মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ভাইবোন : ইন্দিরা ও সুরেন্দ্রনাথ

সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ছিল স্নেহ-ভালোবাসার অন্তরঙ্গতাময় সম্পর্ক। বয়েসে এগারো বছরের ছোট-বড়, পরস্পরের আচার-আচরণে তা বোঝার উপায় ছিল না! রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। মজা করে ‘সংস্কৃতে’ চিঠি লিখতেন। ভারি মজাদার সে চিঠি, ‘তব পেটস্য পীড়তাৎ…।’ কখনও লিখতেন হিন্দিতে। হিন্দিতে লেখা চিঠির কোনও তুলনা হয় না! ভাইপোকে লেখা খুড়োর সে চিঠি তো অনবদ্য! সরসতায় উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন‌, ‘কলকাত্তামে চলা গয়ো রে সুরেনবাবু মেরা,/ সুরেনবাবু, আসল বাবু, সকল বাবুকো সেরা।/ খুড়া সাবকো কায়কো নহি পাতিয়া ভেজো বাচ্ছা—/ মহিনা-ভর কুছ খবর মিলে না ইয়ে তো নহি আচ্ছা।’

রবীন্দ্রনাথ ‘বিসর্জন’ নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন ‌তাঁকে। তাঁর বহু লেখা অনুবাদ করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। সেই তালিকায় ‘ঘরে বাইরে’, ‘জীবনস্মৃতি’ বা ‘চোখের বালি’-র মতো বইও রয়েছে। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর কোনও বই তর্জমায় ব্রতী হলে, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত থাকতেন। ভাইপোটির ওপর অগাধ ভরসা ছিল। এই আস্থা-ভরসায় কখনও চিড় ধরেনি। শান্তিনিকেতন গড়ার কাজে অতি প্রিয় ভাইপোটি যুক্ত‌ থাকুক, চেয়েছিলেন তিনি। পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে সুরেন্দ্রনাথ যুক্ত ছিলেনও। ইংরেজিতে ‘বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি’ নামে যে পত্রিকাটি বের হতো, দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে সে পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালনও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লেখার ব্যাপারে তাঁকে সব সময় উৎসাহিত করেছেন। জোর করেও কখনও লিখিয়েছেন। অবশ্য সুরেন্দ্রনাথ সেভাবে লেখেননি। রবীন্দ্রনাথের জোরাজুরিতেই মহাভারতের আখ্যান, সাগর সেঁচে রত্ন তুলে আনার মতো করে লিখেছিলেন। শান্তিনিকেতনের আশ্রম-পড়ুয়াদের কথা ভেবেই তাঁর এ-বই লেখা। এছাড়াও জাপানি গল্পের অনুবাদ করেছিলেন। সে বইয়ের উৎসর্গ-পৃষ্ঠায় সুরেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যার মনোরঞ্জনার্থে বই লেখা হ’ল, তাকেই দিলাম!’ আড়ালে থাকা এই মানুষটি আর কেউ নন, তাঁর পত্নী সংজ্ঞা দেবী। এছাড়াও আছে কৌতূহল জাগানো আরও একটি বই, ‘বিশ্বমানবের লক্ষ্ণীলাভ : এ-কেলে কথকতা’। এ বইটি ছাপা হয়েছিল বিশ্বভারতী থেকে। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সুরেন্দ্রনাথের জীবন জুড়ে। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে আনুগত্য, অন্তরে স্বাদেশিকতাবোধের যে জাগরণ, তা ‘কাকামশায়’-ই উসকে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উদ্দীপিত করেছিলেন।

সংজ্ঞা দেবী

সুরেন্দ্রনাথের জীবনে রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, সংজ্ঞা দেবীর ভূমিকাও খুব কম নয়। সুরেন্দ্রনাথের চলার পথটি তিনি আনন্দময় করে তুলেছিলেন। ‘সাঁইত্রিশ বছর একসঙ্গে তাঁর সহধর্মিণী ও সহকর্মিণীরূপে’ দিনযাপন সংজ্ঞার কাছে ছিল পরম প্রাপ্তি। দু’জনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল অনেকখানি। বিবাহকালে সুরেন্দ্রনাথের একত্রিশ, সংজ্ঞার বারো। আপাতভাবে যতই অসম মনে হোক না কেন, এক মাধুর্যময় দাম্পত্য যাপন করেছিলেন তাঁরা।

