শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার প্রথম ছোটদের পুজো বার্ষিকী।

উৎসবকে কেন্দ্র করে এমন বিপুল সাহিত্য সৃষ্টি অন্য কোনও দেশে, অন্য কোনও ভাষায় হয় না। রবীন্দ্রনাথের কালে শারদোৎসবকে ঘিরে পত্রিকার পৃথক সংখ্যা প্রকাশের প্রাবল্য ছিল না। শারদ-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ঠাকুরবাড়ির ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ঠাকুরবাড়ির ‘ভারতী’ প্রথমদিকে না হলেও অন্তিমকালে পুজোসংখ্যা প্রকাশ করেছিল। শারদোৎসবে ছোটদের জন্য বার্ষিকী প্রকাশেও ঠাকুরবাড়ির ভূমিকা রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রথম বার্ষিকী ‘পার্বণী’ প্রকাশিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়। ‘পার্বণী’ প্রকাশের আড়ালে রবীন্দ্রনাথের ছিল সক্রিয় সমর্থন। যে পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখতেন সবচেয়ে বেশি, সেই ‘প্রবাসী’-র কখনও শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি। সমকালের আরেক উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’-এরও শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হতো না। আসলে এখন যে পরিমাণে শারদীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়, লেখকদের যতখানি চাপ থাকে, তখন তার ভগ্নাংশও ছিল না। জীবনের শেষের দিকে অবশ্য অনেকগুলি শারদীয় সংখ্যাতেই লিখতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। সাময়িকপত্রের পুজো সংখ্যায়, দৈনিকপত্রের পূজার সংখ্যায়, তাঁর লেখা বাদ দিয়ে শারদীয় সংখ্যার প্রকাশ ছিল অভাবনীয়। যেমন তিনি ‘বিজলী’, ‘বাতায়ন’ বা ‘দেশ’-এর শারদীয় সংখ্যায় লিখেছেন, তেমনই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে লেখা দিতে হয়েছে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’কে। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই সমাজের কাছে, মানুষের কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না, অন্তর থেকে উৎসারিত। তাই বারবার বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধ্যাতীতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি, শারদীয় সংখ্যায় লেখার কথা দিয়ে পাওয়া আগাম সম্মান-দক্ষিণা অকাতরে বিপন্ন মানুষের উদ্দেশে দান করেছেন। ঘটনাটি ১৯৩৫-এর। কবি বয়সের ভারে তখন খানিক কাবু হয়ে পড়েছেন। অশক্ত শরীর, তৈরি হয়েছে নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। এই অবস্থাতেও রবীন্দ্রনাথ মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘প্রবাসী’ পত্রের সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর প্রিয় বান্ধব। রামানন্দের প্রত্যক্ষ প্রেরণাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসটি। পরস্পরের মধ্যে গভীর সৌহার্দ্য, প্রীতিময় সম্পর্ক। তাই রবীন্দ্রনাথ সব কথা অকপটে বলতে পারতেন রামানন্দকে। রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে। ২৯ অগস্ট ১৯৩৫ লেখা এক পত্রে কবি রামানন্দকে লিখেছিলেন, ‘এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুদ্ধ ছিল। এমন সময় দেশ ও আনন্দবাজারের দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্য একশো টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অসুস্থ, বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কলম তখন আর সেভাবে সক্রিয় ছিল না। বন্ধু রামানন্দকে লিখেছিলেন, ‘ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।’ সেই পরিস্থিতিতেও লিখে যেটুকু উপার্জন করেছিলেন, তা বন্যাপীড়িতদের সাহায্যে দান করা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এমন সহৃদয়তার পরিচয় বারবারই দেখিয়েছেন তিনি। মানুষের প্রতি তাঁর কাতরতা চির অমলিন রয়ে গিয়েছিল।
লিখে যৎসামান্যই অর্থ সেকালে পাওয়া যেত। তীব্র অর্থ সংকটের দিনে কবির কাছে অর্থ লাভের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিল সাহিত্য। শারদোৎসবের মুখে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় লিখে অর্থ প্রাপ্তি ঘটেছে। কবির মনে প্রশান্তি জেগেছে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে উল্লিখিত চিঠিটি কবি যে সময় লিখেছিলেন, তার বছর চারেক পরের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রবল অর্থকষ্টের দিনে পুজো সংখ্যায় লিখে কবি সংকটমোচনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। স্নেহভাজন কবি বুদ্ধদেব বসুকে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অর্থের প্রয়োজনে গল্প লিখতে হয়েছে। অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো সহজ পথ জানিনে। বিপদে পড়লে সরস্বতীকে পাণ্ডা করে লক্ষ্মীর দরজায় যেতে হয়। সে লেখাটা বিক্রি করেছি।… ব্যবসাটা অর্থকরী নয়, কিন্তু ভিক্ষার চেয়ে অন্তত ভদ্র।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৫: শেকল-বাঁধা ঠাকুরবাড়ির খাতা

ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/৩

ত্বকের পরিচর্যায়: ‘টাকপোকা’ ঠিক কী? এই অসুখে আপনিও আক্রান্ত হতে পারেন, এর প্রতিকার জানেন?

