বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ বালক-বয়সে।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম মাস্টারমশায় মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরদালালে বসত তাঁর পাঠশালা। শুধু ঠাকুরবাড়ির ছোটরাই নয়, আশপাশ থেকেও কেউ কেউ আসত।‌ রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘বিদ্যার‌‌ প্রথম আঁচড় পড়ত তালপাতায়।’ বিভিন্ন বর্ণের উপর চলত দাগা বুলোনো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে এক ‘সেকেলে পণ্ডিতের’ কথা বলেছেন। যিনি নিত্যদিন নিজের দেহে তেল মাখতেন, আর বেতেও তেল মাখাতেন। অপরাধে, এমনকি বিনা অপরাধেও পণ্ডিতমশায় ছাত্রদের পিঠে বেতের যথেচ্ছ ব্যবহার করতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মাধবচন্দ্রের কথা বলেছেন কিনা, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিকাতর হয়ে ‘শিশু’ বইয়ের ‘পুরোনো বট’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ওখানেতে পাঠশালা নেই,/ পণ্ডিতমশাই — বেত হাতে নাইকো বসে,/মাধব গোঁসাই।’

দাদা সোমেন্দ্রনাথ ও ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ — দু’জনেই বয়েসে রবীন্দ্রনাথের থেকে বড়, তাদের পড়াশোনা অবশ্য একই সঙ্গে চলত। ঠাকুরবাড়ির ‘ক্যাশবহি’তে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ তিন কপি কেনার হিসেব রয়েছে। বলা বাহুল্য, তিনকপি বই একই সঙ্গে কেনা হয়েছিল। বই কেনার তারিখ দেখে বোঝা যায়, অন্তত দশ বছর আগে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ বের হলেও রবীন্দ্রনাথ ‘বর্ণপরিচয়’, নয় ‘শিশুশিক্ষা’ পড়েছিলেন। সূচনা পর্বে ‘রবিজীবনী’র লেখক প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের দ্বারা পঠিত প্রথম পুস্তকের গৌরব মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত ‘শিশুশিক্ষা’ — প্রথম ভাগের প্রাপ্য।’

দাদা ও ভাগ্নের স্কুলে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের মনেও আগ্রহের সঞ্চার করেছিল। তিনিও স্কুলে যাবেন, স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিনই কান্নাকাটি করতেন। তাঁর এই কান্নাকাটি বাড়ির গৃহশিক্ষক ভালো চোখে নেননি। তাঁর কাছে খেতে হয়েছিল ‘প্রবল চপেটাঘাত’।

অনেকেরই ধারণা রবীন্দ্রনাথ ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়েছেন। এই ভ্রান্তি রবীন্দ্রনাথ নিজেই তৈরি করেছেন। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার কথা লিখেছেন। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে নয়, ১৩ কর্নওয়াললিস স্ট্রিটের ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং আকাডেমিতে’ রবীন্দ্রনাথের স্কুলশিক্ষার সূত্রপাত।
এই স্কুলে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বেশিদিন পড়েননি। ক্যালকাটা ট্রেনিং আকাদেমি ছাড়িয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল নর্মাল স্কুলে। এই স্কুলের পরিবেশ রবীন্দ্রনাথ পীড়িত করেছিল। ছাত্রদের তো বটেই, এমনকি ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকদের ব্যবহার সুখকর ছিল না। হরনাথ নামে এক মাস্টারমশায় ছিলেন এই স্কুলে। তাঁর ‘কুৎসিত ভাষা’ প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথকে কষ্ট দিত। মাস্টারমশায়দের মধ্যে সাতকড়ি দত্তকে রবীন্দ্রনাথ সব থেকে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। বালক রবিকে সব সময়ই তিনি উৎসাহিত করতেন। ওই বয়সের রবীন্দ্রনাথ যে চমৎকার কবিতা লেখেন, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণও পেয়েছিলেন সাতকড়ি দত্ত। খাতায় লিখে দেওয়া দু’লাইন কবিতার পরের দু লাইন লিখে এনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখিয়েছিলেন।