সংজ্ঞা দেবীর স্মৃতিচর্চায় আছে কানায় কানায় ভরে ওঠা এক অনাবিল আনন্দময় জীবনের হদিশ। তিনি লিখেছেন, ‘নানান রূপে তাঁকে দেখেছি। তাঁর সুন্দর চেহারা, দেবতুল্য নির্মল চরিত্র আর ফুলের মতো নরম মনটি আমায় বার বার মুগ্ধ করেছে।’

সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত রূপবান। তাঁর মধ্যে ছিল শিশুর সারল্য। এই সারল্যই বোধ হয় ছিল রূপ-সৌন্দর্যের চাবিকাঠি। ‘বিবি’ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথের বোন। পিঠোপিঠি। বছর দেড়েকের বড় সুরেন্দ্রনাথ। অবশ্য বিবি তাঁকে ‘দাদা’ বলতেন না। ‘নাম ধরে ডাকবার বদ অভ্যাস শেষ পর্যন্ত রয়েই গিয়েছিল’, তা নিজের মুখে স্বীকারই করেছেন বিবি। বিবি নিজেও ছিলেন নানা গুণে গুণান্বিতা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সাধারণজনের কাছে ‘বিবি’ নামে নয়, ‘ইন্দিরা’ নামে তিনি পরিচিত। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী — এই নামটি আমরা সকলেই সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারণ করে থাকি। সুরেন্দ্রনাথের সৌন্দর্যের ভারি মজাদার বর্ণনা আছে এই ইন্দিরার লেখায়। অংশ বিশেষ তুলে দেওয়া যেতে পারে, —’ছেলেবেলায় সুরেনের রং খুবই সাফ ছিল শুনেছি। যদিও পুরুষমানুষে সেদিকে নজর দেয় না বলে বড়ো বয়সে সে রং প্রায় কাপড়ের তলায়ই গা-ঢাকা দিয়ে থাকত। বিলাতের একটি মেয়ে স্কুলে সম্ভবত তাকে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে সুন্দর ছেলে দেখে মেয়েরা তাকে চুমো খেয়েছিল বলে সুরেন নাকি অপ্রস্তুত হয়ে লাল হয়ে কেঁদে ফেলেছিল…।’

সারল্যে ভরপুর সুরেন্দ্রনাথকে চিনে নেওয়া যায় ছেলেবেলার একটি ঘটনা থেকে। ঘটনাটি জীবনভর লালন করেছিলেন তিনি। সুদূর প্রসারিত ছাপ ফেলেছিল মনে। প্রায়ই ঘটনাটির কথা বলতেন, পুনরাবৃত্তি করতেন সংজ্ঞা দেবীর কাছে। তখন তাঁর বছর পাঁচেক বয়েস। বাবা, মা আর বোনের সঙ্গে বিলেতে থেকে ফিরছিলেন স্বদেশে, কলকাতায়। ফেরার সময় জাহাজে এক হাতে আখরোট নিয়ে বসেছিলেন। আখরোট শক্ত-খোলা ভাঙা সহজ নয়। খোলা ভেঙে আরেক হাতে রাখছিলেন আখরোটের ভেতরের লোভনীয় অংশ। খোলা ছাড়িয়ে তা জলে ফেলে আয়েশ করে খাবেন, এমনই ভেবে রেখেছিলেন। অন্যমনস্কভাবে আখরোট খোলা জলে ফেলতে গিয়ে সব শাঁস জলে ফেলে দিয়েছিলেন। সে দুঃখ ভোলেননি কখনও। ঘটনাটি শিশুমনের খুব দাগ ফেলেছিল। সংজ্ঞার সঙ্গে নিভৃত আলোচনায় প্রায়শই সেসব মনে পড়ে যেত। আনন্দে, বিষাদে বলতেন।

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুরেন্দ্রনাথ বিলাস-বৈভবের মধ্যে বড় হয়েছিলেন। অথচ অহমিকা-প্রাচুর্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। সাধারণজনের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি। সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত মানুষটি কতখানি স্বহৃদয় ছিলেন, তা বোঝা যায় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। জমিদারি দেখতে গিয়ে লাখখানেক টাকার বিপুল খাজনা মকুব করে দিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। সে সময় জমিদারের সামনে প্রজাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমলারাও দাঁড়িয়ে থাকতো। এটাই ছিল রীতি। সুরেন্দ্রনাথ সহসা বহুকাল ধরে চলে আসা সেই ট্রাডিশন নিমেষে ভেঙে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, অন্তরের তাগিদেই ভেঙেছিলেন। আমলাদের জন্য আনা হয়েছিল বেঞ্চ। বেঞ্চে বসেছিল আমলারা। ম্যানেজারমশায় চেয়ারে। আর, প্রজাসাধারণই বা দাঁড়িয়ে থাকবে কেন, তা তো মেনে নেওয়া যায় না। তাই তাদের জন্য বড় বড় মাদুর আনা হয়। পাতা হল মাটিতে। বসে তারা। বসা নিয়ে তাদের প্রথমে দ্বিধা থাকলেও পরে আর অস্বাভাবিক মনে হয়নি। এটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

