বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী।

কলকাতার ‘হারকাটা গলি’র শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা কাদম্বরী বধূ হয়ে এসেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর। প্রায়শই তেমন উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে ঠাকুরবাড়িতে বধূমাতারা আসেননি।‌ এসেছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। পিরালি-কন্যা খুঁজতে গিয়ে বিত্তশালী-সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যাকে বধূ করে আনা সম্ভব হয়নি। কাদম্বরীর ঠাকুরদা জগন্মোহন ঠাকুরবাড়ির ‘দ্বারপাল’ ছিলেন। হঠাৎ করে মহর্ষিদেব শ্যামলাল-কন্যাকে বধূ করে আনেননি, পরিবারটির সঙ্গে ছিল সুদীর্ঘকালের যোগাযোগ, আত্মীয়তার বন্ধন। দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণি দেবীর সঙ্গে জগন্মোহনের বিবাহ হয়েছিল। কাদম্বরীর পিতা শ্যামলাল ছিলেন জগন্মোহনের চতুর্থ পুত্র। শ্যামলালও ছিলেন ঠাকুরবাড়ির অনুগ্রহধন্য। ঠাকুরবাড়ি থেকেই হতো তাঁর রুজিরোজগার। ছিল রকমারি দায়িত্ব। এটা-সেটা করে, সকলের ফাই-ফরমাশ খেটে কোনওরকমে তাঁর দিন গুজরান হত। বাগানে পাঁচিল দেওয়া হবে, গাছগাছালির মাঝ-বরাবর পদচারণের পথ তৈরি হবে, কে দেখভাল করবেন, কেন শ্যামলাল! মহর্ষিপত্নী সারদাসুন্দরী তখন অসুস্থ, মরণাপন্ন। দীর্ঘ অসুস্থতায় শয্যাশায়ী সারদাসুন্দরীর বেডসোর হয়ে গিয়েছিল। তাঁর জন্য বাতাস-বিছানা প্রয়োজন। কে নিয়ে আসবেন? দায়িত্ব অর্পিত হল শ্যামলালের উপর। অতীব দায়িত্ব পরায়ণ, বিচক্ষণ তিনি। মুশকিল আসানে তাঁর জুড়ি ছিল না। ঠাকুরবাড়ির এই অধঃস্তন কর্মীটি মাসোহারা পেতেন কুড়ি টাকা।

কাদম্বরীর দেওয়া 'সাধের আসন'

সামাজিক মর্যাদায়, আভিজাত্যে শ্যামলালের পরিবারের সঙ্গে ঠাকুরপরিবারকে মেলানো যায় না! সমাজজীবনে পিছিয়ে থাকা এক পরিবার থেকে বধূমাতার আগমনকে ঘিরে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরীর বিবাহকে ঘিরে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্র-অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন পত্নী জ্ঞানদানন্দিনীকে লেখা ‌এক চিঠিতে। লিখেছিলেন, ‘আমি যদি নতুন হইতাম, তবে কখনোই এ বিবাহে সম্মত হইতাম না। কোন হিসাবে যে এ কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না।’ আরেক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মনে হয় না যে ভালো মেয়ে হইবে — কোনো অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না।’

কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে বধূ হয়ে এসেছিলেন ন-বছর বয়সে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর থেকে বছর দশেকের বড়। রবীন্দ্রনাথ বছর‌ দু’য়েকের ছোট। বধূমাতার আগমনকালে কবি ছিলেন নিতান্তই বালক। তখন সবে সাত পেরিয়েছেন।

ঠাকুরবাড়িতে বধূমাতাদের লেখাপড়া শেখানোর প্রয়াস বরাবরই ছিল। ‘ক্যাশবহি’তে আছে কাদম্বরীর জন্য পুস্তক ক্রয়ের হিসেবনিকেশ।

রবীন্দ্রনাথ তখন পিতার সঙ্গে হিমালয়ভ্রমণ সেরে সবে জোড়াসাঁকোয় ফিরেছেন। সে সময়ের কথা লিখতে গিয়ে কবি জানিয়েছেন, ‘তখন আমাদের বাড়ির যিনি কনিষ্ঠ বধূ ছিলেন তাঁহার কাছ হইতে প্রচুর স্নেহ ও আদর পাইলাম।’
বৌঠানের‌ সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গতা দিনে দিনে বেড়েছে। কাগজে কলমে তখনও তিনি বেঙ্গল অ্যাকাডেমির ছাত্র। স্কুলে যেতে ভালো লাগত না তাঁর। প্রায় সময়ই বাড়িতে থাকতেন। বাড়িতে থাকা মানেই বৌঠানের সঙ্গে গল্পগাছা। সাহিত্য আলোচনা। তাঁর ফাই-ফরমাশ খাটা। কখনও বৌঠানের আমসত্ত্ব পাহারা দিয়েছেন, সুপুরি কেটে দিয়েছেন। কখনও-বা তাঁকে বই পড়ে শুনিয়েছেন।