স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা লেখার কথা। ‘সদ্ভাব’ নিয়ে একটি কবিতা লেখার বরাদ্দ দিয়েছিলেন তিনি। কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখিও ছিলেন। তাঁর নির্দেশে কবিতাটি পড়তে হয়েছিল ক্লাসে। যাঁদের উদ্দেশ্যে লেখা, তাঁদের অবশ্য খুশি করেনি। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ‘কিছু মাত্র সদ্ভাব সঞ্চার হয় নাই।’

রবীন্দ্রনাথকে বাড়িতে পড়াতে আসতেন নীলকমল ঘোষাল। তিনি বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’, মাইকেল মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ‌কাব্য’ যেমন পড়াতেন, তেমনই করাতেন পার্টিগণিত-বীজগণিত। সন্ধ্যেবেলায় পড়াতে আসতেন অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি পড়াতেন মূলত ইংরেজি। তাঁর কাছে ‘ফার্স্ট বুক’-এর পাঠ নেওয়া ছিল এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, ‘প্রথমে উঠত হাই, তারপর আসত ঘুম, তারপর চলত চোখ রগড়ানি।’ ঘুমের মাসি-পিসিরা তখন রবীন্দ্রনাথের চোখে। ঢুলুনির মাত্রা ক্রমেই বাড়ত। তাকে উজ্জীবিত করার জন্য মাস্টারমশায় বলতেন সতীশ নামে তাঁর এক ছাত্রের কথা। পড়তে পড়তে ঘুম পেলে সে নাকি চোখে নস্যি ঘষে।’ এসব বলে মাস্টারমশায় ঘুম তাড়াতে সাহায্য করতে চাইলেও ঘুমেরা ধেয়ে আসত। ঘুম‌ যতই আসুক, রাত্রি ন’টার আগে ছুটি মিলত না।’

রবীন্দ্রনাথ কৈশোরে।

আরও পড়ুন:

হার্ট অ্যাটাক নীরবেও হতে পারে! কোন উপসর্গ দেখে সতর্ক হবেন? জেনে নিন ডাক্তারবাবুর পরামর্শ

আদর্শ ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষাগুরুর মেলবন্ধনই শিক্ষক দিবসের বাস্তবায়ন

অঘোরবাবু নিজেও ছিলেন ছাত্র। ডাক্তারির ছাত্র। পড়তেন মেডিকেল কলেজে। একদিন কাগজের মুড়ে কী যেন নিয়ে এলেন তিনি। সকলেই কৌতহূহলী! মোড়ক খুলে দেখা গেল মানুষের কণ্ঠনাল। বুঝিয়ে দিলেন, কথা বলার কায়দাকানুন। রবীন্দ্রনাথ অঘোরবাবুর সঙ্গে একবার মেডিকেল কলেজের লাশকাটা ঘরে গিয়েছিলেন। ছমছমে থমথমে ঘরে প্রবেশ করে রবীন্দ্রনাথের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা মোটেই সুখকর ছিল না। দেখেছিলেন, মেঝের উপর পড়ে আছে একটা কাটা হাত। দেখে বালক রবীন্দ্রনাথ তো ভয় পেয়ে আঁতকে উঠেছিলেন। ঠাকুরবাড়িতে শরীরচর্চার প্রচলন ছিল। বাড়ির মহিলারাও এ-ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘বালক’-এর পাতায় ব্যায়াম নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় রীতিমতো শরীরচর্চা করতেন। শরীরচর্চার কায়দাকানুন শেখানোর জন্য বাড়িতে মাস্টারমশায় আসতেন। তিনি শ্যামাচরণ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথকে জিমন্যাস্টিক শেখাতেন। রবীন্দ্রনাথ বালক-বয়স থেকেই সংগীতচর্চা করতেন। তাঁর কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ পারিতোষিক দিয়েছিলেন। পিতৃদেবের কাছ থেকে পাওয়া সেই পুরস্কারই ছিল কবির জীবনে প্রথম পুরস্কার-লাভ। তাঁকে বাড়িতে গান শেখাতে নিয়মিত আসতেন এক সংগীত শিক্ষক। তাঁর নাম বিষ্ণু চক্রবর্তী।

রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ বিজ্ঞান চর্চাতেই মগ্ন থাকতেন। বিজ্ঞান বিষয় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর লেখা বিজ্ঞানের বইও আছে। মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তেন। পরীক্ষা অবশ্য দেওয়া হয়নি তাঁর। হেমেন্দ্রনাথ বাড়ির অনেককেই পড়িয়েছেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর কাছে পাঠ নিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের বাংলার মাস্টারমশায় নীলকমল বাবুর জোড়াসাঁকোয় আসা আকস্মিক বন্ধ হয়েছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে আসতে ‘না’ করে দিয়েছিলেন। কেন এমন ঘটেছিল, তার আড়ালে রয়েছে এক মজার আখ্যান। স্কুলের মাস্টারমশায় কিশোরীমোহন মিত্রের লেখা দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীগ্রন্থটি পড়তে চেয়েছিলেন। কোথা থেকে দেবেন সে বই, রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নে সত্যপ্রসাদের সহসা মনে পড়ে, কেন, বই তো মহর্ষিদেবের কাছে আছে, সাহস করে তিনি পৌঁছেও গিয়েছিলেন তাঁর ঘরে। অমন রাশভারী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কি যেমন তেমন করে কথা বলা যায়? সত্যপ্রসাদ কথা বললেন বিশুদ্ধ সাধু বাংলায়। মহর্ষি শুনে তো হতবাক। কেউ এমন বাংলায় কথা বলে, বিস্ময়ের ঘোর লাগে তাঁর মনে, বুঝলেন, ‘বাংলা ভাষা অগ্রসর হইতে হইতে শেষকালে নিজের বাংলাত্বকেই প্রায় ছাড়াইয়া যাইবার জো করিয়াছে।’ মহর্ষিদেব পরের দিনই ডাকলেন মাস্টারমশাইকে। নীলকমলবাবু উপস্থিত হলেন। তাঁকে জানিয়েদিলেন আর পড়ানোর দরকার নেই। নীলকমলবাবুর কাছে বন্ধ হল রবীন্দ্রনাথের বাংলা পড়া।
আরও পড়ুন:

ভালোবাসা এবং ভরসা

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-১ : তার সৌন্দর্যের কথা আগেই শুনেছিলাম, এবার তাকে চাক্ষুষ করলাম

রবীন্দ্রনাথ যখন বেঙ্গল আকাদেমিতে পড়তেন, সে সময় শহর কলকাতায় ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক আকার ধারণ করে। জোড়াসাঁকোর অনেকেই পানিহাটির এক বাগানবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও গিয়েছিলেন পানিহাটিতে। সেখান থেকে ফেরার কয়েকদিন পরই মনের আনন্দে গিয়েছিলেন পিতৃদেবের সঙ্গে হিমালয়ভ্রমণে। ভ্রমণ-শেষে ফিরে এসে আবার স্কুল-ঘিরে না-ভালোলাগা মনের কোণে জাঁকিয়ে বসে। আবারও স্কুল বদল করা হয়।

এরপর রবীন্দ্রনাথ ভর্তি হয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্সে। অধ্যক্ষ ছিলেন ফাদার বি পেনেরান্ডা। অধ্যক্ষমশায় তো বটেই, ওই স্কুলের মাস্টারমশায় হেনরিও রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিলেন। এই সময় তাঁর গৃহশিক্ষকদের মধ্যেও নানা পরিবর্তন ঘটে। ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য। সংস্কৃত পড়াতেন হরিনাথ ভট্টাচার্য। হরিনাথের পরিবর্তে আসেন মেট্রোপলিটান স্কুলের রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ। মেট্রোপলিটানের জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন ‘অতি সরস, অতি সহাস্য ও অতি মজাড়ে’ মানুষ।

সেন্ট জেভিয়ার্সে বছরখানেক পড়ার পর রবীন্দ্রনাথের প্রথানুসারী বিধিবদ্ধ পড়াশোনা শেষ হয়। বাড়িতে গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়াশোনা অবশ্য চলতেই থাকে। কিছুদিন পর সে-পড়াশোনারও ছন্দপতন ঘটে, বিঘ্নিত হয়। জোড়াসাঁকো ছেড়ে‌ কিশোর রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন শিলাইদহে। এরপর বিলেতে, দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content