সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বধূমাতা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর প্রতি সহৃদয় ছিলেন, তেমন নয়। জ্ঞানদানন্দিনী গড্ডলিকা প্রবাহে কখনও গা ভাসাননি। তাঁর দৈনন্দিন কার্যকলাপে, জীবনভাবনায় লক্ষ্য করা গিয়েছে প্রগতিশীলতার ছোঁয়া। আধুনিকতার আলো। সেসব বোধহয় মহর্ষিদেবের না-পসন্দ ছিল। শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে পুত্রবধূর যে দূরত্বের সূচনা, তা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠেছে। পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব-বিরোধের আভাস পাওয়া যায় জ্ঞানদানন্দিনীকে লেখা সত্যেন্দ্রনাথের এক চিঠিতে। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তোমার অন্য বাড়ীতে থাকার বিষয় কিছু স্থির করিতে পারিতেছি না… বাবামহাশয় ইহার মধ্যে বাড়ী আসিবেন, না জানি তাঁহার কি মত? আর তুমি ত পাঁচিধোবানির গলিতে কোন বাড়ী লইয়া থাকিতে পারিবে না … একটা ভাল স্থানে বাঙ্গলীটোলায় বাড়ী পাওয়া সহজ নহে।’

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।

অনুমান করা যায়, পারিবারিক-জটিলতা থেকে জ্ঞানদানন্দিনী সপরিবারে এক সময় পার্ক স্ট্রিটে থাকতেন। মহর্ষিও পার্ক স্ট্রিটে অন্য একটি বাড়িতে থেকেছেন কিছুকাল। পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে পরিবারের অনেকেই আসা-যাওয়া করতেন। রবীন্দ্রনাথও যেতেন। রবীন্দ্রনাথ পিতৃদেবের কাছে যেমন যেতেন, তেমনই যেতেন বউঠানের কাছে।
পার্ক স্ট্রিটের অদূরে বির্জি-তলার বাড়িতেও কিছুকাল সত্যেন্দ্রনাথ সপরিবারে বসবাস করেছেন। হোক না ভাড়া বাড়ি, আনন্দে খুশিতে সারাক্ষণই পরিপূর্ণ থাকত। নাটক-সংগীত — রকমারি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আত্মপ্রকাশের যথেচ্ছ সুযোগ ছিল। দিন কাটত আমোদে প্রমোদে। মাঝেমধ্যেই বসত নাটকের আসর। সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর ‘স্মৃতিসস্পুট’ বইতে আছে নাট্যাভিনয়ের সরস বিবরণ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘হঠাৎ নবাব’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। মৌলিকে নাটক নয়, ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের অনুবাদ। ইন্দিরা জানিয়েছেন, ‘জ্যোতিকামশায় ‘হঠাৎ নবাব’টা আমরা অভিনয় করিয়েছিলুম। তাতে জ্যোতিকামশায় পার্ট ভুলে গেলে বেশ অবলীলাক্রমে নেপথ্যের কাছে গিয়ে জেনে আসছিলেন, আর উনি নিকলেট দাসী সেজে হি হি করে হেসে অস্থির হয়েছিলেন।’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু’ও এ-বাড়িতে অভিনীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এ নাটকের আগে নাম ছিল ‘এমন কর্ম আর করব না।’ বির্জি-তলাওতে ‘মায়ার খেলা’র অভিনয় হয়। অভিনয় হয় ‘রাজা ও রানী’-র। ‘মায়ার খেলা’-য় রবীন্দ্রনাথ সেজেছিলেন ‘মদন’, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘বসন্ত’।‌ ‘রাজা ও রানী’তে জ্ঞানদানন্দিনী অভিনয় করেছিলেন’ রানী সুমিত্রা’র ভূমিকায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৪: কবি যখন শিক্ষক

ছোটদের যত্নে: শিশু পেটের ব্যথায় ভুগছে? তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি মেনে চলুন

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৭: অপেক্ষার অবসান — অযোধ্যায় চার রাজকুমার

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৩: ছোটদের পাতে অবশ্যই থাকুক এক টুকরো মাছ

