়া যাবতীয় দোষত্রুটি-সমেত সহ্য করিয়াছিলেন, আজ সে কথা ভাবিলে আশ্চর্যান্বিত হই।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭: হারিয়ে যাওয়ার আগে এ এক বিফল মৃত—‘সঞ্জিবনী’ [০৮/০২/১৯৫২]

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮: জৌলুসে শোভনীয়, রসনায় অতুলনীয় বরোলি যেন না হারায়!

ইংলিশ টিংলিশ: জানো কি ‘বাজি ফাটানো’ কিংবা ‘মোমবাতি জ্বালানো’র ইংরেজি কী?

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল হেমন্তবালার গভীর প্রীতিময় সম্পর্ক। একবার নিজের জন্মদিনে তিনি পরিহাস করে কবিকে বলেছিলেন, কবির জন্মদিনে কতজন কত কী উপহার দেয়, কবিতাও লিখে দেয়। হেমন্তবালার জন্মদিনে তিনি যদি একটি কবিতা লিখে আশীর্বাদ করেন, তাহলে বিশেষভাবে খুশি হবেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা রেখেছিলেন। জন্মদিনে পাঠিয়েছিলেন কবিতা লিখে।

হেমন্তবালা সাহিত্যে মগ্ন হয়ে দিন কাটননি। কদাচিৎ কিছু লিখেছেন, কলম ধরেছেন। তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের যে ২৬৪টি চিঠি রয়েছে, সে-সব চিঠিতে বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবির গভীর প্রীতিময়তা। হেমন্তবালার মনে সাহিত্যতৃষ্ণা বাড়ুক চেয়েছিলেন কবি। তাঁর মুগ্ধতা এ ভাবে ধরা পড়েছে, ‘তোমার চিঠি থেকে তোমার লেখা কিছু কিছু আমার চুরি করতে ইচ্ছে করে।… তোমার মধ্যে দেখবার দৃষ্টি, ভাববার মন, লেখবার কলম ও হৃদয়ের আবেগ একসঙ্গে মিলেচে।’

সেই জোব্বা : যা হেমন্তবালার কন্যাকে কবি দিয়েছিলেন।

লোকসাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বরাবরই প্রবল আনুগত্য। সংগ্রহের কাজে নিজেও মনোনিবেশ করেছিলেন। রূপকথার গল্প হেমন্তবালা লিখুন, চেয়েছিলেন কবি। লিখেছিলেন, ‘তোমার চিঠির সঙ্গে এক টুকরো রূপকথা পাঠিয়েছ। সম্পূর্ণ করো না কেন?… যত পার রূপকথা সংগ্রহ করে একখানা বই যদি বের কর, খুব কাজে লাগবে।’

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ লিখতে বসে কবির সাজপোশাকের কথাও হেমন্তবালার মনে পড়েছে। কত রং-বাহারি পোশাক-আশাকই না কবি পরতেন! কত রঙেরই না জব্বা ছিল রবীন্দ্রনাথের, সেসব মনে পড়ে গিয়েছে। চকলেট রংয়ের ওপর ঈষৎ লালচে বেগুনি-রঙের আভাস দেওয়া খদ্দরের জোব্বা, ঘন গেরুয়া রঙের জোব্বা, লাল বেনারসি কাপড়ের জোব্বা, অগ্নি বর্ণের রেশমি রঙের গরম কাপড়ের জোব্বা। কবির জোব্বা এত রং-বাহারি ছিল, তা সাদাকালো ছবিতে আমাদের বোধগম্য হয় না। হেমন্তবালার লেখা পড়ে কবির যে সাজসজ্জার ব্যাপারে মনোযোগ ছিল, তা অনুমান করা যায়। পাণ্ডু বর্ণের জোব্বাও পরতেন । চাপকান ও লুঙ্গি পরতেও দেখেছেন হেমন্তবালা। গরদের ধুতি-চাদর-পাঞ্জাবিও পরতেন রবীন্দ্রনাথ। গান্ধীজির সঙ্গে তো তেমন মতের মিল নেই। তা সত্ত্বেও কেন খদ্দর পরিধান? হেমন্তবালার ‌এ প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ শুধুই হেসেছিলেন।

কবির চিঠি : হেমন্তবালাকে লেখা।

হেমন্তবালা কন্যার জন্য কবির স্মৃতি হিসেবে ব্যবহৃত একটি জোব্বা চেয়েছিলেন। শুধু জোব্বা নয়, একটি কলম চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি পোর্টফোলিও। হঠাৎ করে এসব চাওয়ায় কবি হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আজ সকালে তুমি কার মুখ দেখে উঠেছিলে?’ কেন এমনতরো প্রশ্ন, হেমন্তবালাকে কবি বলেছিলেন, ওই কলম দিয়ে তিনি অনেক লেখাই লিখেছেন। কলমটি সাবধানে রাখতে হবে। যেন চুরি না হয়।

কবি সারাক্ষণই প্রিয়জনদের সঙ্গে রসিকতা করতেন। হেমন্তবালার হাতে আকাঙ্ক্ষিত সামগ্রী তুলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, কন্যাটিকে অত্যন্ত স্নেহ করেন তিনি। সেকারণেই এত কিছু দিলেন। অন্য কেউ হলে দিতেন না। ‘অন্য কেউ’ আর কেউ নন, হেমন্তবালা স্বয়ং, কবি যে তেমনই বোঝাচ্ছেন, তা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content