মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের তিনকন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা ও মীরা যে আনন্দে দিন যাপন করেছেন, মনোরম তাঁদের দাম্পত্যজীবন, তা নয়। তিনকন্যারই অসুখী দাম্পত্যজীবনের সাক্ষী থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন সব সমস্যা সমাধান হোক, মেয়েরা তাঁর ভালো থাকুক।

মুখ দিয়ে রক্ত তুলতে তুলতে কিশোরী-বয়সেই রেণুকার জীবনদীপ নিভে গিয়েছিল। বড়মেয়ে মাধুরীলতা মারা গিয়েছিলেন বত্রিশ বছর বয়সে। ছোটমেয়ে মীরা অবশ্যই দীর্ঘজীবী হয়েছিল। আর পাঁচটা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে যেভাবে দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মাধুরীলতার বিয়েতে পণের টাকা জোগাড় করতে তাঁকে জেরবার হতে হয়েছে। বন্ধু-কবি প্রিয়নাথ সেন বিয়ের যোগাযোগে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। নিজের অসহায়তার কথা তিনি অকপটে বন্ধু প্রিয়নাথকে লিখেছিলেন, ‘মোটের উপর ১০,০০০ পর্যন্ত আমি চেষ্টা করতে পারি।… সাধারণত বাবামশায় বিবাহের পর দিন ৪/৫ হাজার টাকা যৌতুক দিয়ে আশীর্বাদ করে থাকেন —সেজন্যে কাউকে কিছু বলতে হয় না। বিশ হাজার টাকার প্রস্তাব আমি তাঁর কাছে উত্থাপন করতেই পারব না।’

যত কষ্টই হোক, পছন্দের পাত্রটিকে হাত-ছাড়া করতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। অচিরেই শুরু হয়েছে বিবাহের প্রস্তুতি।

ঠাকুরবাড়ির প্রথা মেনে বিবাহের দু’একদিন আগে ভাবী জামাইকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করা হয়। মাধুরীলতার সঙ্গে যাঁর বিবাহ-প্রস্তুতি, তিনি রবীন্দ্রনাথের অপরিচিত নন, শরৎকুমার চক্রবর্তী কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর‌ পুত্র। এরপরও ঘোরতর অবিশ্বাস, ব্রাহ্মধর্মের দীক্ষিত করার দিনই পণের টাকা চাই! পাত্রপক্ষের‌ এই দাবিও রবীন্দ্রনাথ নিরুপায় হয়ে মেনে নিয়েছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পাত্রপক্ষের দাবির কথা শুনে প্রবল উত্তেজিত হয়েছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘বরকন্যাকে আশীর্বাদ স্বরূপই যৌতুক দিতে হয়—কিন্তু বিবাহের পূর্বেই যৌতুক চাহিবার কি কারণ? আমার প্রতি কি বিশ্বাস নাই?’

মাধুরীলতার সঙ্গে শরৎকুমারের বিবাহকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথমে যে গ্লানি তৈরি হয়েছিল, বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর তা বোধ হয় ছিল না। বন্ধু আচার্য জগদীশচন্দ্রকে লিখেছিলেন, ‘আমার জামাতাটি মনের মত হইয়াছে। সাধারণ বাঙালি ছেলের মত নয়। ঋজু স্বভাববিনয়ী অথচ দৃঢ়চরিত্র, পড়াশুনা ও বুদ্ধিচর্চায় অসামান্যতা আছে…।’

মাধুরীলতা

কবি মজঃফরপুরে শরৎকুমার-মাধুরীলতার সংসারেও ক’দিন গিয়ে ছিলেন। তাঁরাও এসেছেন জোড়াসাঁকোয়, শান্তিনিকেতনে। শ্বশুরের অর্থে শরৎকুমার ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়েছেন। ও-দেশ থেকে ফিরে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করার কথা ভেবে শরৎকুমার ও মাধুরীলতা জোড়াসাঁকোয় থেকেছেন। বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কথাতেই তাঁদের এই জোড়াসাঁকোয় বসবাস।

ছোটমেয়ে মীরার সঙ্গে তাঁর স্বামী নগেন্দ্রনাথের যতই মনোমালিন্য থাকুক না কেন, রবীন্দ্রনাথ নগেন্দ্রনাথের ওপরই নির্ভর করতেন। জোড়াসাঁকো অবস্থানকালে এই নির্ভরতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী শরৎকুমার। সহজভাবে তা মেনে নিতে পারেননি তিনি। ছোটজামাইয়ের প্রতি কবির বাড়তি আনুগত্যের ভিন্নতর অর্থ করেছেন। একসময় জোড়াসাঁকোর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে মাধুরীলতাকে নিয়ে শরৎকুমার উঠেছিলেন এন্টালির ভাড়া বাড়িতে।

