শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


আগের দিন ছিল শ্রাবণ-পূর্ণিমা। সে জ্যোৎস্না-রাত ছিল উৎকণ্ঠার, দুশ্চিন্তার। কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর লেখায় আছে সেই ঘনঘোর দুর্যোগময় রাতের বর্ণনা। চাঁদের আলোও তাঁর‌ কাছে ‘ম্লান’ মনে হয়েছিল। কবি বড় স্নেহ করতেন প্রতিমাকে। বলতেন, ‘মামণি’। সেবায় শুশ্রূষায় ‘বাবামশায়’কে তিনি ভালো রেখেছিলেন। প্রতিমার শুধু নয়, সকলের কাছেই সে-রাত ছিল আতঙ্কের। মৃত্যুর পদধ্বনি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। প্রতিমা দেবী তাঁর ‘নির্বাণ’ বইতে লিখেছেন, ‘সন্ধ্যা থেকেই সকলে জানত আজকে তাঁর জীবন-সংশয়, বারাণ্ডায় মাঝে-মাঝে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, ডাক্তারদের অনেকগুলো গাড়ি নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে উঠনে, রুগীর ঘরে আলো জ্বলছে, বুঝছি অবস্থা ভালো নয়, ভালো বোধ করলে আলো নিবনো থাকে। কিছু খবর নিতেও সাহস হচ্ছে না, কী জানি, কী শুনব। লোকজন পা টিপে-টিপে যাতায়াত করছে, যেন একটা থমথমে ছায়া পড়েছে বাড়ির চারিদিক ঘিরে।’

রাতের অন্ধকার এক সময় মুছে যায়। দিনের আলো ফোটে। অসুস্থতার দিনগুলিতে কবি সকাল হলেই বলতেন, পূর্বদিকে মুখ ঘুরিয়ে দিতে। বালিশের উপর বালিশ দিয়ে উঁচু করে, সেই বালিশ-স্তূপে হেলান দিয়ে তাঁকে বসাতে হতো। না, সেদিন আর তেমন ভাবে খাটে বসিয়ে দিতে বললেন না। খাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন চিনা ভবনের এক অধ্যাপক। হাতে জপমালা। ইষ্টদেবতার নাম জপছিলেন তিনি। মহর্ষিদেবের প্রপৌত্র অজীন্দ্রনাথের পত্নী, কবির পরম স্নেহভাজন অমিতা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে একটু একটু করে জল দিচ্ছিলেন। খুব সতর্কতার সঙ্গে দেওয়া, বিষম খেলে ঘোরতর বিপদ হতে পারে। কানের কাছে মুখ নিয়ে শোনাচ্ছিলেন কবির প্রতিদিনের ধ্যানের মন্ত্র, ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্।’
সাতটায় এলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ও ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বসলেন কবির খাটের পাশে, পায়ের দিকে। উপনিষদ থেকে পাঠ করলেন ‘ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি,/ নমস্তেহস্তু মা মা হিংসীঃ।’ বারান্দা থেকে ভেসে আসছে, কবির কোনও প্রিয়জন মৃদুকণ্ঠে গান ধরেছেন, ‘কে যায় অমৃতধামযাত্রী’। কবির পা ছুঁয়ে মনে মনে কেউ-বা মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছেন, ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’। যেন সব আলো এখুনি নিভে যাবে। বিপন্ন-বিষণ্ণ মনে একটাই প্রশ্ন, এই অন্ধকার-পথ পার হবে কী করে!

