বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ : ছাত্রদের মাঝে।

শান্তিনিকেতনে আশ্রম-বিদ্যালয়ের সূচনাকালে প্রায় কিছুই ছিল না। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, যেন যুদ্ধযাত্রায় চলেছে নিধিরাম সর্দার। থাকার মধ্যে ছিল শুধু সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার জোরেই কেমন করে পড়ানো উচিত, কী রকম হওয়া উচিত বিদ্যালয়ের পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক, তার একটা ‘মডেল’ তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি, তা সত্ত্বেও ওই বিদ্যালয়েই নিজের পুত্রকে পড়িয়েছিলেন তিনি। নিজের স্কুলজীবন সম্পর্কে তাঁর বিরক্তির শেষ ছিল না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে গোড়া থেকেই আপত্তি ছিল তাঁর। এক সময় জোড়াসাঁকোয় স্কুল খুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাড়ির ছেলেমেয়েরাই পড়ত এই স্কুলে। সব মিলিয়ে দশ-পনেরোজন ছাত্র। তিনি নিজে পড়াতেন, মাস্টারমশায়ও রেখে দিয়েছিলেন। এই স্কুলেই রথীন্দ্রনাথের হাতেখড়ি হয়েছিল। শিলাইদহে বসবাসকালে পুত্রকন্যাদের রবীন্দ্রনাথ নিজে পড়াতেন। তাঁর কাছেই হয়েছিল পুত্রকন্যাদের চিরায়ত-সাহিত্যের পাঠ। বিদ্যাসাগর-মধুসূদনের রচনাসম্ভার পিতার কাছেই পড়েছিলেন, বুঝেছিলেন পুত্রকন্যারা। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের পড়াতে গিয়ে শিক্ষাপদ্ধতি সম্বন্ধে বাবার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, পরে শান্তিনিকেতনে তাঁকে তা খুব সাহায্য করেছিল।’

রবীন্দ্রনাথ : আশ্রম-পড়ুয়াদের সঙ্গে।

রথীন্দ্রনাথ আশ্রম-বিদ্যালয়ের সূচনাপর্বের ছাত্র, কীভাবে বিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছিল, সে-ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ বইতে আছে প্রতিষ্ঠাপর্বের বিবরণ। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, ছাত্র ছিল না, ছাত্রবাস ছিল না— বিদ্যালয়ের ভিতপত্তন হয়েছিল একটি লাইব্রেরি দিয়ে। রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘ইস্কুলে ব্যবহারের জন্য এই একটিমাত্র পাকাবাড়ি বাবা পেয়েছিলেন মহর্ষির কাছ থেকে।’

স্কুল তো হল, শহর থেকে দূরে গ্ৰামীণ পরিবেশে ছাত্র জোটানো সহজ কাজ ছিল না। তখনও বোডিং-স্কুল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা গড়ে ওঠেনি। কেনই বা তারা বোডিং-স্কুলে ছেলে পাঠাবে?
তবে কি সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে, উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে ছুটলেন কলকাতায়। দেখা করলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরিকল্পনার কথা বললেন তাঁকে, ছাত্র জোগাড় করে দেওয়ার আর্জি জানালেন। ব্রহ্মবান্ধব বুঝলেন, শিক্ষা নিয়ে কবির যে ভাবনা, সে ভাবনায় দূরদর্শিতা মিশে আছে। একদিন এই ভাবনা শুধু ফলপ্রসূ নয়, জয়যুক্ত হবে। কলকাতা থেকে অচিরেই চারজন ছাত্রকে তিনি শান্তিনিকেতনে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।
আরও পড়ুন:

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৪: বসুন্ধরা এবং…

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৫: হৃদয়ে হৃদয় মিলল মিথিলা অযোধ্যার

দীর্ঘক্ষণ ধরে কম্পিউটারে কাজ করে কাঁধে ব্যথা? ফিজিওথেরাপিতে আছে সমাধান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১: আলোছায়ায় ‘দৃষ্টিদান’