কাদম্বরী ছিলেন প্রকৃতই স্নেহময়ী। সারদাসুন্দরী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের তো বটেই, সোমেন্দ্রনাথেরও দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তিনি। যেদিন সারদাসুন্দরীর মৃত্যু হয়, সেদিনের একটি ঘটনার কথা ‘জীবনস্মৃতি’তে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, তখন তিনি ঘুমোচ্ছিলেন। একজন পুরোনো দাসী ঘরে ঢুকে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল, ‘ওরে তোদের কি সর্বনাশ হল রে!’ তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন— পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাহার মনে ছিল।’

নিঃসন্তান কাদম্বরী দেবীর বেদনা-যন্ত্রণার শেষ ছিল না। মাতৃহৃদয়ের সেই হাহাকারের খবর আমরা রাখিনি। স্বর্ণকুমারীর মেয়েটিকে সন্তান-স্নেহে তিনি আগলে ধরেছিলেন। সবাই ভাবত, কাদম্বরীরই ‘মেয়ে যেন সে’। ছোট্ট মেয়েটি প্রায় চোখের সামনে ছটফটিয়ে মারা যায়। লোহার ঘোরানো ‌সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। মাথায় মারাত্মক আঘাত লেগেছিল। মৃত্যু হয়েছিল উর্মিলার।

বিহারীলাল চক্রবর্তী

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ব্যস্ততা, সংসারজীবন সম্পর্কে উদাসীনতা কাদম্বরীর মনে কম ক্ষোভ সৃষ্টি করেনি। সন্তানহীনতার যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণা ভোলার জন্য যাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, তাঁর মর্মস্পর্শী মৃত্যু—সে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! কাদম্বরীর দুঃখ-যন্ত্রণা উপলব্ধির চেষ্টা না করে আমরা রসালো গল্প ফেঁদেছি। বানিয়ে বানিয়ে কেতাব লেখা হয়েছে। সেইসব বানানো গল্পে আমরা আমোদিত-আপ্লুত ও রঞ্জিত হয়েছি।

সেই প্রেক্ষাপটে, উর্মিলার মৃত্যুর পর যন্ত্রণাদগ্ধ নিঃসন্তান কাদম্বরীর সামনে আত্মহনন ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প পথ খোলা ছিল না। কাদম্বরীর মধ্যে এমন সব গুণাবলি ছিল, যা সত্যিই অভাবনীয়! গুণবতী কাদম্বরী তাঁর গুণের স্বীকৃতি জ্যোতিবিন্দ্রনাথের কাছে কোনওকালেই পাননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রথম অনুভব করেছিলেন। কাদম্বরীর স্নেহময়তা তো ছিলই, সাহিত্যপ্রীতি‌, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ-আনুগত্য রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল‌।

বৌঠানের সঙ্গে‌ রবীন্দ্রনাথের তৈরি হয়েছিল মনের মিল, সুরে সুরে মিল, সব মিলিয়ে এক আনন্দময়‌ অমলিন সখ্য। যে সখ্য কখনও হারায়নি। মৃত্যুর পরও রবীন্দ্রনাথের মন জুড়ে ছিল তাঁর উপস্থিতি।

কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। উজ্জীবিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আরও ভালো লিখুক, দিগ্বিদিকে তাঁর খ্যাতি ছাড়িয়ে পড়ুক, এইটুকুই ছিল তাঁর প্রত্যাশা। বিহারীলাল চক্রবর্তী সে সময়ের খ্যাত কবি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সাহিত্যগুরু’ ভাবতেন। কবিতা লেখার পর সব সময়ই তিনি বৌঠানকে আগে পড়াতেন, পড়ে বা শুনে সব সময়ই তিনি এক কথা বলতেন, না, বিহারী চক্রবর্তীর মতো হয়নি। রবীন্দ্রনাথ এ-কথা শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়তেন, তা নয়। ভাবতেন, কবে তিনি বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারবেন!

