শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আমাদের পথ দেখিয়েছে। সাহিত্যচর্চায়, বিজ্ঞানচর্চায়, সংস্কৃতিচর্চার নানা অঙ্গনে তাঁরাই নিয়েছেন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলার জন্য জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছেন। স্বাদেশিকতাবোধ জাগানোর ক্ষেত্রেও এই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রথমে দৈনন্দিন জীবনে, পরিবারিক স্তরে স্বাদেশিকতাবোধ জাগানোর চেষ্টা চলেছে। পরে তা ছড়িয়ে পড়েছে বৃহত্তর সমাজজীবনে। জোড়াসাঁকোয় তাঁত বসানোর ব্যবস্থা হয়েছে, চরকা কাটার ব্যবস্থা হয়েছে। খোলা হয়েছে ‘স্বদেশী ভাণ্ডার’। বন্ধ হয়েছে বিলিতি জিনিসের ব্যবহার। যাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কীভাবে সাহায্য করা যায়, আন্দোলন কীভাবে ত্বরান্বিত হয়, সেসব নিয়েও ঠাকুর-পরিবারের কারও কারও ভাবনার অন্ত ছিল না। শুধু এভাবে পরোক্ষে অংশগ্রহণ নয়, পথেও নেমেছিলেন তাঁরা। এ ব্যাপারেও পথপ্রদর্শক আর কেউ নন, অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। সবার হাতেই তিনি পরিয়ে দিয়েছিলেন রাখি। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার দাবি।
ক্যালেন্ডার মেনে রাখিপূর্ণিমার দিনে নয়, আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই একটি দিনে, ১৬ অক্টোবর, হয়েছিল রাখিবন্ধন। বাড়ির সবাইকে ডেকে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। সবাই মিলে গান গাইতে গাইতে জগন্নাথঘাটের দিকে যাবেন। গঙ্গায় স্নান সেরে সবার হাতে পরিয়ে দেবেন রাখি।

যেমন ভেবেছিলেন, ঠিক তেমনই হয়েছিল। শুধু একটু ছোট্ট পরিবর্তন ঘটেছিল। সাতসকালেই পরিবারের অনেকে, পাড়া-প্রতিবেশী, আশপাশের মানুষজন জড়ো হয়েছিল। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তৈরি। গান গাইতে হবে তাঁকে। হঠাৎই রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেন, না, চটি-জুতো পরে নয়, পদযাত্রা হবে খালি পায়ে। সেদিন অবনীন্দ্রনাথ তো বটেই, তাঁর কন্যা উমা দেবীও পায়ে পায়ে শামিল হয়েছিলে পথযাত্রায়। তাঁর লেখায় আছে, ‘পরদিন সকালবেলা বাড়ী থেকে দলবল নিয়ে বেরুলেন রবিদাদা। চিৎপুর রোডে এসে তাঁর মনে হ’লো খালি পায়ে চলতে হবে। সকলকে জুতো খুলে ফেলতে বললেন। জুতো খুলে রাখা হ’লো অনুশীলন সমিতির বাড়ীতে। জুতো রেখে জগন্নাথ ঘাটে সকলে স্নান ক’রে সকলের হাতে রাখী বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে চললেন রবিদাদা।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৬: রবীন্দ্রনাথ চা নয়, প্রতিদিন সকালে কফি খেতেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৭: হিন্দু-মুসলিম মিশ্র দেবতা সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর

অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পরম স্নেহভাজন। এই ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে কবি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। ‘রবিকাকা’ বলেছেন, যেতেই হবে, কিন্তু খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে যাওয়া, এ তো অবনীন্দ্রনাথের কাছে সহজ কাজ ছিল না। পড়লেন মহাফ্যাসাদে। ঘরকুনো মানুষ, সেভাবে কোথাও যাতায়াত নেই। খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে যাওয়া তো সহজ ব্যাপার নয়। পুরোনো স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে ঘোরতর সেই বিপত্তির কথা অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন রানি চন্দকে। রানি চন্দ শুনে শুনে অবনীন্দ্রনাথের যে বই লিখেছিলেন, সেই ‘ঘরোয়া’তে আছে, ‘রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়ি-ঘোড়া নয়। কী বিপদ, আমার আবার হাঁটাহাঁটি ভালো লাগে না। কিন্তু রবিকাকার পাল্লায় পড়েছি, তিনি তো কিছু শুনবেন না। কী আর করি হেঁটে যেতেই যখন হবে, চাকরকে বললুম, নে সব কাপড়-জামা, নিয়ে চল্ সঙ্গে। তারাও নিজের নিজের গামছা নিয়ে চলল স্নানে, মনিব চাকর একসঙ্গে সব স্নান হবে।’