ব্রহ্মবান্ধব প্রেরিত চারজন ছাত্র, সেই সঙ্গে কবিপুত্র, মোট পাঁচটি ছাত্র নিয়ে সূচনা হয়েছিল আশ্রম-বিদ্যালয়ের। কিছুদিনের মধ্যেই যোগ দিয়েছিলেন কয়েকজন নতুন শিক্ষক। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ইংরেজি পড়ানোর জন্য আশ্রম-বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন রেবাচাঁদ নামে এক সিন্ধিভাষীকে। কবিবান্ধব শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের খুড়তুতো ভাই সুবোধচন্দ্র এসেছিলেন বাংলা পড়াতে। জমিদারি কাজে পতিসরে থাকতেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপণ্ডিত মানুষটিকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে, সংস্কৃত শিক্ষক হিসেবে। বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন জগদানন্দ রায়। ক্রমান্বয়ে এসেছিলেন আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক। যেমন, সতীশচন্দ্র রায়। বলা যেতে পারে বিধুশেখর ভট্টাচার্যের কথা। সংস্কৃত ও পালি পড়ানোর জন্য তিনি এসেছিলেন বেনারস থেকে। শান্তিনিকেতনে আশ্রম-বিদ্যালয়কে ঘিরে কবির পরিকল্পনার কথা শুনে নিজের কলেজের পড়া ‘জলাঞ্জলি’ দিয়ে আশ্রম-বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন সতীশচন্দ্র।

আশ্রমের ছাত্র ও শিক্ষকরা, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

দিনে দিনে আরও শিক্ষক এসেছেন। এসেছে নতুন নতুন ছাত্ররা। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আদিকুটিরে আমরা মাত্র পঁচিশ-তিরিশজন ছাত্র ছিলুম। আমাদের দৈনিক জীবনযাত্রা অত্যন্ত শাদাসিধে ছিল। ছাত্রদের জন্য তখন অভিভাবকদের কিছুই খরচ ছিল না, বেতন তো নেওয়া হতো না … সব ব্যয়ই বাবা বহন করতেন। আমাদের সম্পত্তির মধ্যে খানকয়েক কাপড় ও দুটি কম্বল। গৈরিক রঙের আলখাল্লা সর্বদাই পরে থাকত হত, তাতে আমরা খুশি ছিলুম … আলখাল্লার নীচে তেমন ছেঁড়া বা নোংরা পোশাক থাক-না কেন, বাইরে থেকে ধরতে পারা যেত না।’
আশ্রম-বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত ক্লাস নিতেন। তিনি চেয়েছিলেন ছাত্ররা শৈশব থেকে ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে উঠুক। সে শিক্ষা দিতেই তৎপর হয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ছোটদের ক্লাস নিতে পছন্দ করতেন বেশি। গল্পের মতো করে ক্লাস, আনন্দের সঙ্গে ক্লাস। তাঁর পড়ানো ছাত্রদের খুব পছন্দ হতো। তাই মাস্টারমশায়রা মাঝেমধ্যেই রবীন্দ্রনাথের কাছে কী করে পড়ালে আরও ভালো হয়, ছাত্রদের আকৃষ্ট করা যায়, সে-আলোচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথও সরোজমিনে দেখার জন্য কখনও-সখনও অন্য মাস্টারমশাইদের ক্লাসে ঢুকে পড়তেন। ঢুকে ইচ্ছে হলে নিজেই পড়াতে শুরু করে দিতেন। যিনি পড়াচ্ছিলেন, তিনি যে খুব রেগে যেতেন, তা নয়; বরং খুশি হয়ে ভাবতেন, কী করে পড়ালে ভালো হয়, গুরুদেবের কাছ তো শেখার এক সুযোগ পাওয়া গেল।
আরও পড়ুন:

আজকের আলোচনা মাধ্যমিক ইংরেজি পরীক্ষার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে — PHRASAL VERB

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৪: অবশেষে দময়ন্তী ফিরে গেলেন পিতৃগৃহে…

শিশুকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন? কী কী ওষুধ সঙ্গে রাখবেন? রইল পরামর্শ

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-২: ঠিক করলাম উত্তরে ডোর কাউন্টি, মধ্যে মিলওয়াকি, দক্ষিণে গ্রান্ট কাউন্টি—সবই দেখব