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আঁকা কাদম্বরী

বিহারী চক্রবর্তীর‌ জোড়াসাঁকোয় যাতায়াত ছিল। আসতেন দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছে। সে সময় ঠাকুরবাড়ি থেকে ‘ভারতী’ প্রকাশের আয়োজন চলেছে। বিহারীলালও ‘ভারতী’-র সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি তো নিয়মিতই আসতেন। ‘ভারতী’ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজন হলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ- রবীন্দ্রনাথরাও তাঁর বাড়িতে যেতেন। জোড়াসাঁকোর তেতলার অর্ধেকটা জুড়ে ছিল কাদম্বরীর ঘরসংসার। বাকি অর্ধেকটা ছিল স্বর্ণকুমারীর। বধূ হয়ে এসে ছাদে-বাগান তৈরি করেছিলেন তিনি। কত গাছ লাগিয়েছিলেন। গন্ধরাজ, করবী, রজনীগন্ধা, চামেলি— সব গন্ধ মিলেমিশে অদ্ভুত মাদকতা তৈরি করত। শুধু ফুলের গাছ নয়, বাগানে ছিল ফলের গাছও। টবে টবে সারি সারি জামগাছ। সন্ধের‌ দিকে ছাদ- বাগানে শুরু হতো গান-বাজনা। এ বাগানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নন্দনকানন’। সে নাম যে সার্থক, চারপাশের পরিবেশে, শোভা-সৌন্দর্যে তা স্পষ্ট হয়ে উঠত। নন্দনকাননের সাহিত্য সভায়, গান-বাজনার আসরে প্রায়শই বিহারীলাল চক্রবর্তী আসতেন। আসতেন অক্ষয় চৌধুরি, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী। পরবর্তীকালে শরৎকুমারীর বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কাদম্বরী দেবী ভালো রাঁধতেন, মানুষজনকে খাইয়ে তাঁর বড় আনন্দ হতো। নন্দনকাননের সভায় আগত অতিথিদের তিনি নিজে রেঁধে খাওয়াতেন।

কাদম্বরী দেবী

কাদম্বরীর সাহিত্যপ্রীতির তো কোনও তুলনা হয় না। বিহারীলাল ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’ তখন ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে ‘আর্য দর্শন’ পত্রিকায়। প্রকাশ হওয়া মাত্র সে সংখ্যাটি পড়ে ফেলতেন কাদম্বরী। মনের আনন্দে পড়তে পড়তে মুখস্থও হয়ে যেত। তাঁর স্মরণশক্তির পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিহারীলালও। প্রিয় কবিকে কাদম্বরী নিমন্ত্রণ করে মাঝেমধ্যেই খাওয়াতেন। কবির কাব্য ঘিরে কাদম্বরীর মুগ্ধতার কথা জেনে, মাধুর্যময় কণ্ঠে তাঁর কবিতার আবৃত্তি শুনে বিহারীলালও বিস্মিত হতেন। নিমন্ত্রণ করে শুধু খাওয়াননি, নিজের হাতে একটি সুন্দর আসনও বুনে দিয়েছিলেন। সেই আসনে সুতো দিয়ে বুনে দিয়েছিলেন বিহারীলালের কাব্যের কয়েক ছত্র। আসনটি বুনতে চারমাস সময় লেগেছিল। আসনের মাঝখানে কাদম্বরী ‘সারদামঙ্গল’ থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন, ‘হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে/ ঢুলু ঢুলু দু- নয়নে/ বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও?’

উদ্ধৃতিটির শেষে ছিল জিজ্ঞাসাচিহ্ন। কাদম্বরী তাঁর প্রিয় কবির কাছে উত্তর জানতে চেয়েছিলেন, সে মুহূর্তে বিহারীলালের উত্তর দেওয়া হয়নি। ঘটে ভয়ংকর বিপর্যয়। কাদম্বরীর স্বেচ্ছামৃত্যু বিহারী চক্রবর্তীকেও ব্যথিত করেছিল। এই মৃত্যুর জন্য সরাসরি তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দায়ি করেছিলেন। বিহারী চক্রবর্তী ‘সাধের আসন’-এর উৎসর্গপত্রে ‘সারদামঙ্গল’-এর মুগ্ধ পাঠিকাকে স্মরণ করে যা লিখেছিলেন, তার অংশবিশেষ তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘উত্তর লিখিব বলিয়া, প্রতিশ্রুত হইয়া আসি এবং বাটীতে আসিয়া তিনটি শ্লোক লিখি। কিছুদিন গত হইলে উত্তর লিখিবার কথা একপ্রকার ভুলিয়া গিয়াছিলাম। এই আসনদাত্রী দেবী এখন জীবিত নাই। তাঁহার মৃত্যুর পর উত্তর সাঙ্গ হইয়াছে। এই ক্ষুদ্র খণ্ডকাব্যের উপহৃত আসনের নামে নাম রহিল— ‘সাধের আসন’। বিহারীলাল চক্রবর্তীর আনন্দস্মৃতি বুঝি বেদনায় লীন হয়ে গিয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘তোমার আসনখানি/ আদরে আদরে আনি,/ রেখেছি যতন কোরে, চিরদিন রাখিব;/ এ জীবনে আমি আর/ তোমারে সে সদাচার,/ সেই স্নেহ- মাখা মুখ পশারিতে নারিব।’

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content