অন্য দিনের মতো আলো ঝলমলে সকাল নয়। মেঘলা আকাশ। যে কোনও সময় বৃষ্টি আসবে। আকাশও বুঝি কাঁদবে। রোদন-ভরা বাইশে শ্রাবণ। ঘরে অনেক মানুষ। উৎকণ্ঠিত, চোখে মুখে দুশ্চিন্তা। নির্মলকুমারী মহলানবিশ ও রানি চন্দ কবির পা ছুঁয়ে একটু পরে পরেই দেখছেন, এখনও গরম আছে তো, নাকি ঠান্ডা হয়ে আসছে! কবির খাটের ডানদিকে দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ হেমলতা। রয়েছেন কবিরাজ বিমলানন্দ ও দিলীপকুমার রায়। রবীন্দ্র-অগ্ৰজ হেমেন্দ্রনাথের পৌত্র হৃদিন্দ্রনাথের পত্নী অমিয়া এনেছিলেন চাঁপাফুল‌। গুরুদেবের গা সাদা শালে ঢাকা। নির্মলকুমারী অমিয়ার আনা সেই চাঁপাফুল ছড়িয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের পায়ে। অনবরত ফোন বাজছে। দেশের ফোন, বিদেশের ফোন। চেনা মানুষের ফোন, অচেনা মানুষের ফোন। অন্য একটি ঘরে ফোন সামলাচ্ছেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস।

কবির শারীরিক সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বেলা ন’টা থেকে অক্সিজেন দেওয়া শুরু হয়েছিল। অবস্থার উন্নতি হয়নি। সময় যত গড়িয়েছে, পরিস্থিতি ততই জটিল হয়ে উঠেছে। কবি অক্সিজেন যে ঠিক মতো নিতে পারছিলেন না, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। রানি চন্দ কবিকে তো ছুঁয়েই ছিলেন, হঠাৎই তাঁর মনে হল, গুরুদেবের পায়ের উষ্ণতা কমে আসছে!
এলো সেই কালবেলা। বারোটা দশে রবি গেলেন অস্তাচলে। তাঁর ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে উপরে উঠল। খুব কষ্ট করেই তুললেন। উপরে তুলে কপালে ঠেকাতেই হাতটি পড়ে গেল। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল বনমালী। চোখে জল, মুখ কালো। ‘পুরাতন ভৃত্য’ কাঁদছে‌।

বাইরে মানুষের কোলাহল। বাঁধভাঙা জনতা। কবিকে একবার শেষ-দেখা দেখতে চায়, একটু ভেতরে ঢুকতে চায়। সেই সমবেত চাওয়া অচিরেই শোভনতা হারায়, পরিবেশ বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। বাইরে যখন আগ্ৰহের আতিশয্য, ভেতরে তখন কবিকে সাজানো হচ্ছে রাজবেশে। সে সময় রানি চন্দ দিনের পর দিন কবির সেবা করেছেন। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের পাশে তিনি নিত্যদিন থাকতেন। তাঁর ‘গুরুদেব’ বইতে আছে বিদায়বেলায় ‘সাহিত্যরাজ’কে রাজার মতোই সাজানো হয়েছিল। বইটি থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘গুরুদেবকে সাদা বেনারসী-জোড় পরিয়ে সাজানো হল। কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, পাটকরা চাদর গলার নীচ থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো, কপালে চন্দন, গলায় গোড়ে মালা, দু’ পাশে রাশি রাশি শ্বেতকমল রজনীগন্ধা। বুকের উপরে রাখা হাতের মাঝে একটি পদ্মকোরক ধরিয়ে দিলাম; দেখে মনে হতে লাগল যেন রাজবেশে রাজা ঘুমচ্ছেন রাজশয্যার উপরে।’
শান্তকণ্ঠে একের পর এক ব্রহ্মসংগীত কেউ গেয়ে চলেছেন। এক এক করে কত মানুষ আসছেন। কাছের মানুষ, দূরের মানুষ। গুরুদেবের পায়ে প্রণাম নিবেদন করে ধীরে ধীরে তাঁরা চলে যাচ্ছেন। চোখে মুখে যন্ত্রণাকাতরতা, প্রিয়জন হারিয়ে সকলেই শোকধ্বস্ত।