শুধু কি পড়ানো, কত দিকে রবীন্দ্রনাথকে নজর রাখতে হতো। পড়াশোনা থেকে খেলাধুলো — নানাদিকে নজর, মুশকিল-আসান। কোথা থেকে টাকা আসবে, কীভাবে চলবে? অর্থচিন্তায় রবীন্দ্রনাথ সারাক্ষণই জেরবার হতেন।
ছাত্রদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের গভীর ভালোবাসা ছিল। সে ভালবাসার কোনও তুলনা হয় না। ঝমঝমানো বৃষ্টিস্নাত মধ্যরাতেও ছুটতেন ছাত্রাবাসে। খড়ের চালের ঘরে ছাত্ররা থাকে। চাল-গলে জল পড়ছে না তো, বাছারা কেউ ভিজে যাচ্ছে না তো! বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরই কবির মাথায় এসব চিন্তার উদয় হতো। উৎকণ্ঠিতচিত্তে তাঁর ছাত্রাবাসে পৌঁছে যাওয়ার কথা আছে হেমলতা দেবীর লেখায়।

আশ্রম-শিক্ষক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয়ের শুধু অধ্যাপক ছিলেন না, পরিচালনাভারও তাঁর উপর ছিল। জোড়াসাঁকোতে অবস্থানকালেও কবির মন পড়ে থাকত শান্তিনিকেতনে। আশ্রম-বিদ্যালয়ের ছাত্রদের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হতেন তিনি। এক চিঠিতে কবি ভূপেন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘ইংরেজি কথোপকথন চর্চার যে লেখা সত্যকে দিয়া আসিয়াছি, তাহা যেন প্রত্যহ একবার মধ্যাহ্নে অথবা সায়াহ্নে গল্পে বসিবার পূর্বে ছেলেদের অভ্যাস করানো হয়, ইহা দেখিবেন। অধ্যাপনায় লেশমাত্র শৈথিল্য না ঘটিতে পারে, অঙ্কে আমাদের স্কুলের যে কলঙ্ক আছে, কানাইবাবুকে বলিবেন তাহা সত্ত্বরেই দূর করা চাই।’ পত্রে উল্লিখিত ‘সত্য’ আর কেউ নন, কবির জামাতা রেণুকার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। আশ্রম-বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করতেন। ‘কানাই’ আসলে কানাইলাল গুপ্ত, তিনিও আশ্রম-বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতেন, সেই সঙ্গে চিকিৎসাও।

আশ্রম-শিক্ষক জগদানন্দ রায়

হিমেল বাতাস বইলে ছাত্রদের ঠাণ্ডা লাগতে পারে। উদ্বিগ্ন হয়ে জোড়াসাঁকো থেকে রবীন্দ্রনাথ ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে লিখেছিলেন, ‘স্নানের সময় তেল মাখিতে জল ঢালিতে কেহ যেন অনাবশ্যক বিলম্ব না করে। তেলটা খোলা হাওয়ায় না মাখিয়া ঘরে মাখিলেই ভালো হয়—সেই সময় ভালো করিয়া যেন গা ঘষে। এমন করিয়া গা ঘষা আবশ্যক যাহাতে কিছু পরিশ্রম ও শরীরে উত্তাপ সঞ্চয় হয়।’ আশ্রম-পড়ুয়া ছাত্রদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উদ্বিগ্নতা কত তীব্র ও অন্তর থেকে উৎসারিত ছিল, তা গোপন থাকেনি। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘ছেলেদের সর্দি হইলেই রাত্রে পায়ের তেলোয় গরম সর্ষের তেল মালিশ করানো উচিত।’

খ্যাতির শীর্ষে তখন রবীন্দ্রনাথ। সারা পৃথিবীর মানুষ তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেও আশ্রম-পড়ুয়াদের নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত ছিল না। তাদের জন্য ছিল কবির গভীর ভালোবাসা। সে ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না। ছোটরা যদি এমন ভালোবাসা পায়, তবে তারা লেখাপড়া করবে প্রাণের আনন্দে‌। ফুলের মতো ফুটে উঠবে।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content