রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর লেখা রবীন্দ্রনাথের 'স্মরণ' কাব্যগ্রন্থের কবিতাংশ।

পত্নী মৃণালিনী দেবী যেভাবে জীবনভর রবীন্দ্রনাথের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার কোনও তুলনা হয় না। কবিকে ভালো রাখার জন্য, আনন্দে রাখার জন্য সারাক্ষণ সচেষ্ট থাকতেন তিনি। কবি কী খাবেন, তা নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত ছিল না। নতুন কোনও ব্যঞ্জন তৈরি করে কবির হাতে দেওয়ার পর তাঁর মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখলে মৃণালিনীর মন ভরে উঠত। লেখার হয়তো খুব চাপ, এমনও হয়েছে লেখার চাপে রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীকে ‘আমি লিখতে যাচ্ছি। খাবার জন্য আমাকে ডাকাডাকি করো‌ না’ বলে লেখার টেবিলে গিয়ে বসেছেন! মৃণালিনী জানতেন, লেখার বিঘ্ন ঘটলে কবি উত্তেজিত হবেন। তাই মাঝে মাঝে গিয়ে ফলের রস বা শরবত তাঁর টেবিলে রেখে আসতেন। এইভাবে ‘ভারতী’-র জন্য একের পর এক লিখতে গিয়ে বিপত্তি ডেকে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘চিরকুমার সভা’ নামের মজার নাটকটি তখন সবে শেষ‌ করেছেন। মানসিক পরিশ্রমের ও খাওয়া-দাওয়ার অনিয়মে তিনি এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, তেতলার ঘরে যেতে গিয়ে সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। এরপর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে মৃণালিনী দেবী রবীন্দ্রনাথের আর কোনও কথাই মেনে নেননি। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, ‘এই ঘটনার পর খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) আর স্বাধীনতা রইল না, মায়ের ব্যবস্থাই তাঁকে মেনে চলতে হত।’

রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী। কোলে সন্তান।

রবীন্দ্রনাথ ‘ভবতারিণী’কে তিলে তিলে মৃণালিনী করেছিলেন। মৃণালিনীর মনের কোণে গোপনে জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল, লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল। রবীন্দ্রনাথ তা জাগিয়ে তুলেছিলেন। বাড়িতে মেম- শিক্ষিকা আসতেন, মৃণালিনীকে ইংরেজি শেখাতে।

লোকসাহিত্যের প্রতি গভীর আনুগত্য‌ ছিল রবীন্দ্রনাথের। বাড়ির অনেককে সঙ্গে নিয়ে প্রচলিত ছড়া-সংগ্রহ করেছিলেন। ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা‌ রূপকথা সংগ্রহের ভার এককভাবে দিয়েছিলেন মৃণালিনী দেবীর উপর। এখান থেকে ওখান থেকে সংগ্রহ করা ছড়ানো রূপকথা ক্রমান্বয়ে তিনি একটি খাতায় লিখে রাখতেন।

অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, তাঁর ‘ক্ষীরের পুতুল’ গল্পের উৎস ওই খাতাটি। অবনীন্দ্রনাথের লেখাতেই আছে, ‘সেই খাতাটি থেকেই আমার ক্ষীরের পুতুল গল্পটি নেওয়া।’

মৃণালিনী দেবী শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্রদের নিজের সন্তানের থেকে কম ভালোবাসতেন না। ইচ্ছে করলেই রথীন্দ্রনাথকে পিতা-মাতার সান্নিধ্যে বাড়িতে রাখা যেত। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশ্রম-বিদ্যালয়ের বোর্ডিংয়ে রেখেছিলেন। মৃণালিনী দেবীর আশ্রমের সব ছাত্র ছিল সন্তানতুল্য। কেউ অসুস্থ হলে মাতৃস্নেহে তার সেবা-পরিচর্যা করতেন।

মৃণালিনী দেবী।

বহুজনের স্মৃতিচর্চাতেই আছে রবীন্দ্রনাথ স্বামী হিসেবে কতখানি দায়িত্ববান ছিলেন ! পিতা হিসেবে তো তিনি অসাধারণ! রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’র পাতায় পাতায় রয়েছে সে উজ্জ্বল বিবরণ। অসুস্থ মরণাপন্ন রেণুকাকে নিয়ে তিনি যেভাবে দূর-পাহাড়ে, আলমোরায় গিয়েছিলেন, তার কি তুলনা হয়? স্বামী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন, তার অনেকানেক স্মৃতিমিশ্রিত উজ্জ্বল বিবরণের মধ্য থেকে আমরা একটি বেছে নিতে পারি। সেটি আভিধানিক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। হরিচরণ লিখেছেন, ‘প্রায় দুই মাস মৃণালিনী দেবী শয্যাশায়িনী ছিলেন। রোগশয্যায় পার্শ্বে বসিয়া কবি এই দীর্ঘকাল পীড়িত পত্নীর যেরূপ সেবা-শুশ্রূষা করিয়াছিলেন, তাহা কদাচিৎ কোনও সৌভাগ্যবতী আয়ুষ্মতীর ভাগ্যে সম্ভব হয়। অর্থ বিনিময়ে সেবাকারিণীর অসদ্ভাব তখন না হইলেও, তাদৃশ ব্যবস্থা পাছে কোনও ক্রটিতে রোগিণীর রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়, এই সন্দেহেই জীবনান্ত পর্যন্ত কবি পত্নীর সেবা-শুশ্রূষা সহস্তে গ্রহণ করিয়াছিলেন। বৈদ্যুতিক পাখা তখন ছিল না, হাত-পাখার বাতাসে দিনের পর দিন কবি রোগিণীর রোগ জ্বালা প্রশমিত করিয়াছিলেন। পতি-পত্নীর প্রণয়-বন্ধনের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত, জীবনান্ত পর্যন্ত কবির এই অক্লান্ত সেবা।’

