![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Rabindranath-Tagore_1.jpg)
অনেকেই ভাবেন, লেখক-শিল্পীরা এলোমেলো-বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দু-চারজন হয়তো তেমন, কিন্তু কখনোই তা সামগ্রিক ছবি নয়। উচ্চতায় পৌঁছতে গেলে, সুশৃঙ্খল হতে হয়, দৈনন্দিন জীবনে নিয়মানুবর্তিতার বড় প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারে যথেষ্টই সচেতন ছিলেন। সুধীরচন্দ্র কর শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগার বিভাগে প্রথমজীবনে কাজ করতেন, পরে প্রকাশন বিভাগে। শেষের দিকে পত্রপত্রিকার বরাদ্দ মতো লেখা রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে লিখিয়ে নিতেন। পত্রপত্রিকার দপ্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।
সেই সুধীরচন্দ্রের লেখায় আছে, রবীন্দ্রনাথ কতখানি নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকতেন। ঘড়ি মিলিয়ে কাজ করতেন। বৃদ্ধ-বয়সেও খুব সকালে লিখতে বসতেন। দশটা পর্যন্ত একটানা থাকতেন লেখার টেবিলে। লেখালেখিতে নিমগ্ন। সকালে সকলে যেমন চা খায়, তেমন চা নয়, খেতেন কফি। অনেকেরই ধারণা ছিল, কবি সবার মতোই চা খেতেন। সুধীরচন্দ্রও তেমনই জানতেন। একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে ভুল ভেঙেছিল। তাঁর ‘কবিকথা’ বইতে আছে সে বর্ণনা। রবীন্দ্রনাথ তখন রোগশয্যায়। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হবে, এমনই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন পত্রিকা-কর্তৃপক্ষ। সে সংখ্যায় লেখার জন্য সুধীরচন্দ্রও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি জাপানের সঙ্গে চা-পানের মিল দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন। সদ্য রচিত কবিতাটি কবিকে শোনাতে গিয়ে ভুল ভাঙে। জানা যায়, চা নয়, কবি কফি পান করেন প্রতিদিন সকালে।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Samay-Updates_Rabindranath-Tagore-6.jpg)
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৫: রাণুর মধ্যে মাধুরী
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Say-Udates_Sundarban-1.jpg)
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৬: সুন্দরবনের গবাদি-পশুরক্ষক মানিক পীর
রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন, সে বর্ণনা আছে সুধীরচন্দ্রের বইতে। তাঁকে কবি মজা করে বলতেন ‘বাঙাল’। বই থেকে সেই অংশটুকু তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘কবিতাটি দেখে কবি হৃষ্টচিত্তে স্বীকৃতি জানালেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তীদের হেসে বললেন, বাঙাল করেছে কী দেখো। মূলেই গোল বাঁধিয়ে বসে আছে। কবিতায় মিলের খাতিরে শেষে আমার ভুল ইতিহাস রটনা! হদিশ না পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের দৃষ্টিতে চাইলাম। বললেন, সকালে চা খাই তোমাকে কে বললে? বললাম, অত বড় পেয়ালা-ভরা রোজ সকালে তবে কী দেখি আপনার চায়ের টেবিলে? বললেন, সে তো কফি।’
সুধীরচন্দ্র তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘সেই থেকে আমার দীর্ঘকালের ধারণার সংশোধন হয়।’ ‘চা পান’ আর ‘জাপান’— এই দুই মিল বাদ দিয়ে, খানিক অদলবদল করে কবিতাটি ছাপা হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকায়।
