বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


দ্বারকানাথ ঠাকুর।

পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি — দুই বাড়িতেই নাটক নিয়ে মাতামাতি ছিল। যাত্রাভিনয়ও হয়েছে। দ্বারকানাথ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথাবার্তা প্রায়শই শোনা যায়। তাঁর চরিত্রের নানা আলোকিত দিক আড়ালে রাখতেই আমরা অভ্যস্ত! নাটকেরও তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বঙ্গদেশে বাঙালি-প্রতিষ্ঠিত নাট্যশালা তখনও তৈরি হয়নি। দ্বারকানাথ বিদেশি রঙ্গালয়ের সঙ্গে সানন্দে যুক্ত হয়েছিলেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও নাটক দেখতে রঙ্গালয়ে যেতেন। নাট্যালয়ের কল্যাণে আর্থিক সাহায্য করেছেন। দ্বারকানাথের বৈমাত্রেয় ভাই রমানাথ ঠাকুরও রঙ্গালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

দ্বারকানাথের মতো তাঁর পুত্ররাও সংগীতচর্চায়, গানবাজনায় উৎসাহী ছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও প্রথম-জীবনে আনন্দে আমোদে মজে থাকতেন। ওস্তাদ রেখে কালোয়াতি গান শিখতেন। পিয়ানো বাজাতেন। খুবই ফুর্তিবাজ মানুষ ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের মাধ্যমভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথেরও যাত্রায়, নাটকে আগ্ৰহ ছিল। তাঁর লেখা ‘বাবুবিলাস’ মঞ্চস্থ হয়েছিল, নিজেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। যাত্রা-নাটকের প্রতি গিরীন্দ্রনাথের অফুরান ভালোবাসা ছিল। দুঃখের বিষয়, বড় অকালে মাত্র‌ চৌত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন তিনি। দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথও ছিলেন নাট্যানু্রাগী। ভালো অভিনয় করতেন।‌ তিনিও অকালে, মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়েসে প্রয়াত হয়েছিলেন।

গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

গিরীন্দ্রনাথের দুই পুত্র গণেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ ছিলেন নাট্যাভিনয়ে প্রবল উৎসাহী। গণেন্দ্রনাথ যুবক-বয়েসে অকালে মারা গেলেও তাঁর প্রভাব রবীন্দ্রজীবনে অনেকখানি। রবীন্দ্রনাথ সে-প্রভাবের কথা ‘জীবনস্মৃতি’তে জানিয়েছেন। তাঁর প্রতি অমোঘ আকর্ষণের কথা কবি এ-ভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘তিনি আপনার চারদিকের সকলকে টানিতে পারিতেন, বাঁধিতে পারিতেন। তাঁহার আকর্ষণের জোরে সংসারের কিছুই যেন ভাঙিয়াচুরিয়া বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িতে পারিত না।’

গুণেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় — এই তিনজন মিলে ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’ প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন। সূচনাপর্বে মঞ্চস্থ হয়েছিল মাইকেল মধুসূদনের দুটি নাটক, ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও ‘একেই কি বলে সভ্যতা’। অচিরেই একেবারে আনকোরা নাটক মঞ্চস্থ করার ইচ্ছে জাগে। সমাজের কোনো অনাচার-কদাচার নিয়ে যদি সে-নাটক লেখা হয়, তবে তো আরও ভালো হয়! যেমন ভাবা, তেমন কাজ। গণেন্দ্রনাথ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বহুবিবাহ বিষয়ক নতুন নাটক লেখার ডাক দিলেন। বিজ্ঞাপনে জানানো হয়েছিল, নাটক পছন্দ হলে দেওয়া হবে পাঁচশো টাকা পুরস্কার। কাজও হয়েছিল সে- বিজ্ঞাপনে। বেশ কয়েকটি নাটক জমা পড়েছিল। রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘নবনাটক’ সবার মনে ধরেছিল। আয়োজন করা হয় অভিনয়ের। নাটকটি সকলেরই ভালো লেগেছিল। বানানো নয়, সমাজজীবনের আলেখ্য বলেই আরও বেশি ভালো লেগেছিল।

নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নাটকের প্রতি পরিবারের সকলের এই আগ্রহ-আকর্ষণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে প্রাণিত করেছিল।‌ তিনি নিজেও নাট্যরচনায় মনোযোগী হয়েছিলেন। সেই শুরু, ঠাকুরবাড়িতে একের পর এক নাটক লেখা হয়েছে, অভিনীত হয়েছে। প্রথমদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথই লিখেছেন। অচিরে সে-আসরে যোগ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। লেখা হয়েছে রকমারি নাটক। গীতিনাট্য, হেঁয়ালিনাট্য ও কৌতুকনাট্য। নিজের লেখা ‘মানময়ী’ গীতিনাট্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে শুধু নন, অভিনয় করেছিলেন তাঁর পত্নী কাদম্বরী দেবীও। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন শিল্পী-তালিকায়। শচী সেজেছিলেন কাদম্বরী।

এই নাটকে একটি গান ছিল, ‘সজনী লো বল্, কেন কেন এ পোড়া প্রাণ গেল না,/ এনে দে, এনে দে বিষ,আর যে লো পারি নে।’ ইন্দিরা দেবীর লেখায় আছে, ‘চমৎকার গানটি গেয়ে গেয়ে বেড়াতুম।’ তখন আর কে জানত, নাটকের এক অভিনেত্রী, শচী সাজা কাদম্বরীর জীবনে এই গানটি সত্যি হয়ে উঠবে! তাঁর দুর্বিষহ জীবন বিষ খুঁজেছিল, বিষ খেয়েই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন!
অল্প সময়ের মধ্যেই ঠাকুরবাড়িতে‌ নাট্যরচনায়, অভিনয়ে জোয়ার এসেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘এমন কর্ম আর করব না’ অভিনীত হয়েছে। এ-নাটকে প্রধান চরিত্র অলীকবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, ‘রবিকাকার ওই তো সুন্দর চেহারা, মুখে কালিঝুলি মেখে চোখ বসিয়ে দিয়ে একটা অত্যন্ত হতভাগ্য ছোঁড়ার বেশে’ মঞ্চে এসেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেজেছিলেন চিনেম্যান। চিনা ভাষায় তাঁর কথাবার্তা দর্শকরা খুবই উপভোগ করেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বান্ধব অক্ষয় চৌধুরির স্ত্রী শরৎকুমারী অভিনয় করেছিলেন হেমাঙ্গিনীর ভূমিকায়। যখন তিনি বঁটি হাতে ‘এই বন্দীই আমার প্রাণেশ্বর’ বলে উঠতেন, তখন হাসি আর বাঁধ মানত না।‌‌

এই নাটকে অবনীন্দ্রনাথও অভিনয় করেছিলেন। তিনি সেজেছিলেন ব্রজদুর্লভ। এক ‘বখাটে বুড়োর’ চরিত্র। হেমাঙ্গিনীকে যারা বিবাহে উন্মুখ, তাদের মধ্যে ব্রজদুর্লভও ছিল। অবনীন্দ্রনাথ পরেছিলেন নীল-রঙা জামা। সিল্কের জামাটি ছিল তাঁর ফুলসজ্জার। সে সময় এ ধরনের জামা বিবাহ-রাতে পরার প্রবণতা ছিল। সোনার গার্ড-চেন বুকে, কুঁচিয়ে পরেছিলেন ধুতি। বুক-পকেটে গোঁজা ছিল ফুল। হাতে শিঙের ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে একটু-একটু মাতলামির ভাব এনে, প্রণয়প্রার্থী ব্রজদুর্লভের বেশে মঞ্চে এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ যে গান মঞ্চ-আহরণকালে গাইতে বলেছিলেন তাঁকে, সে গান অবনীন্দ্রনাথ কণ্ঠে ধারণ করেননি। মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের সুর দেওয়া ওই গান তাঁর গলায় আসবে না। রাধানাথ দত্ত বলে একজন প্রায়শই মদ্যপান করে জড়ানো গলায় গান গাইতে গাইতে, ছড়ি ঘুরিয়ে জোড়াসাঁকোর পাশ দিয়ে হেঁটে যেত। তাকে হুবহু নকল করে, কণ্ঠে গান নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন। মাতাল-গলায় গেয়েছিলেন, ‘আয় কে তোরা যাবি লো সই /আনতে বারি সরোবরে।’ দু’লাইন গাইতে না গাইতেই হাততালির ঝড় ওঠে! যাকে অনুকরণ করে এই গান, সেই রাধানাথ দত্ত ছিল দর্শকাসনে। সব বুঝতে পেরেছিল। মুহূর্তে‌ মুখ গম্ভীর হয়ে যায় তার। রাধানাথ ছাড়া‌ উপস্থিত সকলেই বাহবা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘বেড়ে করেছ অবন, এ গানটা যা হয়েছে, চমৎকার!’

রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটকই অভিনীত হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। কখনও ‘বিসর্জন’, কখনও ‘রাজা ও রানী’, কখনও-বা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। রিহার্সালে চলত খাওয়া-দাওয়া, রঙ্গ-রসিকতা। খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন হত। বিকেলে চা দিয়ে শুরু, রাতের ডিনার দিয়ে শেষ। কত ঘটনা ঘটেছে, অঘটনও কম ঘটেনি! একদিন অভিনয় হচ্ছে ‘রাজা ও রানী’। ড্রপ সিনের দরকার, ঠিক তখনই তা পড়বি তো পড় একেবারে পড়ল গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনীর মাথায়! বউঠান জ্ঞানদানন্দিনীকে এক ঝটকায় টেনে সরিয়ে দিয়েছিলেন নাটকের এক অভিনেতা, তিনি রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথ সেই দুর্ঘটনার সাক্ষী। সব দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘আরেকটু হলেই হয়েছিল আর কী!’

বিসর্জন নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লেডি ল্যান্সডাউনের মতো কেউকেটা মেমসাহেব জোড়াসাঁকোয় আসছেন, আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন, এই বার্তা পেয়ে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অভিনয়ের আয়োজন হয়েছিল। ভারি সুন্দর করে মঞ্চ সাজানো হয়েছিল, মঞ্চভাবনায় অভিনবত্ব ছিল। অবনীন্দ্রনাথের ‘ঘরোয়া’ থেকে জানা যায়, মঞ্চে সত্যিকারের গাছপালা দিয়ে বানানো হয়েছিল ‌বনজঙ্গল। বৃষ্টির দৃশ্য ছিল নাটকে। বাস্তবে যেমনভাবে বৃষ্টি হয়, তেমনভাবেই বৃষ্টি নেমেছিল মঞ্চে। দোতলার বারান্দা থেকে টিনের নল প্রবেশ করানো হয়েছিল মঞ্চে। বাইরে থেকে দৃশ্যমান নয়, প্রয়োজন মতো আড়ালে থাকা নলটিকে কাজে লাগিয়ে মঞ্চে বৃষ্টিধারার নিখুঁত দৃশ্য নির্মিত হয়েছিল।

ত্রিপুরার রাজকাহিনি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘বিসর্জন’ নাটকটি। ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যকে দেখানোর জন্য ‘বিসর্জন’ অভিনীত হয়েছিল জোড়াসাঁকোয়। রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অভিনয় করতে করতে তিনি খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। স্টেজের একপাশে ছিল মাটি দিয়ে গড়া কালীমূর্তি। ঠিক সময় নেপথ্য থেকে কেউ সেই কালীমূর্তি সরিয়ে ফেলবে, এমনই ছিল ব্যবস্থা! তার অপেক্ষা না করে, রঘুপতি সাজা রবীন্দ্রনাথ দু’হাতে কালীমূর্তিটি তুলেছিলেন। কী করতে চাইছেন, প্রথমে তা বোঝা না গেলেও ভীষণ রকমের যে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, তা শরীরী ভাষায় বোঝা গিয়েছিল! অভিনয়ের মাঝে কেন এরকম উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, জানতে চাওয়ায় অবনীন্দ্রনাথকে তিনি বলেছিলেন, ‘উত্তেজনার মুখে মূর্তি তো তুলে নিলুম, ছুঁড়তে গিয়ে দেখি ও পাশে বিবি না কে যেন হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে; এই মাটির মূর্তি চাপা পড়লে তবে আর রক্ষে নেই — হঠাৎ সামলে তো নিলুম, কিন্তু কোমর ধরে গেল।’

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই ‘বিবি’ আর কেউ নন, ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ‌ করতেন। জানা যায়, মঞ্চে সে-কালীমূর্তি তুলতে গিয়ে কোমরে এমন টান লেগেছিল যে, তাঁকে এক মাসেরও বেশি ভুগতে হয়েছিল।

নাটক অভিনয় করা নিয়ে ঘটেছে কত ঘটনা, এমনতরো নানা বিপত্তি! ‘বৈকুন্ঠের খাতা’ অভিনয়কালে রবীন্দ্রনাথ পার্টই ভুলে গিয়েছিলেন। তালেগোলে ভুলে গিয়ে প্রথম দৃশ্য বাদ দিয়ে নাটকটি শুরু করেছিলেন তিনি।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে নাট্যাভিনয়কে ঘিরে কত ঘটনাই না ঘটেছে!‌ সে-জীবন ছিল আনন্দময়। তেমন আনন্দ‌ আমাদের জীবন থেকে এখন অস্তমিত।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content