যেদিন মৃণালিনী দেবী প্রয়াত হয়েছিলেন, সেদিন কবি কতখানি মনোযন্ত্রণায় ছিলেন, তার বিপর্যস্ত-রূপ ধারা আছে ঠাকুরবাড়ি বধূমাতা হেমলতা দেবীর লেখায়। হেমলতা জানিয়েছেন, সেদিন রবীন্দ্রনাথ নির্জনে একা-একা ছাদে সারারাত পায়চারি করে কাটিয়েছিলেন। পত্নীবিয়োগ- যন্ত্রণা কবির মধ্যে কতখানি তীব্র হয়ে উঠেছিল, তা বছর চোদ্দোর রথীন্দ্রনাথও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সমবেদনা জানাতে জড়ো হওয়া মানুষজনের সঙ্গে ‘অসম্ভব ধৈর্যের’ পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছেন। রথীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ‘কী কষ্টে আত্মসংবরণ করে’ তাঁর পিতৃদেব এসব করে চলেছেন। সবাই চলে যাওয়ার পর পিতৃদেব তাঁকে ডেকে তাঁর মায়ের সর্বদা ব্যবহৃত চটিজুতো হাতে দিয়ে একটি কথাই বলেছিলেন, ‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।’

কতখানি যন্ত্রণা নিয়ে একথা পুত্রকে কবি বলেছিলেন, তা সহজে অনুমেয়! তাঁর শোকযন্ত্রণা কতখানি তীব্র ছিল, তা দৈনন্দিন নানা ঘটনায় পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। পত্নীর পাশে বসে যে রবীন্দ্রনাথ একদা মুখরোচক নানা খাবারের রেসিপি বলতেন, সেই ভোজনরসিক রবীন্দ্রনাথ শোকদীর্ণ দিনগুলিতে নিরামিষভোজী হয়ে গিয়েছিলেন। ঘরে মিষ্টি তৈরির প্রসঙ্গ বা প্রস্তাব উঠলেই তিনি বাধা দিতেন। হেমলতা দেবী তেমনই একটি ঘটনার উল্লেখ করে জানিয়েছেন, ‘কাকীমার হাতের মিষ্টির কথা মনে পড়ে’ যেত তাঁর।

বিবাহকালে : রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী।

পত্নীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি অত্যন্ত মাধুর্যময়। ভালোবাসার ও নির্ভরতার প্রকাশ রয়েছে পরতে পরতে। কবি ‘স্মরণ’ কাব্যটি লিখেছিলেন পত্নীর মৃত্যুর পরে। সমালোচকরা বলতেই পারেন, লোক-দেখানো, বানিয়ে বানিয়ে লেখা। সহধর্মিণীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের ছত্রিশটি চিঠির সন্ধান পাওয়া গেছে। কবিকে লেখা মৃণালিনী দেবীর চিঠির সংখ্যা তিন। বলে রাখা ভালো, অনেক চিঠিই ঠিকমতো সংরক্ষিত হয়নি। মৃণালিনীর বিবাহকালে (১৮৮৩) বয়স ছিল ১০, রবীন্দ্রনাথের ২২। বিবাহের সাত বছর পরেও তাঁদের দাম্পত্যপ্রেম যে ফিকে হয়ে যায়নি, রং-হারা প্রেমের গায়ে জং ধরেনি, তা কবির পত্রে ছড়ানো আছে। ২৯ আগস্ট ১৮৯০ ‘ভাই ছোট বৌ’ সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীর উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘রবিবার দিন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে জোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড়ো খাটে একাধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তোমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম– বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কি না। তার পরে বেলি খোকাকে হাম দিয়ে ফিরে চলে এলুম।’

চিঠিটি‌তে আন্তরিক দাম্পত্যের হৃদয়গ্রাহী ছবি রয়েছে। বানানো‌ বলে তো ভুলেও মনে হয় না! কবির চোখের সামনে মৃণালিনী বেড়ে উঠেছেন, শরীর-মন পূর্ণতা পেয়েছে। বিবাহের সাত বছর পর নিতান্তই বানিয়ে বানিয়ে ‘প্রেমহীন প্রীতিহীন’ কবি এ-চিঠি লিখেছিলেন, এমনটি মেনে নেওয়া যায় না। সম্পর্কে তখনও ধুলো জমেনি, ছিল যথেষ্টই আনন্দময়। বলা যায়, প্রেমেরই উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কবি নানা দোষে দুষ্ট। মৃণালিনী স্বামীর প্রেমবঞ্চিতা। রবীন্দ্রনাথ স্বামী হিসেবে মোটেই সুবিধা ছিলেন না। এমন প্রচার করে কেউ কেউ খুশি হতে পারেন, এ প্রচার যে অভিসন্ধিমূলক, তা বুঝতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগে না।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content