মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


মাধুরীলতা যখন ছোট।

সন্তান-সন্ততিদের জন্য রবীন্দ্রনাথের আকুলতা-ব্যাকুলতা, গভীর ভালোবাসা বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের ‘মিনি’ যে মাধুরীলতা, তা আমাদের অজানা নয়। রবীন্দ্রনাথই জানিয়েছেন এ তথ্য। ওই গল্পের কাবুলিওয়ালার যে পিতৃসত্তা, সে সত্তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পিতৃসত্তার কি প্রভেদ আছে! বাবারা বোধহয় এ রকমই হন। বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রের অঙ্গনে যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন, সুখী গৃহকোণে শেষ পর্যন্ত তাঁরা দায়িত্বপরায়ণ স্নেহময় পিতা।

রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর প্রথম সন্তান মাধুরীলতা। মাধুরীলতার যখন জন্ম হয়, কবির বয়স তখন পঁচিশ পেরিয়েছে। কবি-পত্নীর তেরোও হয়নি। মাধুরীলতাকে রবীন্দ্রনাথ ‘বেলা’ বলে ডাকতে অভ্যস্ত ছিলেন। বেলাকে কবি নিজের হাতে স্নান করিয়েছেন, খাইয়েছেন। অন্নপ্রাশনে গান বেঁধেছেন, ‘ওহে নবীন অতিথি, তুমি নূতন কি তুমি চিরন্তন।’
ধীরে ধীরে মাধুরীলতা বড় হয়েছেন। বয়েসে না হলেও সেকালের বিচারে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছেন। বয়েস তাঁর চোদ্দোও হয়নি। বন্ধু-কন্যাদের বিবাহ রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়ে তুলেছিল। ঠিক তখনই কবি-বন্ধু প্রিয়নাথ সেন মাধুরীলতার জন্য সম্বন্ধ এনেছিলেন। পাত্র শরৎকুমার ছিলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পুত্র। বিহারীলাল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের আসন ছিল। ফলে বিবাহের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়নি, বরং বিবাহ-আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

কী কষ্ট করেই না পণের টাকা জোগাড় করে রবীন্দ্রনাথ পাত্রস্থ করেছিলেন কন্যা মাধুরীলতাকে। পণের টাকা, যৌতুকসামগ্রী ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যাকে এক আলমারি বই দিয়েছিলেন। অনেক রকম বই, ইংরেজি-বাংলা-সংস্কৃত। বিবাহ-উপলক্ষে কন্যাকে আস্ত একটি যৌতুক-লাইব্রেরি দেওয়ার কথা রবীন্দ্রনাথের ছাড়া কে আর ভাবতে পারতেন!

পুত্র পুত্রবধূ ও দুই কন্যা মাধুরী ও মীরা।

বিয়ের পর মাধুরীলতাকে স্বামীগৃহে পৌঁছে দিতে কবি নিজে মজঃফরপুর গিয়েছিলেন। ফিরে এসে শান্তিনিকেতনে বসে চিঠি লিখেছেন মৃণালিনীকে। মৃণালিনী দেবী তখন কলকাতায়, জোড়াসাঁকোয়। চিঠিতে কবি ফিরে গিয়েছিলেন দূর-অতীতে। ছবির পর ছবি, চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল নানা চিত্রাবলি। সে চিঠিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল স্নেহময় কবি কতখানি দায়িত্বশীল ছিলেন। কবি লিখেছেন, ‘কাল সমস্তক্ষণ বেলার শৈশবস্মৃতি আমার মনে পড়ছিল। তাকে কত যত্নে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছিলুম।… আমি ওকে নিজে পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে স্নান করিয়ে দিতুম… দার্জিলিংয়ে রাত্রে উঠিয়ে উঠিয়ে দুধ গরম করে খাওয়াতুম… সে সময় ওর প্রতি সেই প্রথম স্নেহের সঞ্চার হয়েছিল, সেসব কথা বারবার মনে উদয় হয়।’

