মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেজদা। চিন্তায় চেতনায় অনেকের থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। বাড়ির ছোটদের শুধু নয়, মেয়ে-বউদেরও লেখাপড়া শেখানো নিয়ে তাঁর ভাবনা-চিন্তার অন্ত ছিল না। সমাজজীবনে প্রচলিত যুক্তিহীন সংস্কারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। অত্যন্ত বিজ্ঞানমনস্ক, বিদ্যোৎসাহী। বিজ্ঞানের বই লিখেছিলেন, নিয়মিত বিজ্ঞানের প্রবন্ধ লিখতেন পত্র-পত্রিকায়। লেখা প্রবন্ধ ও বই সব যে জীবদ্দশায় ছাপা হয়েছিল, তা নয়। মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর বিজ্ঞান-বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। হেমেন্দ্রনাথ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তেন। পরীক্ষা অবশ্য দেওয়া হয়নি। পরীক্ষা না দিলেও চিকিৎসাবিদ্যা ভালোই রপ্ত করেছিলেন। মাতা সারদাসুন্দরীর হাতের পচন-ধরা ক্ষতস্থানের অপারেশনও করেছিলেন। সে আরেক প্রসঙ্গ।
ঠাকুরবাড়িতে বিদেশি ভাষার চর্চা ছিল। দুই ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভালো ফরাসি জানতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ফরাসি থেকে সরাসরি গল্প-উপন্যাসও অনুবাদ করেছিলেন। হেমেন্দ্রনাথকে ফরাসি শিখিয়েছিলেন বাড়ির পাচকঠাকুর। যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। এক্ষেত্রে অবশ্য চুল বাঁধার মতো তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কাজ নয়, রীতিমতো ভাষাশিক্ষা, তাও আবার ফরাসির মতো অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত ভাষা-শেখানোর দায়িত্ব-পালন। ঠাকুরবাড়ির পরতে পরতে বিস্ময়, এও এক ভিন্নতর বিস্ময়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৯: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫০: লক্ষ্মণ—ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যায় কাথ্রাঁ নামে এক ফরাসি চাকরির জন্য এসেছিল হেমেন্দ্রনাথের কাছে। আলাপচারিতায় তার গুণাবলির কথা জানতে পারেন হেমেন্দ্রনাথ। রন্ধন-পটুত্বের সংবাদ জানার পর রসনা-পরিতৃপ্তির কথা ভেবে মনে মনে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। বিলম্ব না করে তখনই চাকরিতে বহাল করেছিলেন কাথ্রাঁকে। তখনই কাথ্রাঁর সঙ্গে পাকাকথা হয়ে যায় হেমেন্দ্রনাথের। তাঁকে ফরাসি ভাষা শেখাতে হবে, সেই সঙ্গে রেঁধে খাওয়াতে হবে। যে টাকা মাইনে হিসেবে দেওয়া হবে, তা খুব কম নয়। মাসে তিরিশ টাকা। বলা বাহুল্য, সে সময়ের বিচারে টাকার অঙ্কটা খুব কম নয়।

কাথ্রাঁও হেমেন্দ্রনাথ শর্ত মেনে রাজি হয়ে যায়। ফরাসি রান্নার খ্যাতি পৃথিবী জুড়ে। ইউরোপের সমৃদ্ধিশালী ধনীরা ফরাসি-পাচক রাখে। শেষে ঠাকুরবাড়িতেও ফরাসি-পাচকের ব্যবস্থা হয়। অচিরেই কাথ্রাঁ কাজে যোগদান করে, ফরাসি পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চলে হরেক ব্যঞ্জন-প্রস্তুত।

হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ফরাসিরা ভোজনরসিক। তারিয়ে তারিয়ে ভোজন করে। আস্ত জানোয়ার রান্না করে তারা অবশ্য ডিনারের টেবিলে কখনো তোলে না। মাংস ছোট ছোট করে কেটে আমাদের মতো করে রান্না করে। তাদের রান্না সব সময়ই হয় খুব মুখরোচক ও সুস্বাদু। ঠাকুরবাড়ির ফরাসি পাচক কাথ্রাঁর রান্নাও ছিল মুখরোচক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর অভিজ্ঞতার নিরিখে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সামান্য নিরামিষ ব্যঞ্জনও কাথ্রাঁর হাতের মহিমায় উপাদেয় হয়ে উঠত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সে শাকসবজি নিরামিষ ডিশও অতি সুন্দর রাঁধিতে পারিত। আমাদের যেমন শাকের ঘন্ট, শুক্তো প্রভৃতি আছে, সেও সস্ ও মশলা দিয়া এক একদিন সেই ধরনের এক একটা জিনিস প্রস্তুত করিত।’ কাথ্রাঁ ছিল একেবারে ঘরের লোকের মতো। কাথ্রাঁকে ভুলেও বলতে হত না, কবে কী রাঁধতে হবে। ‘রসনা-পরিতোষকারী রন্ধনে’ সে ‘অদ্ভুত বুদ্ধি ও শক্তিমত্তার’ পরিচয় দিত।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১১: স্বর্ণকুমারী দেবী— ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