সুধীরচন্দ্র তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘সেই থেকে আমার দীর্ঘকালের ধারণার সংশোধন হয়।’ ‘চা পান’ আর ‘জাপান’— এই দুই মিল বাদ দিয়ে, খানিক অদলবদল করে কবিতাটি ছাপা হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকায়।
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Rabindranath-Tagore_3.jpg)
রবীন্দ্রনাথ দশটা অবধি একটানা লিখে যেতেন। ন’টা নাগাদ আসত ফলের শরবত। আয়েশ করে শরবত খেয়ে আবার লেখায় মন দিতেন। লেখার পর স্নান। বারোটার মধ্যে তাঁর দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে যেত। বিকেলে লোকজন আসত, দেখাসাক্ষাৎ, আলাপচারিতার জন্য নির্ধারিত ছিল। ঘড়ি মিলিয়ে চারটের সময় শুরু হত এই সাক্ষাৎকারপর্ব। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কবি আরামকেদারায় বসে খবরের কাগজ পড়তেন। শান্তিনিকেতনে খবরের কাগজ আসত বারোটা নাগাদ। কাগজ পড়ার পর বই নিয়ে নাড়াচাড়া। অধিকাংশ পাওয়া বই। একটু নাড়াচাড়া করলে, পড়ার মতো কিছু থাকলে, তা নজরে পড়ত, পড়েও ফেলতেন। মনোযোগ দিয়ে পড়তেন ‘লিটারেরি ডাইজেস্ট’ বা ‘দি নেচার’-এর মতো কিছু বিলিতি ম্যাগাজিন। দুপুরে দু’টো নাগাদ একটু চা খেতেন। সাতটায় নৈশভোজ। জীবনের শেষের দিকে এরকম ছিল কবির প্রতিদিনের রুটিন। সুধীরচন্দ্র কর এসব স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁর বইতে লিখে রেখেছেন।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Samay-Updates_Assam.jpg)
অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-১: প্রকৃতি অসমকে সাজাতে কোনও কার্পণ্যই করেনি
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Health.jpg)
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?
রবীন্দ্রনাথ দুপুরের খাবার খেতেন রসিয়ে, জমিয়ে। শ্বেতপাথরের দশ-বারোটি ছোট ছোট বাটি। বাটিতে রকমারি ব্যঞ্জন। থালায় থাকত ভাত ও ভাজাভুজি। দু-এক চামচ করে এ বাটি সে বাটি থেকে তুলে তুলে নিতেন। আশ্রমিকরা কেউ কেউ এটা-সেটা রেঁধে পাঠাতেন। সেগুলো আগে খেতেন। খেতে বসে রবীন্দ্রনাথ একদিন দেখলেন সব কিছু দু’প্রস্থ আয়োজন। ব্যাপার কী, জানা গেল আশ্রমের এক কর্মীর বাড়ি থেকে এক প্রস্থ খাবার এসেছে। খুবই সাধারণ গেরস্থ ঘরের সামান্য খাবার। কবির নজর এড়িয়ে যায়নি, এসব খাবার যিনি তৈরি করেছেন, সেই প্রৌঢ়া দাঁড়িয়ে ছিলেন অদূরে। তাঁর রাঁধা খাবারের কবি প্রশংসা করেছিলেন। প্রৌঢ়ার আনন্দ আর ধরেনি। চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Rabindranath-Tagore_2.jpg)
নিরামিষ খাবারের দিকে রবীন্দ্রনাথের আগ্ৰহ ছিল বেশি। আমিষ খেতেন, কিন্তু আমিষে তেমন আগ্রহ ছিল না। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর নিরামিষই খেতেন তিনি। শাশুড়িঠাকুরণ মাছ রেঁধে জোর করে খাইয়েছিলেন। না করতে পারেননি কবি। মধ্যাহ্নভোজনের সময় কবির পুত্রবধূ প্রতিমা উপস্থিত থাকতেন। ‘আদরে আবদারে’ সে সময় ‘ছোটছেলের মতো’ মনে হত কবিকে।
রবীন্দ্রনাথ পদ্মাপাড়ের রান্নার খুব প্রশংসা করতেন। রান্নার ‘বৈচিত্র্য ও রসমাধুর্য’ তাঁকে কতখানি মুগ্ধ করেছিল, তা প্রায়শই শোনাতেন। তখন তিনি অসুস্থ, রোগশয্যায়। উদয়নের একতলায় থাকতেন। সঙ্গ দিতে আসতেন প্রিয়জনরা। রান্নার ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা কত, তিনি কতখানি সুদক্ষ, হাস্যচ্ছলে সেসবও শোনাতেন।