অর্থের প্রয়োজনে লেখা সে-গল্পটির নাম ‘রবিবার’। ছাপা হয়েছিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র ১৩৪৬ -এর শারদীয় সংখ্যায়। পরের বছরের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র শারদীয় সংখ্যায় কবি লিখেছিলেন ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি। তখন তিনি খুবই অসুস্থ। প্রায় শয্যাশায়ী। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ-জ্ঞান করে লেখা এই গল্পটি প্রকাশের পর কবি কতখানি আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলেন, সে ছবি ধরা আছে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর লেখায়। ‘নির্বাণ’ বইতে আনন্দ- মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জোড়াসাঁকোয় বাবামশায় দু-মাস রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, কী কষ্ট পেয়েছেন চোখে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই জানেন। তাঁর এই অসুস্থতার মধ্যে পুজোর ‘আনন্দবাজার’ বেরোল, তাতে ল্যাবরেটরি গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। অসুখের মধ্যে সেদিন তিনি ভালো ছিলেন। তাই কাগজখানি আসা মাত্র আমার স্বামী তা নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখিয়েছিলেন। কী আগ্রহ তাঁর গল্পটি দেখে, ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও তিনি কাগজখানি হাতে নিয়ে আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে গেলেন।… বন্ধুবান্ধব এসে গল্পটি প্রশংসা করলে অসুখের মধ্যেও তাঁর মুখ কত উজ্জ্বল হয়ে উঠত।’ এই ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি ঘিরে রবীন্দ্রনাথের মনে আশঙ্কা-আতঙ্ক ছিল। তিনি ভেবেছিলেন গল্পের নায়িকা সোহিনীকে সকলে বুঝতে পারবেন না। বিরূপ সমালোচনা হবে। কবির সেই দ্বিধা-সংকোচের কথা প্রতিমা দেবীর লেখায় শুধু নয়, কন্যা মীরার লেখাতও আছে। রীতিমতো বাড়িতে লোকজন ডেকে রবীন্দ্রনাথ গল্পটি শুনিয়েছেন। প্রত্যাশা করেছিলেন তাদের মতামত।

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত গল্পটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব- উৎকণ্ঠা সত্যিই তীব্র হয়ে উঠেছিল! অনেককে জিজ্ঞাসা করেছেন, পাঠকের ভালো-লাগা, না-লাগা জানতে চেয়েছেন। কবির স্নেহভাজন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকায় জানিয়েছিলেন এই গল্পটি নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। প্রশান্তচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছে উপস্থিত হতেই গল্পটা দেখিয়ে কবি বলেছিলেন, ‘আর সকলে কী বলছে? একেবারে ছিছি কাণ্ড তো? নিন্দায় আর মুখ দেখানো যাবে না! আশি বছর বয়সে রবি ঠাকুরের মাথা খারাপ হয়েছে … সোহিনীর মতো এমন একটা মেয়ের সম্বন্ধে এমন করে লিখেছে। সবাই তো এই বলবে যে, এটা লেখা ওঁর উচিত হয়নি।’

বুদ্ধদেব বসু।

উচিত, না অনুচিত, তা নিয়ে পাঠক মনে প্রশ্ন জেগেছিল। চলেছে মতামতের আদান-প্রদান। মতভেদ তৈরি হয়েছে। বলা যায়, শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের এই গল্পটি নিয়ে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল।

শারদীয় সংখ্যার তখন চাপ ছিল না। বিপুলসংখ্যক শারদীয় সংখ্যাও প্রকাশিত হত না। ছবিটি যদি অন্যরকম হতো, চাপ যদি প্রবল থাকত, সব পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা বের হতো, তাহলে বেশ মন্দ হতো না।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৮: কুশরাজার দেশে এলেন কৌশিক বিশ্বামিত্র

রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? কী করণীয়? কেমন হবে ডায়েট? জেনে নিন ডাক্তারবাবুর পরামর্শ

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-২২: প্রতিবাদহীন অন্যায়ের মাঝে গর্জে উঠলেন বিকর্ণ, কটুকথায় তাঁকে বিঁধলেন কর্ণ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১: আলোছায়ায় ‘দৃষ্টিদান’ [২৪/০৪/১৯৪৮]

রবীন্দ্রসাহিত্যের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠত। বন্যাত্রাণ যেমনভাবে শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ দান করেছিলেন, তেমনভাবেই হয়তো কবি আরও নানা জনহিতকরকর্মে শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া সম্মান-দক্ষিণা বিলিয়ে দিতেন। শারদোৎসবের আনন্দ যে রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করেছিল, তাঁর ব্যক্তিজীবনের বিবরণে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শারদীয় সংখ্যা প্রকাশের প্রাবল্য থাকলে আরও আরও রবীন্দ্রসাহিত্য পাওয়া যেত। প্রাপ্তির আনন্দে আপ্লুত হতাম আমরা।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content