নন্দলাল বসু বেশ কয়েকজন মিস্ত্রি এনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কবির শেষযাত্রার পালঙ্ক তৈরি করালেন। ততক্ষণে জোড়াসাঁকোয় জড়ো হয়েছে অসংখ্য মানুষ। বলা যায়, জনারণ্য। তিনটের পর পথে জনস্রোত। পশ্চিমের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন শোকস্তব্ধ রানি চন্দ। সেই জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, ‘জনসমুদ্রের উপর দিয়ে যেন একখানি ফুলের নৌকা নিমেষে দৃষ্টির‌ বাইরে ভেসে চলে গেল।’ জানালা দিয়ে শেষবারের মতো‌ ‘বাবামশায়’কে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন প্রতিমা দেবী। তাঁর সে-সময়ের অনুভূতি ধরা রয়েছে ‘নির্বাণ’ বইটিতে। বড় মরমী সে-বর্ণনা, ‘একটা প্রকাণ্ড মানবসমুদ্রের ঢেউ তাঁর দেহ গ্ৰাস করে নিল চকিতে। যে মহামানব তাঁর ধ্যানের উপলব্ধি, সেই বিরাট মানবহৃদয়ের সাগর থেকে আজ বান ডেকে উঠেছে। তারই উত্তাল তরঙ্গ তাঁর দেহকে পার্থিব জগৎ থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল …।’

শ্মশানের পথে।

অবনীন্দ্রনাথকে তাঁর ‘রবিকাকা’ অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সারাক্ষণ তিনি শবযাত্রার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। কবিকে নিয়ে সেই জনপ্লাবন জোড়াসাঁকো ত্যাগ করার পর বিধ্বস্ত-মনে‌ নিজের ঘরে ফিরে এসেছিলেন তিনি। এসে শুনলেন, জড়ো হওয়া জনতার উচ্ছ্বাস দেখে রথীন্দ্রনাথ ‘অত্যন্ত কাতর ও ভীত’ হয়ে পড়েছেন।

অবনীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন তাঁর পুত্র অলোকেন্দ্রনাথ। সেই ‘ছবির রাজা ওবিনঠাকুর’ বইটিতে আছে, ‘রথীন্দ্রনাথ চিরদিন গোলমাল, হট্টগোল, মানুষের ভীড় থেকে বহু দূরে থাকতে ভালোবাসতেন। …মৃত্যুর আঘাতে যখন তিনি শোকে মুহ্যমান, তখন এই প্রচণ্ড জনস্রোতের রূপ আর তাদের গলার শব্দ শুনে তিনি একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়লেন।’

নিমতলা শ্মশানের প্রবেশ-মুখে জনারণ্য।

অবনীন্দ্রনাথ শোকদগ্ধ রথীন্দ্রনাথকে বোঝালেন। বললেন, ‘বহু পুণ্যের ফলে বিশ্বকবির ছেলে হয়ে তুমি যদি বাপের শেষ কাজ করতে না পারো তাহলে জানবো তোমার মতো হতভাগ্য পৃথিবীতে আর দুটি নেই। যাও, যেমন করে পারো বল সঞ্চয় করো। বেরিয়ে পড়ো।’

অবনীন্দ্রনাথের কথায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। নিমতলায় পৌঁছে দেখলেন জনস্রোতে নেমেছে জোয়ার। জোড়াসাঁকোয় শবযাত্রার সূচনাকালে যে পরিমাণে লোক ছিল, তা বাড়তে বাড়তে এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এত ভিড় যে দাহস্থলে পৌছোনোই দায়! ভয়াবহ ভিড় এড়ানোর জন্য রথীন্দ্রনাথ নৌকো‌য় উঠেও যথাসময়ে দাহস্থলে পৌঁছতে পারলেন না। দাহকর্মের আগে যে সব নিয়মরীতি থাকে, তা ততক্ষণে সারা হয়ে গিয়েছে। সকলের মুখে এক কথা, আর বিলম্ব নয়। শেষে রথীন্দ্রনাথের পরিবর্তে কবির মুখাগ্নি করেছিলেন সুবীরেন্দ্রনাথ। তিনি কবির ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথের পুত্র। পিতৃদেবের মুখাগ্নি করতে না পারার দুঃখ রথীন্দ্রনাথের মনে জীবনভর রয়ে গিয়েছিল।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content