সত্যিই নানা রঙের আনন্দময় দিনগুলি। ছোট্ট বেলাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে দার্জিলিং গিয়েছেন। গাজিপুর গিয়েছেন। ধীরে ধীরে বেলা বড় হয়েছে। মেধাবী মাধুরীকে কবি বাড়তি যত্নে পড়াতেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শিলাইদহে যখন পড়াশোনা আরম্ভ হল, দিদি আমাদের ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে যেতে লাগলেন। বাবা তাঁকে নিজে পৃথক করে পড়াতে শুরু করলেন।’ কন্যা তাঁর গান শিখুক, সংগীত-পারদর্শী হয়ে ওঠুক, চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গান শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ভালো সেবিকা হয়ে উঠুক মাধুরীলতা, এমনই চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৪: চাঁদ ঢাকার কৌশল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

কখনও মাধুরীলতা নিজেই উৎসাহিত হয়ে নার্সিংয়ের বই পড়েছেন, আবার কখনও রবীন্দ্রনাথ নিজে পড়ে, বুঝে, তবেই বুঝিয়েছেন মাধুরীলতাকে। কন্যাকে সুশিক্ষিতা করে তোলার ব্যাপারে কবির আগ্ৰহের শেষ ছিল না। বাড়িতেই তাঁর পড়াশোনার নানা আয়োজন করা হয়েছিল। কবি নিজে দেখতেন, আবার উপযুক্ত শিক্ষকও নিযুক্ত করেছিলেন। সংস্কৃত শেখানোর জন্য শিবধন বিদ্যার্ণবের মতো পণ্ডিতজন। মাধুরীলতাকে ইংরেজি শেখানোর জন্য রীতিমতো মেমসাহেব নিযুক্ত করেছিলেন কবি। শিলাইদহ-বাসের সময় রবীন্দ্রনাথ নিজেই কন্যার পড়াশোনা অনেকখানি দেখতেন। রথীন্দ্রনাথের লেখায় আছে সে বিবরণ। মাধুরীলতাকে গান শেখানোরও ব্যবস্থা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে তিনি এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন তাঁর ইচ্ছের কথা। ঘরের কেউ একজন গান-বাজনা করবে, এমনই ইচ্ছে ছিল তাঁর। ইন্দিরাকে তিনি লিখেছিলেন, ‘বেলি যদি দেশী এবং ইংরেজি সংগীতে বেশ ওস্তাদ হয়ে ওঠে তা হলে আমার অনেকটা সাধ মিটেবে।’

মাধুরীলতা।

বিহারীলাল চক্রবর্তীর পুত্র বলে শরৎকুমার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যে দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল, কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার পর সে ধারণায় চিড় ধরে। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ভেবেছিলেন বড় ভালো জামাই হয়েছে তাঁর। উচ্ছ্বসিত হয়ে বন্ধু আচার্য জগদীশচন্দ্রকে লিখেছিলেন, ‘আমার জামাতাটি মনের মত হইয়াছে। সাধারণ বাঙালি ছেলের মত নয়। ঋজু স্বভাব, বিনয়ী অথচ দৃঢ়চরিত্র, পড়াশোনা ও বুদ্ধিচর্চায় অসামান্যতা আছে… আরেকটি মহৎ গুণ এই দেখিলাম, বেলাকে তাহার ভালো লাগিয়াছে।’ এ ভাবনা যে নিতান্তই আবেগতাড়িত ভাবনা, বাস্তব-সত্যতা নেই, অচিরেই তা বুঝতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ।

মাধুরীলতা অবশ্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার। জোড়াসাঁকোর সঙ্গে মজঃফরপুরের জীবনযাপন এক ছিল না। সাদামাঠা নিরাভরণ জীবনযাপনের সঙ্গে মাধুরীলতা নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। কখনও দামি শাড়ি বা গয়না পরতেন না। শরৎকুমার যে মাধুরীলতাকে অবহেলা করতেন, দাম্পত্যের শৈথিল্য এসেছিল, তা নয়। মাধুরীলতার পিতৃদেবকে নিয়েই সমস্যা, তাঁকে যে অপছন্দ করেন, তা শরৎকুমার দৈনন্দিন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর ব্যবহার ভদ্রজনোচিত ছিল না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

জামাতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সুখকর ধারণা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শরৎকুমারকে কবি ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। শিক্ষান্তে দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। জোড়াসাঁকোয় তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকো-বাস সুখের হয়নি। ভুল বোঝাবুঝি, শেষে জোড়াসাঁকো-ত্যাগ। ভাড়া-বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলেন মাধুরীলতাকে নিয়ে শরৎকুমার। শেষে সম্পর্ক এমন কুৎসিত হয়ে ওঠে যে অসুস্থ মাধুরীলতাকে দেখতে এসেও কবিকে চরম অপমানিত হতে হয়েছে। শরৎকুমার অভাবনীয় ব্যবহার করতেন কবির সঙ্গে।

মাধুবীলতা ও শরৎকুমার।

শরৎকুমার যখন বাড়ি থাকতেন না, তখন, প্রায়শই দুপুরের দিকে মাধুরীলতাকে দেখতে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। চিকিৎসায় সাড়া দেননি মাধুরীলতা, দিনে দিনে যক্ষার প্রাবল্য বেড়েছে। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন তিনি। যেদিন তিনি চলে যান, সেদিনও রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে যাচ্ছিলেন, সঙ্গে একজন বিশ্বস্ত ডাক্তারবাবুও ছিলেন। তাঁর চিকিৎসায়, পরিচর্যায় মাধুরীলতার মুখে হাসি ফুটবে, রবীন্দ্রনাথের স্থির বিশ্বাস ছিল। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। কবি পথেই পেয়েছিলেন ভয়ংকর সেই দুঃসংবাদ। মাধুরীলতা নেই, তাঁর আদরের বেলা নেই।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২২: ঠাকুর ও মা সারদার সংসার

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!

অসহনীয় শোকযন্ত্রণা। দিশেহারা বিধ্বস্ত কবি গাড়ি ঘুরিয়ে গিয়েছিলেন রাণুদের বাড়ি। চিঠিতে যার সঙ্গে যোগাযোগ, তাকে চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলেন। রাণুর স্মৃতিকথায় আছে, ‘কবিকে দেখা সেই প্রথম। কবির একান্ত স্নেহের দুলালী বেলার মৃত্যুর দিন। …অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিষ্পন্ন করে এক ভিখারীর মত তিনি আমাদের গৃহের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ডাকছিলেন রাণু, রাণু কোথায় গেলে…।’

মাধুরীলতার থেকে কুড়ি বছরের ছোট রাণুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন আদরের কন্যাকে। পরে এক চিঠিতে সে কথা রাণুকে লিখেও ছিলেন, ‘সে যে মুহূর্তে বিদায় নিয়ে চলে গেল, সেই মুহূর্তেই তুমি আমার কাছে এলে… আমার মনে হল যেন এক স্নেহের আলো নেবার সময় আরেক স্নেহের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। আমার কেবল নয়, সেদিন যে তোমাকে আমার ঘরে আমার কোলের কাছে দেখেচে তারই ওই কথা মনে হয়েচে।’

রবীন্দ্রনাথ ও রাণু।

সন্তান-সন্ততিদের পরম স্নেহে আগলে রাখতেন রবীন্দ্রনাথ। হাজারও ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁদের ঘিরে আকুলতায়, ভালোবাসায় কখনো ঘাটতি পড়েনি। হঠাৎ হঠাৎ করে তাঁদের কারও কারও এইভাবে চলে যাওয়ায় শোকযন্ত্রণায় ভেঙে পড়েছেন কবি। শোক গোপন করতেও জানতেন তিনি। সৃষ্টির মধ্যে ডুব দিয়ে শোককে আড়াল করতে চেয়েছিলেন। পেরেছিলেন কি?
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content