কোথায় ছিল বির্জি-তলাওয়ের বাড়িটি, সঠিক অবস্থান জানিয়েছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। ‘সমকালীন’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের লাগাও জমিতে তখন একটি বিরাট পুকুর ছিল। তাঁকে লোকে বলত বির্জি-তলাও। তারই সামনে বর্তমান প্রেসিডেন্সি হাসপাতালের জমিতে বির্জি-রাজের একটি পুরোনো বাড়ি আমরা ভাড়া নিয়ে বহুদিন ছিলুম। বাড়িটি জীর্ণ হলেও তার সঙ্গে আমাদের সেকালের অনেক সুখস্মৃতি জড়িত।’
‌ইন্দিরার স্মৃতিচারণে উল্লিখিত ‘প্রেসিডেন্সি হাসপাতাল’-ই পি-জি, মানে আজকের এসএসকেএম হাসপাতাল। বিরাট বাড়ি, অনেক জায়গা। ফলে স্থান সংকুলানের সমস্যা হয়নি কখনো। আত্মীয়পরিজন ও বন্ধুবান্ধব যতই আসুক না কেন, অসুবিধায় পড়তে হয়নি। শুধু নাট্যগীতি নয়, এই আনন্দ-মজলিশে ক্রীড়া-চর্চারও সুযোগ ছিল। টেনিস-ব্যাডমিণ্টন খেলা চলত নিয়মিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বির্জি-তলাওর সেই আনন্দময় পরিবেশে একটি খাতার বড়ো ভূমিকা ছিল।‌ সে-খাতাটির ইঙ্গিতবহ একটি নামও ছিল, ‘পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক’। ইন্দিরার লেখা থেকেই জানা যায়, খাতাটি রাখা থাকত বাড়ির সিঁড়িতে, একটি উঁচু ডেস্কে। হ্যাঁ, ঘটনাটি সত্য, ডেস্কে ওপর রাখা খাতাটি বাঁধা থাকত শেকল দিয়ে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এলে, বন্ধুবান্ধব এলে তাঁরা যা খুশি আপন খেয়ালে লিখত এই খাতায়। মজা-তামাশা, তাৎক্ষণিক সাহিত্য, কী ছিল না খাতার পাতায় পাতায়! ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা ছিল। কেউ লিখতেন বাংলায়, কেউ লিখতেন ইংরেজিতে। বাংলা- ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুড়ি-ভাষাতেও লিখেছেন কেউ কেউ। খাতাটি যাতে কোনওভাবে বেহাত না হয়, বদলদাবা করে না নিয়ে যায়, সে কথা ভেবেই এই শেকল-বন্ধন।

বলেন্দনাথ ঠাকুর।

খাতার শুরুতে ছিল কী করা যাবে না, ক্রমান্বয়ে তিন নিষেধাজ্ঞা। পেনসিলে লেখা যাবে না, পরিবারের বাইরে খাতা নিয়ে যাওয়া যাবে না, যতদিন লেখা চলবে, ততদিন এই খাতার কিছু পুস্তকে ব্যবহার করা যাবে না।
এই নিষেধাজ্ঞাগুলো রবীন্দ্রনাথের ভাবনা-জাত। তাঁর হস্তাক্ষরে এসব লেখা ছিল খাতার চতুর্থ পৃষ্ঠায়। পঞ্চম পৃষ্ঠায় ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বক্তব্য। তিনি জানিয়েছিলেন, আত্মীয়-কুটুম্ব-বন্ধু ‘আপন মনের ভাব-চিন্তা’ খাতাটিতে লিখতে পারবেন। তাঁর হাতে খাতার সূচনা হয়েছিল। বলা যায়, তিনিই উদ্বোধক। দ্বিতীয় লেখাটি রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথের। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘ভাষাতত্ত্ব’ নিয়ে। বলেন্দ্রনাথ ‘অক্ষরতত্ত্ব’ প্রসঙ্গে। এই দুই রচনার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ কলম ধরেছিলেন। সেটিই খাতায় তাঁর প্রথম কলম ধরা। যথেষ্ট কৌতূহল জাগানিয়া সে রচনাটির শিরোনাম‌ ছিল ‘বাঙ্গালাভাষা ও বাঙালী চরিত্র’।

হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই খাতায় এমন কত গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়েই না লেখা লিখেছেন ঠাকুরবাড়ি সদস্যরা ও তাঁদের আত্মীয়কুটুম্বরা! গম্ভীর বিষয়ের পাশাপাশি কৌতুকময় রচনা-মন্তব্যও ছিল। রথীন্দ্রনাথের জন্মের আগে ও পরে নানা মজাদার মন্তব্য করা হয়েছিল। জন্মের আগেই‌ কবির ভ্রাতুষ্পুত্র হিতেন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘রবিকাকার একটি মান্যবান ও সৌভাগ্যবান পুত্র হইবে, কন্যা হইবে না। সে রবিকাকার মতো তেমন হাস্যরসপ্রিয় হইবে না, রবিকাকার অপেক্ষা গম্ভীর হইবে। সে সমাজের কার্যে ঘুরিবার অপেক্ষা দূরে দূরে একাকী অবস্থান করিয়া ঈশ্বরের ধ্যানে নিযুক্ত থাকিবে।’ এ তো জন্মের আগে কাল্পনিক মন্তব্য, জন্মের পরে শিশুসন্তানকে চাক্ষুষ করে বলেন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, ‘খোকা বেচারা যোগই করুক আর গোলযোগই করুক, জন্মাবার আগে থেকে তার উপর যে রকম আলোচনা চলেছে, তাতে তার পক্ষে কতদূর সুবিধের বলতে পারিনে। বড় হ’লে সে বেচারীর না জানি আরও কত সইতে হবে। হয়তো প্রতিবাদ করতে শিখবে … এরকম নীরবে সহ্য করতে হবে না।’ বলেন্দ্রনাথ ফ্রেনোলজি বা মস্তিষ্কতত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন, আবার ‘মশা ও ছারপোকা’র মতো লঘু নিবন্ধও লিখেছেন।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: সন্তান জ্বরে ভুগছে? কী ভাবে সামলাবেন? রইল ঘরোয়া চিকিৎসার খুঁটিনাটি

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৬: অক্ষবিদ্যাশিক্ষা করলেন নলরাজা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩: এক ফ্লপ মাস্টার জেনারেল-র ‘মর্যাদা’ [২২/১২/১৯৫০]

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩৬: শ্যুটিংয়ের গপ্পো সপ্পো

রবীন্দ্রনাথের কাছে বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন পিতৃতুল্য। শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে অবস্থিত দ্বিজেন্দ্রগৃহে প্রায়শই রবীন্দ্রনাথ যেতেন। আপনভোলা দার্শনিক অগ্ৰজের স্নেহসান্নিধ্য কবিকে মুগ্ধ করত। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রানী’ নাটকটি পড়ে ভালো লাগার কথা দ্বিজেন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। বলেছিলেন এমন লেখা ‘ইংরেজিতেও দেখি নাই’। অগ্ৰজের মুগ্ধতা রবীন্দ্রনাথকেও স্পর্শ করেছিল। তিনি সে চিঠি কপি করে ওই খাতায় রেখেছিলেন। পরিবারের সকলে দেখুন, হয়তো চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি তাঁর ভালো লাগার তীব্রতা এ ভাবে প্রকাশ করেছিলেন, ‘আমার নানা রচনা সম্বন্ধে নানা লোকে নানা কথা বলিয়াছে কিন্তু কোন সমালোচনায় আমি এত গর্ব অনুভব করি নাই। বড়দাদার কাছে হইতে আসিতেছে বলিয়াই আমার এত বিশেষ গর্ব ও বিশেষ আনন্দ।’

এ-খাতা বড় বৈচিত্র্যময়। লঘুগুরু কত বিষয়ের অবতারণা। সাহিত্য, দর্শন, সমাজবিদ্যা, ব্যাকরণ, নন্দনতত্ত্ব, সব দিকেই আলোচনার আলো পড়েছে। বাদ পড়েনি অ্যাডভেঞ্চার-প্রসঙ্গও। ঠাকুর পরিবারের দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, হিতেন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ বা কবির ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ বা জামাতা আশুতোষ ও প্রমথ চৌধুরী যেমন লিখেছেন, তেমনই লোকেন্দ্রনাথ পালিত, অক্ষয় চৌধুরী, শরৎকুমারী চৌধুরানীর মতো বন্ধুজনেরা পারিবারিক খাতায় নানা বিষয়ে লিখেছেন। শেকল বাঁধা একটি খাতা, সে খাতায় নানা গম্ভীর বিষয়ে আলোকপাত। গাম্ভীর্যের আড়ালে কখনো হাসির ঝিলিক। সব মিলিয়ে ঠাকুরবাড়ির প্রাত্যহিক জীবন কত আনন্দময় ছিল, তাঁদের দৈনন্দিন ভাবনা কত দূর প্রসারিত ছিল, সে-সব ফুটে উঠেছে এই পারিবারিক খাতায়।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content