বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দেশ তখন বিপন্ন, অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শাসনের নামে চলেছে সীমাহীন শোষণ, ভয়াবহ অত্যাচার। ইংরেজ সরকার‌ দেশটাকে লুটেপুটে খেতে চায়! দেশের মানুষ তা মেনে নেবে কেন! জেগে উঠেছে, রেগে উঠেছে। একত্রিত হয়েছে। মানুষ মিলেছে ‘মায়ের ডাকে’, দেশমাতৃকার আহ্বানে।‌ জাগ্রত, দেশের জন্য নিবেদিত-প্রাণ সেই মানুষের ভিড়ে ঠাকুরবাড়ির মানুষজনও ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, ‘একলা চলো রে’ বললেও চলার পথে শামিল হয়েছিলেন পরিবারের কেউ কেউ। কখনও আড়াল থেকে, কখনও বা সরাসরি সামনে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মনেপ্রাণে চেয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলন আরও আরও বেগবান হয়ে উঠুক, সফল হোক।
ঠাকুরবাড়িতে বিপ্লবীরা আসতেন মূলত গগনেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথের কাছে। বাড়ির আরও কারও কারও সঙ্গে আড়াল রেখে, চোরাগোপ্তা যোগাযোগ ছিল। প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর পুত্র সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে। সুরেন্দ্রনাথ একসময় অনুশীলন সমিতির কোষাধ্যক্ষও হয়েছিলেন। শুধু নিয়মিত অর্থ-সাহায্য নয়, বিপ্লবীদের তিনি রিভলবারও জুগিয়েছিলেন। ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে বাঙালি বিপ্লবীদের যোগাযোগের কথা তো সুবিদিত! ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথের ছিল সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক। নিবেদিতার মাধ্যমে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল ওকাকুরার সঙ্গে। অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, ওকাকুরা এদেশে প্রথম এসে সুরেন্দ্রনাথের বাড়িতেই ছিলেন।

ওকাকুরা তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, ‘ওকাকুরার উদ্যোগে, ভারতকে স্বাধীন করিবার উদ্দেশ্যে, ভারতে মুক্তির বাণী প্রচার করিবার জন্য’ কয়েকজনকে একত্রিত করে মহাদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে নিবেদিতা ছিলেন। ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরও।

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর

অরবিন্দ ঘোষের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। অরবিন্দ তাঁর ওপর নানা ব্যাপারে নির্দ্বিধায় নির্ভর করতেন। ‌সুরেন্দ্রনাথের সূত্রেই বিপ্লবীদের সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথের পরিচয় হয়ছিল। গগনেন্দ্রনাথ নানাভাবে, এমনকি অর্থ দিয়েও সাহায্য করতেন।

দৌহিত্র মোহনলাল দাদামশায় গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। ঠাকুরবাড়িতে বিপ্লবীরা ‌কে কে আসতেন, ওই বইতে রয়েছে সে-বিবরণ, ‘বারীন ঘোষ এসেছেন, উল্লাসকর এসেছেন, খুব সম্ভব রাসবিহারী বসু এবং অরবিন্দ ঘোষও এসেছেন। আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের প্রায় সকলেরই যোগাযোগ ছিল সুরেন ও গগনের সঙ্গে।’

মোহনলালের লেখার সূত্র ধরেই জানা যায়, বিপ্লবী কানাইলাল ও নরেন গোঁসাইয়ের নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঠাকুরবাড়িতে। অনুশীলন সমিতি বা যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা বিপ্লবীরাও প্রায়শই আসতেন।

ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দা নিয়ে আমাদের আগ্রহ-কৌতূহলের শেষ নেই। ‘দক্ষিণের বারান্দা’ নামে মোহনলাল একটি বইও লিখেছিলেন। ওই বারান্দার নিচে হঠাৎই একদিন দেখা গেল, একটা সাইকেল দাঁড় করানো রয়েছে। গগনেন্দ্রনাথ নিজেই যে চৌরঙ্গীর দোকান থেকে ওই বিলিতি সাইকেল কিনে এনেছিলেন, তা‌ তিনি খোলাসা করেননি। সাইকেলটি বিপ্লবীদের দেওয়ার জন্য কিনেছেন, তা বেমালুম চেপে গিয়ে হেসে বলেছেন, ‘এটা কিনেছি, দেখি চালাতে পারি কিনা!’

ক’দিন পর সিঁড়ির নিচে দাঁড় করানো ঝলমলে সেই সাইকেলটি আর দেখা গেল না! সকলেরই এক জিজ্ঞাস্য, ‘হারিয়ে গেল, নাকি চুরি করে কেউ পালালো?’ গগনেন্দ্রনাথ বললেন, ‘তাই তো, গেল কোথায়, কেউ চড়তে নিয়ে গেছে কিনা কে জানে!’
গগনেন্দ্রনাথ আসলে সাইকেলটি দিয়েছিলেন অনুশীলন সমিতিকে, খবরাখবর আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহারের জন্য। কদিন পরই এল দুঃসংবাদ। জানা গেল, মানিকতলায় বিপ্লবীদের গুপ্ত আড্ডায় হানা দিয়েছে পুলিশ। বিপ্লবীরা ধরাও পড়েছে। চলেছে জোর খানাতল্লাশি। পুলিশ উদ্ধার করেছে বোমা তৈরির মশলাপাতি, সরঞ্জাম।