রবীন্দ্রনাথ তখন বিদেশ সফরে। জোড়াসাঁকোর অশান্ত পরিবেশের, মান-অভিমানের বিবরণ তাঁর কাছে পৌঁছেছে। কবি বিচলিত বোধ করেছেন। জামাইকে চিঠি লিখেছেন, মেয়েকে চিঠি লিখেছেন। ‌মাধুরীলতাকে বলেছেন, ‘সকারণ হোক অকারণই হোক আমাদের সম্বন্ধে তোদের মনের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে ফেলে দে—তাতে আমাদের সকলের মঙ্গল হবে।’ জামাইয়ের কাছে সরাসরি ‘ক্ষমা’ চেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের কাতর আর্তিতে কাজ হয়নি, বরফ গলেনি। সম্পর্কের ফাটল জোড়েনি। কবির সঙ্গে শরৎকুমার অতীব কুৎসিত আচরণ করেছেন নানা সময়ে। জামাইয়ের আচরণ রবীন্দ্রনাথকে এতই কষ্ট দিয়েছিল, মর্মযন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছিল যে, তাঁর উপস্থিতিতে অসুস্থ মাধুরীলতাকে দেখতেও যেতেন না কবি। যেতেন দুপুরের দিকে, শরৎকুমারের অনুপস্থিতিতে। প্রায় রোজই অসুস্থ মাধুরীলতার শয্যার পাশে বসে থাকতেন কবি। চলত কবিরাজি- অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা। রোগের উপসর্গ মিলিয়ে নিজেও হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিতেন।

শরৎকুমার চক্রবর্তী

রবীন্দ্রনাথের কাছে বোদ্ধা মানুষ বারবার সম্ভ্রমে মাথা নত করেছে। সেই রবীন্দ্রনাথ নিজের জামাইয়ের কাছে চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। ঠাকুরবাড়ির বধূ হেমলতা দেবী সাক্ষী, টেবিলের ওপর দু’পা তুলে সিগারেট খেতেন শরৎকুমার। রবীন্দ্রনাথকে দেখেও পা নামাতেন না। সব ‘অপমান চেপে’ মুমূর্ষু কন্যাকে দেখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে, তা অভাবনীয়-অকল্পনীয়। যাঁকে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পড়িয়ে পেশায় বাড়তি সাফল্য লাভের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেই শরৎকুমারের কাছ থেকে এমন কদর্য ব্যবহারে কবি কতখানি মানসিকভাবে আহত হয়েছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ না রাখলেও শরৎকুমার ঠাকুরবাড়ির কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেসময় রাঁচি- পাহাড়ে থাকতেন। মাধুরীলতাকে নিয়ে শরৎকুমার মোটর ছুটিয়ে রাঁচি-পাহাড়ে গিয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দিনলিপিতে রয়েছে তার উল্লেখ।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরৎকুমারের সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হলেও তাঁদের দাম্পত্যজীবনে সে ছায়া পড়েনি। নিঃসন্তান দম্পতি নিজেদের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করেছেন। মাধুরীলতার সঙ্গে শরৎকুমারের বয়সের পার্থক্য ছিল ষোলো বছরের। পত্নীবিয়োগের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল আটচল্লিশ। বেঁচেছিলেন আরও চব্বিশ বছর। শেষের দিকে পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে শরৎকুমার মৃত্যু প্রতীক্ষায় ‌ মেজভাইয়ের আশ্রয়ে দিনযাপন করেছেন। ইচ্ছে করলে পুনর্বিবাহ করতে পারতেন। সতেরো বছরের দাম্পত্যজীবনের সুখস্মৃতি আঁকড়ে বাকি জীবন কাটিয়েছেন তিনি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর একটি মস্ত ছবি বাঁধিয়েছিলেন। সেই ছবির তলায় শুয়ে তাঁকে বই পড়তে দেখেছিলেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী। না, মাধুরীলতার মৃত্যুর পর আর কোনওদিনই জোড়াসাঁকোয় পা রাখেননি শরৎকুমার‌।‌‌ শ্বশুর-জামাতার ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান হয়নি।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content