শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


হেমলতা দেবী।

তাঁর গল্পে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন ‘সাহিত্যিক গুণপনা’। শুধু তাই নয়, কবি দেখেছিলেন, ‘কী মানবচরিত্রের কী তার পারিপার্শ্বিকের চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।’ নিতান্তই গল্প নয়, অধিক কিছু, বলা যায় ‘অভিজ্ঞতার চিত্রপ্রদর্শনী।’ জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা যেন শব্দ-তুলিতে ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে। তাঁর গল্পের বইয়ের জন্য পত্রাকারে লেখা রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ব্লক করে ছাপা হয়েছিল। সে-বইয়ের নাম ‘দেহলি’। তিনি গল্প লিখতেন। পত্রিকা সম্পাদনা ‌করতেন। কবিতাও লিখতেন। কেমন লিখতেন কবিতা, সে-মূল্যায়নের জন্য একটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। লেখক-সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের স্মৃতিমিশ্রিত রচনায় আছে ঘটনাটির বিবরণ। ‘শনিবারের চিঠি’-র সজনীকান্ত ছিলেন দুর্মুখ ও স্পষ্টবক্তা। নিজের জ্ঞান ও বিশ্বাস থেকে যা মনে হতো, তা বলতেন অকপটে। আর কেউ নন, রবীন্দ্রনাথই‌ প্রথম তাঁর কাব্যসাহিত্যের প্রতি সজনীকান্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সজনীকান্ত তখন একটি কাব্যসংকলন সম্পাদনার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথকে সহায়তা করছেন। সংকলনটির প্রথম সংস্করণ আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। কবির তা ‘মনঃপুত’ হয়নি। বিরুদ্ধ-সমালোচনাও হয়েছে যথেষ্ট। তাই সজনীকান্তর সহায়তায় শুরু হয় সংযোজন-বর্জন ও পরিমার্জনের কাজ। নতুন সংস্করণের কাজ তখন শেষের দিকে। সে-সময় রবীন্দ্রনাথ এক কবির কবিতা নিজের হাতে নকল করে সজনীকান্তকে পাঠিয়েছিলেন। পাঠিয়ে লিখেছিলেন, ‘চলে কি না দেখো।’

কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম সজনীকান্ত। সেই মুগ্ধতা কতখানি ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল, তা বোঝার জন্য তাঁর রচনার অংশ-বিশেষ তুলে দেওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘কবিতাটি পড়িয়া বিস্ময়বোধ করিলাম। যে কবির মনের অনুভূতি এ ভাবে ছন্দিত হয় তাঁহার কাব্যসাধনা উপেক্ষণীয় নয়। রবীন্দ্রনাথ যে কবিতাটি নকল করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, শুধু তাহার মধ্যেই বঙ্গীয় কবিসমাজে তাঁহার দাবী অক্ষয় হইয়া আছে।’
যাঁর গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই ভালো-লাগা, কাব্য-সংকলনে যাঁর কবিতা গ্ৰন্থিত করতে কবির আন্তরিক তৎপরতা, তিনি তাঁদের পরিবারেরই একজন। প্রেরিত ও সুপারিশকৃত কবিতাটি কার, সে প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, ‘হেমলতা বৌমার’।

হেমলতা দেবী মহষি দেবেন্দ্রনাথের ‘নাতবৌ’। দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথে স্ত্রী। দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী সুশীলা মারা গিয়েছিলেন অকালে। পত্নীবিয়োগের একমাস পাঁচ দিন পরই তিনি আবারও বিবাহ করেন। পাত্রী হেমলতা ছিলেন পূর্বপরিচিতা। দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যৈষ্ঠ জামাতা মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ভগ্নী। মোহিনীমোহনের ভ্রাতা রমণীমোহন ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের ভাইস-চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় কন্যা ঊষাবতীর বিবাহ হয়েছিল। রাজা রামমোহন রায়ের পরিবারে হেমলতার জন্ম। জীবনবোধে, ভাবনায় তিনি ছিলেন ভিন্নতর, গড্ডলিকাপ্রবাহে শামিল হননি কখনও।

বিলেতের পথে হেমলতা।

ঠাকুরবাড়িতে তাঁর আগে থেকেই যাতায়াত ছিল, আত্মীয়তার সূত্রে। শেষে আরও নিকটজন হয়ে উঠলেন। হলেন বধূমাতা।‌ বধূ হয়ে এসে পেলেন মাতৃহারা দুই সন্তানকে। দ্বিপেন্দ্রনাথের প্রথমা পত্নী সুশীলার সন্তান, পুত্র দিনেন্দ্রনাথ ও কন্যা নলিনীকে।