সংজ্ঞা দেবী সুরেন্দ্রনাথের জীবন ভরিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ, একসময় তিনি বিয়ে করার ব্যাপারে খুবই নিরাসক্ত ছিলেন। বিয়ে করা, না করা নিয়ে অভূতপূর্ব সব ঘটনা ঘটেছে। ছেলের বিয়ে দিতে মা জ্ঞানদানন্দিনী যে কাণ্ড করেছিলেন, তা বড়ই উপভোগ্য! ইন্দিরা জানিয়েছেন বিবাহ ঘিরে অন্দরমহলের গোপন-সংবাদ, ‘সুরেনের উপযুক্ত বয়স হতে মা তাঁকে বিয়ে করবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, যেমন মায়ের দস্তুর; আর তিনিও কিছুতে রাজি হচ্ছিলেন না, তেমন ছেলের দস্তুর।… মা সুন্দরের অতিমাত্র ভক্ত ছিলেন। তাই যেখানে যেখানে সুন্দরী মেয়ের খবর পেতেন, সেইখানে পুরনো চাকর পাঠিয়ে দিতেন, কিংবা আমরা নিজেরাই দেখতে যেতুম। একবার একটি সুন্দরী মেয়েকে মা দিনকতক বাড়ি এনে রাখলেন। কিন্তু সুরেন কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় অনেক জিনিসপত্র খেলনা পুতুল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাকে বিদায় দিলেন।’

সুরেন্দ্রনাথ ও সংজ্ঞা : কোলে পুত্র সুবীরেন্দ্র

মায়ের চোখের জল। সুরেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত আর নিমরাজি থাকেননি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রিয়শিষ্য ছিলেন প্রিয়নাথ শাস্ত্রী। তাঁর পুত্রের উপনয়নে ঠাকুরবাড়ির অনেকেই নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেদিনই জ্ঞানদানন্দিনী প্রথম দেখেছিলেন কিশোরী সংজ্ঞাকে। দেখে মনে হয়েছিল, ‘গয়না কাপড় পরে সেজেগুজে পাউডার মেখে মেয়েটিকে ভালোই’ লাগছিল। পরিবারে সকলেই জানতেন, জ্ঞানদানন্দিনী ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। ইন্দিরার দেওর তাঁকে প্রথম বলেছিলেন, ‘এই তো বেশ মেয়ে হাতের কাছে রয়েছে। একেই বউ করুন না।’

কিশোরী সংজ্ঞা শেষ পর্যন্ত বধূমাতা হয়ে এলেন ঠাকুরবাড়িতে। সংজ্ঞা দেবীকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব সুরেন্দ্রনাথ নিজেই নিয়েছিলেন। টলস্টয় বা জর্জ এলিয়টের মূল উপন্যাস হাতে নিয়ে গড়গড়িয়ে বাংলায় বলে যেতেন। শিলাইদহে জমিদারি কাজে গিয়ে সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজিতে একটি গল্পের বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। দীর্ঘ চিঠিতে আস্ত বইটিই অনুবাদ করে পাঠিয়েছিলেন সংজ্ঞাকে।

সংজ্ঞা দেবী স্মৃতিচারণে এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন, যা আমাদের বেদনাদীর্ণ করে। সুরেন্দ্রনাথ তখন রোগশয্যায়, মরণাপন্ন। যন্ত্রণাদায়ক মারণব্যাধিতেও তাঁর ভাবান্তর ঘটেনি। সব সময় বলতেন, ভালো আছেন। সংজ্ঞা দেবীকে বলেছিলেন, ‘আমি ভালো আছি, এরা কেমন আছে, দেখে নাও।’ এ কথা বলে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রবল শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তখন। সংজ্ঞা দেবী মৃদু হেসে হাত দিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথের বুকে। ক্রমাগত ওঠা-নামা, শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। সেই অবস্থাতেও তাঁর মুখে হাসির আভা ফুটেছিল। নিজের বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘এ বড় বোকা, পৃথিবীতে এত হাওয়া রয়েছে আর এ তা টানতেই পারছে না!’

কী মর্মস্পর্শী, মৃত্যু শিয়রে! সেই মৃত্যু-মুহূর্তে এমনতরো রসিকতা সুরেন্দ্রনাথই বুঝি করতে পারতেন!

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content