এই সংবাদে গগনেন্দ্রনাথ একটু বিচলিতই হয়েছিলেন। মা তো আশ্রয়ের মতো! খানিক দিশেহারা হয়ে মা সৌদামিনীকে সব কথা খুলে বলেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। বোমার‌ তৈরির আসামি হিসেবে যাঁরা ধরা পড়েছে, তাঁদের টাকা দেওয়া, বাড়িতে বন্ধ ঘরে স্বদেশি-বই রাখা, মায়ের কাছে সব বলেছেন অকপটে, বাদ দেননি‌ কিছুই। বইগুলো দেখিয়ে পুলিশ হয়তো প্রমাণ করে ছাড়বে ‘গগন কত বড় স্বদেশিওয়ালা’, এমনই মনে হয়েছিল মায়ের। সব শুনে ছেলেকে বলেছিলেন, ‘চাঁদার টাকা দিয়েছ, ভালোই করেছ। কিন্তু সাবধানের মার নেই, সব বই পোড়াও।’

মোহনলালের লেখা থেকে জানা যায়, ‘দালানে ফেলে সেই বইয়ের পাহাড় আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেওয়া’ হয়েছিল। স্বাদেশিকতাবোধ জাগানো নিয়ে গান-কবিতার সে-সংকলনে রবীন্দ্রনাথ-
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখাও ছিল।

মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়

জোড়াসাঁকোতে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কিনা, তা দেখার জন্য সত্যি পুলিশ এসেছিল! গগনেন্দ্রনাথের কন্যা পূর্ণিমা দেবীর ‘ঠাকুরবাড়ির গগন ঠাকুর’ বইতে আছে সে-বিবরণ, ‘হঠাৎ শোনা গেল, পুলিশ আসবে বাড়ি সার্চ করতে। যদিও কিছু সন্দেহজনক মাল ছিল না, বইটই, যেমন ‘আনন্দমঠ’ ইত্যাদি যা দু-একখানা ছিল বাবা সরিয়ে ফেলেছিলেন। পুলিশ কিছু না পেয়ে চলে যায়। দিদিমা ভয়ে অস্থির হন। তারপর তাঁতটাত সব জমিদারিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।’

ঠাকুরবাড়িতে, বিশেষ করে গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের কাছে উচ্চপদস্থ সাহেবসুবোরা প্রায়ই আসতন। তাঁরা ছিলেন ছবির অনুরাগী, গুণগ্রাহী। ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়, যে বাড়িতে লাটসাহেবের নিত্যি আনাগোনা, সে বাড়িতে একই দরজা দিয়ে বিপ্লবীরাও আসতেন। বিপ্লবীরা অবশ্য আসতেন নিজেদের আড়াল করে, গোপনে,নিঃশব্দ- চরণে।

ঠাকুরবাড়ি মেয়েরা অনেকেই চরকা কাটতেন। সৌদামিনী দেবী পুত্রবধূদেরও চরকা কিনে দিয়েছিলেন। তাঁদের চরকা-কাটার এই অভ্যেস‌ সেই হিন্দুমেলার কাল থেকে। তখনও গান্ধীজির চরকা কাটতে শুরু করেননি। চরকা কাটাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে স্বাদেশিকতাবোধ জাগানোর প্রয়াসও শুরু হয়নি। গান্ধীজির সঙ্গে সরলা দেবীর নৈকট্য, সেও পরের কালের কথা। গান্ধীজির চরকা-আন্দোলনকে ঘিরে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন পড়েছিল। ভাঁড়ারঘরে রাখা সব চরকা বার করা হয়েছিল।‌ মেয়েরা নিয়ম করে সুতো কাটতেন। বঙ্গভঙ্গের দিনে ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউরা অরন্ধন করেছিলেন। বিলেতি কাপড়ও হেলায় ত্যাগ করেছিলেন।

সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ভারতমাতার ছবি স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষজনকে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি ছবিকে ঘিরে এমনতরো আলোড়ন সচারচর দেখা যায় না। ‌ সুধীন্দ্রনাথের পুত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ তরুণ বয়সে গান্ধীজির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ক্রমেই সেই আকর্ষণ শিথিল হয়ে আসে। সৌম্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজাফফর আহমেদের পরিচয় হয়। ক্রমে বামপন্থার প্রতি তাঁর আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। চোখেমুখে নতুন দিনের স্বপ্ন। ভয়ডরহীন, খানিক বেপরোয়া। জোড়াসাঁকোয় সৌম্যেন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় বোমাও তৈরি হয়েছে।‌ তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘যাত্রী’তে লিখেছেন, ‘আমি নিজে টেরারিস্ট দলভুক্ত কখনো ছিলুম না। কিন্তু এই দলগুলির বহু কর্মীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাই এদের মধ্যে কেউ কেউ যখন বললে যে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আমার একতলার ঘরে আমি যদি এদের বোমা তৈরি করতে দিই, তাহলে তাদের কাজের খুব সুবিধা হয়। আমি রাজি হলুম। রবীন্দ্রনাথ কিংবা আমার পিতা কি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন যে তাঁদের বাড়িতে বোমা তৈরি হচ্ছে টেগার্টর মারবার জন্য।’

কুখ্যাত চার্লস টেগার্ট, সে সময় কলকাতার পুলিশ কমিশনার, তাঁকে মারার জন্য বোমা বাঁধা হচ্ছে ঠাকুরবাড়িতে, ভাবা যায়?

নবজাগরণের আলোয় আলোকিত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবার সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, শিক্ষায় বড় ভূমিকা নিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে দিনগুলিতেও এই পরিবারের কেউ কেউ যথেষ্ট সক্রিয় হয়েছিলেন। স্বদেশি উত্তেজনায় ঠাকুর— পরিবারের মানুষজন কী পরিমাণে উত্তেজিত হয়েছিলেন, নানা স্মৃতিচর্চায় তা ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা কয়েকটির মাত্র উল্লেখ করলাম। শুধুই কলমসর্বস্ব নয়, বাস্তবের মাটিতে পা রেখে তাঁরা সামিল হয়েছিলেন স্বাধীনতা-সংগ্রামে।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content