রবীন্দ্রনাথ,১৯০৫। ছবিটি সুকুমার রায়ের তোলা

বাড়ির কাজের লোকও চলেছে পায়ে পায়ে। তার কণ্ঠেও গান। একসঙ্গে নদীতে স্নান। এমন একটি ছবির কথা মনে মনে ভাবতেও ভালো লাগে। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, তাঁর কন্যা উমা দেবীর লেখাতেও আছে, সবাই মিলে গঙ্গাস্নানের উদ্দেশে যে যাত্রা, সে যাত্রা সফল হয়েছিল। লোকে লোকারণ্য। পদযাত্রায় মানুষ ক্রমশ বাড়ছিল। পথচলতি মানুষ অন্য কাজ ফেলে যোগ দিচ্ছিল পদযাত্রায়। ফুটপাত লোকে থৈথৈ। ফুটপাত উপচে লোক তখন রাজপথে। রবীন্দ্রনাথ এ বাড়ির সামনে, ও বাড়ির সামনে গিয়ে নেমে আসার জন্য ডাক দিচ্ছিলেন। কবিকে দেখে গৃহকর্তারা শরবত দিচ্ছিলেন, মিষ্টিমুখ করাচ্ছিলেন। আনন্দের জোয়ার বইছিল যেন। সবার চোখে মুখে দিন বদলের স্বপ্ন। উমা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, বিলেতি মনোভাবাপন্ন এক ব্যক্তির বাড়ির কাছে এসে পদযাত্রার গতি একটু শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লোকটিকে ডাক দিয়েছিলেন। পদযাত্রায় শামিল হওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। না, তিনি আসসেননি। উমা দেবী লিখেছেন, ‘রবিদাদা, সেইখানে দাঁড়িয়েই গান বাঁধলেন।’ কী গান—চিরায়ত প্রেরণাদায়ী সেই সংগীত। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে / তবে একলা চলো রে।’
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-২: ইতিহাসে অসম

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-২: একলা চলো রে…

কেউ যদি আন্তরিক-ডাক উপেক্ষা করে, তাতে কীবা আসে যায়। ততোধিক আন্তরিকতায় মানুষের মিছিল চলেছিল রাজপথে। বাড়ির বারান্দা থেকে মেয়েরা খই ছড়াচ্ছিল, শাঁখ বাজাচ্ছিল। দিনেন্দ্রনাথ ছিলেন মিছিলের পুরোভাগে। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি হাঁটছিলেন তিনি। কণ্ঠে সংগীত, গান নয়, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত মন্ত্রমালা, ‘বাঙলার মাটি, বাঙলার জল, বাঙলার বায়ু, বাঙলার ফল / পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।’

অবনীন্দ্রনাথ।

জগন্নাথ ঘাটে যখন পদযাত্রা পৌঁছোল, তখন চারদিকে শুধু মানুষ। থই থই করছে ভিড়। কেন এত ভিড়, এত সমাগম—আড়ালে এক অন্য কারণ আছে। কারণটা আর কিছুই নয় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি। সাধারণজনের কাছে তা ছিল এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা।

এভাবে রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাইছিল না। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চারিদিকে ভিড় জমে গেল। স্নান সারা হল—সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল একগাদা রাখী, এ ওর হাতে রাখী পরালুম। অন্যরা যারা কাছাকাছি ছিল, তাদেরও হাতে রাখি পরানো হল। হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখী পরানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার।’
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৪: শ্যামপুকুরে ঠাকুর

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা

ফেরার সময় পাথুরেঘাটায় বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতগুলো সহিস ঘোড়াদের সাফসুতরো করছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে গিয়ে সহিসদের রাখি পরিয়ে এসেছিলেন। তা দেখে অবনীন্দ্রনাথ প্রথমে একটু ভয়ই পেয়েছিলেন। কী জানি কী হয়! সহিসরা অন্য সম্প্রদায়ের। রাখি পরানোর অপরাধে আবার মারপিট না বাঁধিয়ে দেয়। না, তেমন কিছু ঘটেনি, রবীন্দ্রনাথ রাখি পরিয়ে তাদের সঙ্গে কোলাকুলিও করেছিলেন। খানিক পরে চিৎপুরের বড় মসজিদ। সেখানে গিয়েও প্রবল উৎসাহে রবীন্দ্রনাথ রাখি পরাতে চান। ডাক দিলেন সবাইকে। বললেন, ‘এসো, এসো মসজিদে’। অবনীন্দ্রনাথ একটু ভয়ই পেয়েছিলেন। মনে হয়েছিল, ‘এইবারে বেগতিক—আমি ভাবলুম, গেলুম রে বাবা, মসজিদের ভিতরে গিয়ে রাখী পরালে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার না হয়ে যায়।’

অবনীন্দ্র-কন্যা উমা দেবী।

মিথ্যে এই আশঙ্কা, অমূলক আতঙ্ক। না, তেমন কিছুই হয়নি। ঘণ্টাখানেক বাদে সবাই ফিরে এল। অবনীন্দ্রনাথ দৌড়ে গিয়ে সুরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তেমন কিছু ঘটেছে কিনা। সুরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের আরেক ভ্রাতুষ্পত্র, তাঁর থেকে জানা গিয়েছিল, মারামারি নয়, হাসাহাসি হয়েছে। সবারই হাসিমুখ, সবাই খুশি। রবীন্দ্রনাথের বেঁধে দেওয়া রাখি হাতে পরে সবাই তখন পায়ে পায়ে ফিরে চলেছে জোড়াসাঁকোর দিকে। তখনও গাইছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ গুনগুনিয়ে গেয়ে চলেছিলেন, ‘বাঙলার মাটি বাঙলার জল…।’

ছবি: লেখক।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content