রবীন্দ্রনাথ পদ্মাপাড়ের রান্নার খুব প্রশংসা করতেন। রান্নার ‘বৈচিত্র্য ও রসমাধুর্য’ তাঁকে কতখানি মুগ্ধ করেছিল, তা প্রায়শই শোনাতেন। তখন তিনি অসুস্থ, রোগশয্যায়। উদয়নের একতলায় থাকতেন। সঙ্গ দিতে আসতেন প্রিয়জনরা। রান্নার ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা কত, তিনি কতখানি সুদক্ষ, হাস্যচ্ছলে সেসবও শোনাতেন।
আরও পড়ুন:
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Cartoon-1.jpg)
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/01/Ramakrishna-1.jpg)
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা
কবি কী পোশাক পরতেন, সে বিবরণও আছে সুধীরচন্দ্র করের লেখায়। জানা যায় কবি ঢিলে পাঞ্জাবি পরতেন। লুঙ্গি ও পাজামা ছিল সাধারণ পরিধেয়। কখনোসখনো দুটো পাঞ্জাবি একত্রে পরতেন। ভেতরের পাঞ্জাবি ঘাম শুষে নেবে, এমন ভেবেই জোড়া পাঞ্জাবি। খদ্দরে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, নিয়মিত ব্যবহার করতেন। মন্দিরে উপাসনাকালে বা সভা সমিতিতে পরতেন সাদা ধুতি ও জামা-চাদর। ‘দরবারি পোশাক’ ছিল আলখাল্লা। আলখাল্লা ছিল নানা রঙের। ঋতুর সঙ্গে রং মিলিয়ে পরতেন। বর্ষায় কালো, বসন্তে বাসন্তী। আলখাল্লার সঙ্গে থাকত রেশমি উত্তরীয়। একবার দোলের আসরে বাসন্তীর বদলে কালো আলখাল্লা পরে চলে গিয়েছিলেন কবি। বে-খেয়ালে এই রং-বিভ্রাট। অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে দেখেছিলেন সবাই তাঁকে দেখে হাসাহাসি করছে। সেই মুহূর্তে জবাব না দিয়ে জবাব দিয়েছিলেন কবিতায়। কবিতাটির নাম ‘জবাবদিহি’। ছাপা হয়েছিল ‘প্রবাসী’তে। পরে ‘নবজাতক’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।
![](https://samayupdates.in/wp-content/uploads/2023/12/Rabindranath-Tagore_4.jpg)
ঠাকুরবাড়িতে ভোজন, রয়েছেন রবীন্দ্রনাথও। পরিবেশনে কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা।
ঘটনাটি ১৯৪০-এর, মানে, প্রয়াণের আগের বছর। কবিতাটির অংশবিশেষ তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘কবি হয়ে দোল-উৎসবে/ কোন্ লাজে কালো সাজে আসি,/ এ নিয়ে রসিকা তোরা সবে/ করেছিলি খুব হাসাহাসি।/ চৈত্রের দোল-প্রাঙ্গণে, আমার জবাবদিহি চাই/ এ দাবি তোদের ছিল মনে,/ কাজ ফেলে আসিয়াছি তাই।/ দোলের দিনে, সে কী মনের ভুলে,/ পরেছিলাম যখন কালো কাপড়,/ দখিন হাওয়া দুয়ারখানা খুলে/ হঠাৎ পিঠে দিল হাসির চাপড়।/ সকাল বেলা বেড়াই খুঁজি খুঁজি /কোথা সে মোর গেল রঙের ডালা,/ কালো এসে আজ লাগল বুঝি/ শেষ প্রহরের রঙহরণের পালা।’
কবির মনে তখন বিষাদ গাঢ় হচ্ছে। হোক না শেষ প্রহর, শেষ প্রহরেও কবি যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। তাঁর দৈনন্দিন জীবনে নিয়মানুবর্তিতা ছিল। শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত এই শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়নি।
কবির মনে তখন বিষাদ গাঢ় হচ্ছে। হোক না শেষ প্রহর, শেষ প্রহরেও কবি যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। তাঁর দৈনন্দিন জীবনে নিয়মানুবর্তিতা ছিল। শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত এই শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়নি।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।