কাথ্রাঁকে যে প্রচুর পরিমাণে রান্না করতে হত, তা নয়। অনেকটা অতিথি-পাচকের মতো ছিল ঠাকুরবাড়িতে তার অবস্থান। হেমেন্দ্রনাথের বা তাঁর পরিবারের কারও বিলেতিখানা খাওয়ার ইচ্ছে হলে ডাক পড়ত কাথ্রাঁর। বাড়িতে হয়তো বন্ধু-বান্ধব এসেছে, তাদের ডিনারে আপ্যায়িত করতে হবে, তখনও ডাক পড়ত কাথ্রাঁর। রসনা-পরিতৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে চলত আনন্দ-মজলিশ। রাতটি হয়ে উঠত পরম উপভোগ্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘আমাদের বিলাতিখানা খাইবার ইচ্ছা হইলে সেই রাঁধিত। সে অল্প খরচে নানাবিধ সুখাদ্য ডিশ প্রস্তুত করিতে পারিত।’ ঠাকুরবাড়িতে বহু বিশিষ্টজন কাথ্রাঁর তৈরি করা ফরাসি-ব্যঞ্জন খেয়েছেন, প্রশংসা করেছেন। এই তালিকায় লেখক বঙ্কিমচন্দ্র যেমন আছেন, তেমনই রয়েছেন হাইকোর্টের নামজাদা জজ দ্বারিকানাথ মিত্র।

হেমেন্দ্রনাথের বই।

কাথ্রাঁ সারাক্ষণ ফরাসিতেই কথা বলত, গল্প করত। অন্য কোনো ভাষা আয়ত্তে ছিল না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তেমন বাছবিচার ছিল না। ফরাসি-খানাই খাবে, অন্য কিছু নয়, এসব কখনো ভুলেও বলেনি। বরং বাঙালি-খানাতেই যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। দৈনন্দিন রান্না যে করত, সেই বামুনঠাকুরের রান্নাই কাথ্রাঁ খেত। বঙ্গবাসীর মতো ভাতের প্রতিই ছিল যত আগ্ৰহ-অনুরাগ। পরিমাণেও খেত বেশি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তো মনেই হয়েছে, ‘তাহার ভাতের পরিমাণটা আমাদের অপেক্ষা অনেক বেশি ছিল।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৩: সারদা মায়ের দার্শনিক দৃষ্টি

কাথ্রাঁর সব কাজেই ছিল গভীর আন্তরিকতা, নিষ্ঠা। মনিবকে ফরাসি ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পালনে কখনো কার্পণ্য করেনি। কাথ্রাঁ কাজে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, ফরাসি ভাষায় হেমেন্দ্রনাথের ‘বেশ ব্যুৎপত্তি’ জন্মেছে।

হেমেন্দ্রনাথ একবার ঠিক করলেন শান্তিনিকেতনে যাবেন। একা-একা নয়, সপরিবারে। হেমেন্দ্র-কন্যা প্রতিভা তখন দু-বছরের শিশু। শিশুসন্তান নিয়ে ট্রেনপথে শান্তিনিকেতন-যাত্রা খুব সহজ নয়। যাত্রাপথে প্রতিভাকে সামলে ছিল আর কেউ নয়, কাথ্রাঁ। ছোটদের সঙ্গে তার সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যেত, ভালোবাসত তাদের। প্রতিভার সঙ্গেও ছিল খুব ভাবসাব। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে কোথা থেকে কতগুলো স্ফটিক-পাথর সংগ্রহ করেছিল। ফলার মতো ছুঁচলো কাঠিতে সেই টুকরো-পাথর লাগিয়ে বড়ো আনন্দ পেয়েছিল সে। শুধু আনন্দ নয় সেগুলি বেচে দুটো বাড়তি পয়সাও পেয়েছিল।

'সব-চেয়ে বলবান কে?' ফরাসি-গল্পের অনুবাদ: জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কলমে। 'প্রবাসী'র পাতায়।

শিশুর মতো সারল্যে ভরপুর, তাই তুচ্ছ কাজেও ছিল কাথ্রাঁর অপার আনন্দ। প্রতিভার জন্য কাথ্রাঁ দোলনা তৈরি করেছিল। দোলনাটি টাঙিয়েছিল এক গাছে। ছোট্ট প্রতিভাকে দোলনায় বসিয়ে সে দোল দিত। কাথ্রাঁর চোখে মুখে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ফুটে উঠত। সোল্লাসে চিৎকার করত।

কাথ্রাঁ ছিল ক্লান্তিহীন। কত রকমের কাজ করত। এই ফরাসি শেখাচ্ছে তো, খানিক পরেই মনিবের শিশুসন্তানকে দোলনায় দোল দিচ্ছে। এই হয়ত রান্না করছে, খানিক পরেই মনিবকে জিমন্যাস্টিক শেখাচ্ছে। সারাক্ষণই কর্মচঞ্চল। আলস্য কখনো তাকে স্পর্শ করেনি। তিরিশ টাকা সে সময়ের বিচারে খুব কম টাকা না হলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, তার মাস মাইনে আরও বেশি হওয়া উচিত। কাজের তুলনায় যথেষ্টই কম। কী না করতে হয় তাকে, ‘চণ্ডীপাঠ’ থেকে ‘জুতোসেলাই’ পর্যন্ত প্রায় সবই করত, হাসি-মুখে। ঠাকুর পরিবারে অনেকের সঙ্গেই তার সুসম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। নিতান্তই তাকে রাঁধার লোক, পাচকঠাকুর কেউ ভাবেনি। ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়েছিল বলেই ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েও কাথ্রাঁ চিঠি লিখত। সেই দেশে যাওয়াই ছিল শেষ যাওয়া। আর ফেরা হয়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, আকস্মিক কাথ্রাঁর জীবনদীপ নিভে গিয়েছিল। সে সময় ফরাসিদের সঙ্গে জার্মানিদের যুদ্ধ লেগেছিল। তারপর থেকেই আর কাথ্রাঁর কোনও খবরাখবর পাওয়া যায়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে জানিয়েছেন, ‘বোধ হয় বেচারা সেই যুদ্ধেই নিহত হইয়াছে।’

ছবি: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content