হেমলতার দাম্পত্য জীবন যে খুব মাধুর্যময় ছিল, তা নয়। দ্বিপেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর বিপরীত। বিলাস-বৈভবে থাকতে ভালোবাসতেন। শান্তিনিকেতনে বসে মদ্যপানও করতেন। শিল্পী মুকুল দে তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, ‘দিপু ঠাকুর খুব ড্রিঙ্ক করতেন। তাঁর মদ খাবার গেলাস আসত বিদেশ থেকে —খুব ভালো কাচ। তাঁর গেলাস ভাঙলে সেই ভাঙা গেলাসের তলাগুলো ঘষে ঘষে আমি লেন্স বানাতাম।’
হেমলতা বিলাসিতা কী জানতেন না। একেবারে সাদামাঠা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। হেমলতার স্নেহভাজন জ্যোতিশ্চন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘বড়মা’র একটি জীবনী রচনা করেছিলেন। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো, দ্বিপেন্দ্রনাথ প্রয়াণের পর হেমলতা শান্তিনিকেতনেই পাকাপাকিভাবে থাকতেন। আশ্রমিকদের কাছে তিনি ছিলেন ‘বড়মা’। উল্লিখিত বইটিতে আছে, ‘ষোড়শ বৎসরের বধূ নিজ রূপ- যৌবনের উদ্দাম স্রোতে ভাসিয়া যান নাই। বিলাস ব্যসনে লঘু আমোদ-প্রমোদে কখনও তিনি নিজকে ডুবিতে দেন নাই — স্থির প্রজ্ঞার মতোই পূর্বসংস্কারে তিনি অবিচলিতা ছিলেন।’
হেমলতার কাছে মাতৃহারা দুই শিশুসন্তন পরম স্নেহে প্রতিপালিত হয়েছে। প্রায়-যুবক বয়স পর্যন্ত দিনেন্দ্রনাথকে নিজের হাতে প্রতিদিন খাইয়ে দিতেন তিনি। ‘দেহলি’ নামে তাঁর যে গল্পগ্রন্থের রবীন্দ্রনাথ ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন, সেটি ওই পুত্র-কন্যাদেরই উৎসর্গ করেছিলেন।

স্বামী বিয়োগের শোকযন্ত্রণা গোপন করে হেমলতা আত্মনিয়োগ করেছিলেন অতিবৃদ্ধ শ্বশুরমশায়ের সেবা-শুশ্রূষায়। ইন্দিরা দেবীকে লেখা দ্বিজেন্দ্রনাথের এক চিঠিতে আছে কীভাবে হেমলতা তাঁকে আগলে রেখেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বৌমা থাকেন কাছের গোড়ায়/ যতনে তাঁহার পরাণ জুড়ায়,/ সুখের সুখিনী দুখের দুখিনী/ এখন আমার, তিনি একাকিনী।’

রবীন্দ্রনাথের লেখা হেমলতার গল্পগ্রন্থের ভূমিকা।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নাত-বউ হেমলতাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ সপরিবারে মহর্ষির পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে বছর সাতেক ছিলেন। মহর্ষির কাছেই হেমলতার ধর্মশিক্ষা। মহর্ষি তাঁর সঙ্গে উপনিষদ নিয়ে প্রায়শই আলোচনা করতেন। হেমলতার প্রতি মহর্ষির শুধু গভীর স্নেহ নয়, তাঁর ধর্মবোধ সম্পর্কেও গভীর আস্থা ছিল। নিজের দীক্ষার আংটিটি মৃত্যুর পর হেমলতাকে দেওয়ার কথাও বলে গিয়েছিলেন তিনি। মহর্ষির জীবনাবসানের পর খাজাঞ্চি যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় হেমলতার হাতে সেই আংটিটি তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘কর্তামহাশয় ইহা আপনাকে দিবার জন্য আমাকে বলিয়া গিয়েছেন, এবং বলিয়াছেন আপনিই ইহার প্রকৃত অধিকারী।’
রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত স্নেহ করতেন হেমলতাকে। তাঁকে পাশে বসিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ দিতেন। কখনও পড়াতেন স্কটের উপন্যাস, কখনও কিটসের কবিতা। এক সময় নিয়ম করে দুপুরের দিকে হেমলতা কবির কাছে পাঠ নিতে যেতেন। কেমন করে পড়াতেন কবি, কৌতূহল জাগাই স্বাভাবিক। হেমলতা লিখেছেন, ‘একবার পড়িয়ে দিয়ে পরদিন সেটা লিখে আনতে বলতেন। লেখাগুলি সংশোধন করে দিতেন নিজ হাতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। এতেই বাংলা ভাষায় ভাব প্রকাশের পথ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু হল…।’ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম গড়ে ওঠার কালে হেমলতার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর আন্তরিকতা, আশ্রমের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথকে আশ্বস্ত করেছিল। আশ্রম-অধ্যক্ষ ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে কবি লিখেছিলেন, ‘বৌমা ছেলেদের যত্ন করিতেছেন ও বিদ্যালয়ের জন্য চিন্তা করিতেছেন। আপনার পত্রে এই সংবাদ পাইয়া আমি অত্যন্ত আনন্দ লাভ করিলাম। তাহাকে আমার আশীর্বাদ জানাইবেন।’

ভিয়েনায় হেমলতা।

নিজের সন্তান ছিল না। আশ্রমের পড়ুয়ারাই ছিল সন্তানতুল্য। হেমলতার কাছে তারা মাতৃস্নেহই পেয়েছে, এ-কথা বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না। তাদের ভালো রাখার জন্য‌ হেমলতার ভাবনার অন্ত ছিল না। আশ্রমরাঁধুনির রান্না ছোটদের কাছে একঘেয়ে লাগত। তাই বুধবার-বুধবার ডাক পড়ত গুরুপল্লীর নিচুবাংলোয়। হেমলতা নিজের হাতে রান্না করে তাদের খাওয়াতেন।

সারাক্ষণই আশ্রম-বালকদের নিয়ে ছিল হেমলতার ভাবনা। তাদের খাওয়াতেন, পড়াতেন। কেউ অসুস্থ হলে শিয়রে বসে থাকতেন। হেমলতার ক্লাস নেওয়ার মধ্যেও অভিনবত্ব ছিল। তাঁর ক্লাস কখনোই ক্লান্তিকর হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ বইয়ের ‘নকল গড়’ কবিতাটি অভিনয় করে করে এমনভাবে পড়াতেন, ছাত্ররা শুধু তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দ পায়নি, কবিতাটি মনে গেঁথে গিয়েছিল।

ঠাকুরবাড়ির বধূমাতাদের মধ্যে হেমলতা দেবী ছিলেন একরকম। স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। সেই ঔজ্জ্বল্য কখনও ফিকে হয়ে যায়নি।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content