রবীন্দ্রনাথ লেখার টেবিলে।
মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের গভীর ভালোবাসা ছিল। সে ভালোবাসায় কখনো চিড় ধরেনি, বিশ্বাস টলে যায়নি। অনেক পথ পেরিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পরও তা একই রকম ছিল। অবিচল ছিল বিশ্বাস। তিনি জানতেন, মানুষের বিশ্বাস হারানো পাপ। তাঁর সেই বিশ্বাস আমাদের মনেও দৃঢ় হয়েছে।
শুধু কি মানুষ, সমগ্র জীবজগতেরই প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল সুগভীর ভালোবাসা ছিল। শিলাইদহে বাসকালে গুলতি দিয়ে পাখি মেরে কবিপুত্র প্রচণ্ড তিরস্কৃত হয়েছিলেন। ক্ষুণ্ণ, উত্তেজিত রবীন্দ্রনাথ জমিদারি এলাকায় রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন। কেউ কোনও অবস্থাতেই পাখি মারতে পারবে না। আদেশ রক্ষা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে ছিল কড়া নজরদারি। ইংরেজ রাজকর্মচারীরাও আদেশ মেনে চলতে বাধ্য হত।
শুধু কি মানুষ, সমগ্র জীবজগতেরই প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল সুগভীর ভালোবাসা ছিল। শিলাইদহে বাসকালে গুলতি দিয়ে পাখি মেরে কবিপুত্র প্রচণ্ড তিরস্কৃত হয়েছিলেন। ক্ষুণ্ণ, উত্তেজিত রবীন্দ্রনাথ জমিদারি এলাকায় রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন। কেউ কোনও অবস্থাতেই পাখি মারতে পারবে না। আদেশ রক্ষা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে ছিল কড়া নজরদারি। ইংরেজ রাজকর্মচারীরাও আদেশ মেনে চলতে বাধ্য হত।
জীবকুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসার অনেক অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তাঁর সাহিত্যকর্মে তো বটেই, দৈনন্দিন জীবনযাপনে এই ভালোবাসায় কখনো ঘাটতি পড়েনি। শান্তিনিকেতন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কতখানি দুর্বলতা ছিল, তা আমাদের অজানা নয়। তিলে তিলে গড়ে তোলা এই আশ্রম-বিদ্যালয়কে ঘিরে কত স্বপ্ন লালন করেছিলেন তিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে শান্তিনিকেতনেই বেশি থাকতেন। ওখানে থাকলে কবি ভালো থাকতেন। মানসিক প্রশান্তি একটু বেশিই দেখা যেত। বেলা-শেষে শান্তিনিকেতনের মাটিতেই তিনি মিশে যেতে চেয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনে বসবাসকালে রোজই কবি তাড়াতাড়ি উঠে পড়তেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁর ঘুম ভেঙে যেত। লিখতে বসতেন। বনমালী উনুন ধরিয়ে চা করে নিয়ে আসত। রবীন্দ্রনাথ নিজে চা খেতেন, অন্যদের চা খাওয়াতেন। দু-চারজন সাতসকালেই হাজির হত। তাঁরা গুরুদেবের সঙ্গ-প্রত্যাশী, গুরুদেবের প্রিয়জন। মানুষজন ছাড়াও কবির কাছে এই সকালে আসত একটি ময়ূর ও একটি কুকুর।
শান্তিনিকেতনে বসবাসকালে রোজই কবি তাড়াতাড়ি উঠে পড়তেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁর ঘুম ভেঙে যেত। লিখতে বসতেন। বনমালী উনুন ধরিয়ে চা করে নিয়ে আসত। রবীন্দ্রনাথ নিজে চা খেতেন, অন্যদের চা খাওয়াতেন। দু-চারজন সাতসকালেই হাজির হত। তাঁরা গুরুদেবের সঙ্গ-প্রত্যাশী, গুরুদেবের প্রিয়জন। মানুষজন ছাড়াও কবির কাছে এই সকালে আসত একটি ময়ূর ও একটি কুকুর।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?
রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, কবির আদরের ‘মামনি’র একটি ময়ূর ছিল। ময়ূরটি তিনি শখ করে কিনেছিলেন। বাগানে ঘুরে বেড়াত পেখম মেলে, দূর থেকে দেখেও চোখ জুড়োত। বাগানের ভেতরে কেউ ঢোকার সাহস দেখাত না। যদি ময়ূর তেড়েফুঁড়ে আসে, আঁচড়ে দেয়, ক্ষতবিক্ষত করে, তবে কী হবে! এসব ভেবে ছোটোরা তাই বাগানে ঢুকত না। ময়ূর যদি চোখ উপড়ে নেয়, এসব ভাবনা মনের কোণে ডালপালা ছড়াত। ময়ূরের উপস্থিতিতে বাগানের ফুল-পাখিরা অবশ্য আনন্দে খুশিতে, নিশ্চিন্তে ছিল।
রবীন্দ্রনাথ চায়ের টেবিলে।
প্রতিদিন ভোরে যখন চাতালে বসে রবীন্দ্রনাথ চা খেতেন, তখন ময়ূরটি চলে আসত। কোনও ব্যতিক্রম ঘটত না। এসেই কবির সামনে পেখম মেলে দাঁড়িয়ে পড়ত। রঙের ছটা ছড়িয়ে পড়ত। রবীন্দ্রনাথ একই রকম ভাবে প্রতিদিন কবিতার খাতাটি হাতে নিয়ে ময়ূর দেখতেন। রবীন্দ্রনাথ লেখায় মগ্ন থাকলে, দেখার ফুরসত না পেলে ক্যাঁ ক্যাঁ করতেই থাকত। কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইত।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
শুধু ময়ূর নয়, আসত কুকুরও। কুকুরটির নাম ছিল ‘লালু’। সৌখিন বিলিতি কুকুর নয়, খাঁটি দেশি কুকুর। এদিকে, সেদিকে ঘোরে। কোথায় কখন থাকে, কে জানে! যেখানেই থাকুক না কেন, প্রতিদিন সকালে ঠিক এসে হাজির হত। এসেই রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে থাকত। হোক না পথের কুকুর, গাম্ভীর্যের ছাপ ছিল চালচলনে। কখনই পথ-কুকুরের মতো নয়। বেশ ভারী, ষণ্ডাগুণ্ডা চেহারা। রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে এসে সামনের দু-পায়ে ভর দিয়ে এমন করে বসত যে, রানী চন্দের মনে হত, ‘ঠিক যেন পাথরে-খোদাই মন্দিরের সামনের সিংহমূর্তিটি।’
রবীন্দ্রনাথ লালুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। লালু চুপচাপ বসে থাকত। লেজ নাড়ত। কবি পাউরুটিতে মাখন মাখিয়ে দিতেন তাকে। খুব শান্ত হয়ে ধীর-স্থিরভাবে মাখন মাখানো রুটি খেত। রানী চন্দ খাবার সময় লালুর মধ্যে কখনো একটুও ‘চপলতা’র প্রকাশ দেখেননি। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘এর কি ডিগনিটি দেখেছিস? দেখা যায় না বড়ো।’
রবীন্দ্রনাথ লালুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। লালু চুপচাপ বসে থাকত। লেজ নাড়ত। কবি পাউরুটিতে মাখন মাখিয়ে দিতেন তাকে। খুব শান্ত হয়ে ধীর-স্থিরভাবে মাখন মাখানো রুটি খেত। রানী চন্দ খাবার সময় লালুর মধ্যে কখনো একটুও ‘চপলতা’র প্রকাশ দেখেননি। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘এর কি ডিগনিটি দেখেছিস? দেখা যায় না বড়ো।’
পুপে।
লালুর ওপর গৃহভৃত্য, রবীন্দ্রনাথের সর্বক্ষণের সঙ্গী বনমালীর ছিল খুব রাগ ছিল। রোজ এতটা করে মাখন খাবে, সে তা সহ্য করতে পারত না। রবীন্দ্রনাথের হাতে না দিয়ে কখনোসখনো সাততাড়াতাড়ি লালুর প্রাপ্য রুটি মাটিতে রেখে দিত। লালু এসে শুঁকে শুঁকে দেখত, সহজেই বুঝতে পারত মাখন মাখানো হয়নি। গঁ-গঁ করে রাগ দেখাত। শেষে রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে এসে বসত। রবীন্দ্রনাথের হয়ত তখন লেখায় ব্যস্ত। তারই মধ্যে সব বুঝতে পারতেন। ডাকতেন বনমালীকে। ডাকা মাত্র কাঁচুমাচু মুখে বনমালী এসে দাঁড়াত কবির সামনে। কিছুই দেখেননি, কিছুই বোঝেননি—এমন ভাব দেখিয়ে বলতেন, ‘লালু আজ খায়নি, দেখেছ?’
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩২: সরকারবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে শ্রীমার বুড়ি-বুড়ি খেলা
বনমালীই তো লালুর না খাওয়ার জন্য দায়ি। তার ওপর অভিমান করেই কুকুরটা খায়নি। সে সব রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে না দিয়ে বনমালী বলত, ‘এজ্ঞে, কি করব আমি! রুটি তো হোথায় ওই দিয়ে রেখেছি, দেখুন না কেন?’
রবীন্দ্রনাথ শেষে বুঝিয়ে দিতেন তিনি সবই দেখেছেন, বুঝেছেন। বলতেন, ‘সে তো জানি। আর এও জানি, তুমি শুকনো রুটি দিয়েছো খেতে, জানো তো লালু মাখন ছাড়া রুটি খায় না।’
তখনই বনমালীকে হুকুম করতেন, নিয়ে এসো মাখনের বাটি। বনমালী মুখে কথাটি না বলে তখনই দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসত। রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে রুটিতে মাখন মাখিয়ে দিতেন।
রবীন্দ্রনাথ শেষে বুঝিয়ে দিতেন তিনি সবই দেখেছেন, বুঝেছেন। বলতেন, ‘সে তো জানি। আর এও জানি, তুমি শুকনো রুটি দিয়েছো খেতে, জানো তো লালু মাখন ছাড়া রুটি খায় না।’
তখনই বনমালীকে হুকুম করতেন, নিয়ে এসো মাখনের বাটি। বনমালী মুখে কথাটি না বলে তখনই দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসত। রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে রুটিতে মাখন মাখিয়ে দিতেন।
রথীন্দ্রনাথ।
কোনও কোনও দিন এমনও ঘটেছে, লালু এসেছে, অথচ রবীন্দ্রনাথ লেখায় ব্যস্ত। লালুর আগমনবার্তা কবির কানে পৌঁছয়নি। তাকিয়ে দেখারই অবসর পাননি। নিমগ্ন হয়ে লিখে চলেছেন। এমন হলে বনমালী প্রতিশোধ নিত, ইশারায় লালুকে দূরে ডেকে শুকনো রুটিই দিত। লালু সব বুঝতে। কবি ব্যস্ত রয়েছেন লেখায়।তাই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করাই ভালো। লেখার কাজে বিঘ্ন ঘটিয়ে উপস্থিতি জানাতেও চায় না সে। তাই বেগতিক দেখে মাখন ছাড়া শুকনো রুটিই খেয়েছে।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৭: পাপাঙ্গুলের যাত্রা
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি
রবীন্দ্রনাথ লালুকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। সে কবিতায় দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কবি লিখেছে, ‘প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর/ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে আসনের কাছে/ যতক্ষণে সঙ্গ তার না করে স্বীকার/ করস্পর্শ কর দিয়ে।’
শুধু ময়ূর ও কুকুর নয়। রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিদিনই কাক আসত, শালিকা আসত। আসত পায়রা-ঘুঘু। এসেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে ধরত। তাদের জন্য ধান-চাল-মুড়ি বরাদ্দ থাকত। রবীন্দ্রনাথের আশপাশে যারা থাকত তাঁরা পক্ষীকুলের খাবার ছড়িয়ে দিত। কখনো কবি দিতেন নিজের হাতে।
শুধু ময়ূর ও কুকুর নয়। রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিদিনই কাক আসত, শালিকা আসত। আসত পায়রা-ঘুঘু। এসেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে ধরত। তাদের জন্য ধান-চাল-মুড়ি বরাদ্দ থাকত। রবীন্দ্রনাথের আশপাশে যারা থাকত তাঁরা পক্ষীকুলের খাবার ছড়িয়ে দিত। কখনো কবি দিতেন নিজের হাতে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রানী চন্দের লেখা বই।
রবীন্দ্রনাথের শেষ-বয়সের সঙ্গী ছিল ‘পুপেদিদি’। রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর পালিতকন্যা নন্দিনী ছিলেন কবির আদরের পুপে। পুপে তাঁর দাদামশায়কে জানিয়েছিল, পাখি পুষতে চান। দাদামশায় বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ পুষবে বৈকি।’ না খাঁচার মধ্যে নয়, খাঁচায় রাখলে পাখিদের কষ্ট হয়। তাই তাকে ছেড়ে রাখতে হবে। দাদামশায়ের কথা মতো পুপে তাঁর পোষা ময়নাটিকে বাগানে ছেড়েই রাখতেন। এ ডালে সে ডালে ঘুরে বেড়াত, কখনো এসে বসত পুপের হাতে। পোষা বেজিও ছিল। বেজিগুলো বাগানে ঘুরে বেড়াত। রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে এসে খেলা করত। ভালোবাসার পশুপাখিরাও রবীন্দ্রনাথকে চিনে ফেলেছিল।
ছবি: লেখক।
ছবি: লেখক।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।