সারদাসুন্দরী দেবী।
অধিক সন্তানের জননী, স্বভাবতই আঁতুড়ঘরে কেটেছে সেকালের অধিকাংশ মায়েদের। রবীন্দ্রনাথ সেভাবে মাকে পাননি। সারদাসুন্দরীর চতুর্দশ সন্তান, অষ্টম পুত্র তিনি। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় সারদাসুন্দরীর ছিল বছর পঁয়ত্রিশ বয়েস। এরপরও তাঁকে আঁতুরঘরে যেতে হয়েছে। জন্ম হয়েছে বুধেন্দ্রনাথের। তারপরই তো সারদাসুন্দরীর অসুস্থতা। হাতের ক্ষত বিষিয়ে গিয়ে প্রাণসংশয় হয় তাঁর। দীর্ঘ রোগভোগ, নিদারুণ যন্ত্রণাময় তাঁর শেষ-জীবন। তিনি যখন প্রয়াত হন, রবীন্দ্রনাথ তখন সবে কৈশোরে পা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের শৈশব-বাল্য ভৃত্য-শাসিত। ‘ভৃত্যরাজকতন্ত্র’-এ তিনি প্রতিপালিত। এটা কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, ঠাকুরবাড়িতে তো বটেই, সেকালে ধনাঢ্য পরিবারের এটাই ছিল স্বাভাবিক।
শৈশবে যারা রবীন্দ্রনাথকে দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত ছিল, সেই ‘ঈশ্বর’ ও ‘শ্যাম’ মোটেই রবীন্দ্রনাথের পছন্দের মানুষ ছিল না। তাদের চাতুর্য রবীন্দ্রনাথের কাছে গোপন থাকেনি। সেসব প্রায়শই মর্মযন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছিল। পরিণত-বয়সেও ভৃত্যদের দ্বারা তিনি পরিচালিত-প্রতিপালিত হয়েছেন। তাদের আনুগত্য ও ভালোবাসা কবির মন ভরিয়ে দিয়েছিল। বনমালীর কথা আমরা জানি। ওড়িয়াভাষী এই মানুষটি রবীন্দ্রনাথের আস্থা ও নির্ভরতা অর্জন করেছিল। এই আস্থা-নির্ভরতা কখনও ফিকে হয়ে যায়নি, বরং দিনে দিনে তা বেড়েছে। এমনকি বনমালী কবির ভ্রমণসঙ্গীও হয়েছে। ঘরে বাইরে কবিকে ভালো রাখার জন্য চেষ্টা করেছে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৩: বাড়ির কাজের লোককে নিজের সম্পত্তির অধিকার দিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ দলিল পাল্টেছিলেন
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৫: দিল মেরা বানজারা!
রবীন্দ্রনাথের শেষ-বয়সে আরেক অন্য পরিচালকও ছিল। তার নাম মহাদেব। কবি-জীবনের শেষের দিকে মহাদেব খুবই সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। তার কর্তব্য পরায়ণতায়, নিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ বারবার মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। কবির মুগ্ধতা মহাদেবকে যথেষ্ট উৎফুল্ল করে তুলেছিল।
রবীন্দ্রনাথ তখন সবে প্রয়াত হয়েছেন। গুরুদেবের বিয়োগ-বেদনায় শান্তিনিকেতন-আশ্রমের সকলেই মুহ্যমান, কেউই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে সময় কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন, রবিজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যাঁকে বলতেন রবীন্দ্রনাথের ‘খাস মুন্সী’, সেই সুধীরচন্দ্র করকে মহাদেব শুনেছিলেন গুরুদেব কতখানি ভালোবাসতেন তাকে।
রবীন্দ্রনাথ তখন সবে প্রয়াত হয়েছেন। গুরুদেবের বিয়োগ-বেদনায় শান্তিনিকেতন-আশ্রমের সকলেই মুহ্যমান, কেউই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে সময় কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন, রবিজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যাঁকে বলতেন রবীন্দ্রনাথের ‘খাস মুন্সী’, সেই সুধীরচন্দ্র করকে মহাদেব শুনেছিলেন গুরুদেব কতখানি ভালোবাসতেন তাকে।
রবীন্দ্রনাথ যে অত্যন্ত স্নেহময় মানুষ ছিলেন, তা তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে, নানা ঘটনায় টের পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের এই স্নেহময়তা সম্পর্কে সুধীরচন্দ্রের স্পষ্ট ধারণা ছিল। তিনি নিজেও ছিলেন কবির কাছের মানুষ, লিপিকর। শেষ-জীবনে বহু লেখাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মুখে মুখে বলতেন। তিনি লিখে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে অবাঙালি মহাদেবেরও মনে হয়েছিল, ‘বড়বাবু’ নেই। সব খালি খালি ঠেকছে। আশ্রম ছেড়ে এবার দেশে ফিরে যাবে। সে কথা সুধীরচন্দ্রকে বলেওছিল। বলা-ই বাহুল্য যে মহাদেব রবীন্দ্রনাথকে ‘বড়বাবু’ বলত। কবি তাকে কতখানি স্নেহ করতেন, সেসবও সগর্বে সুধীরচন্দ্রকে বলেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ও সুধীরচন্দ্র কর।
কবির কাছে বসে কত রকমের গল্প করত মহাদেব। রবীন্দ্রনাথ শুনতেন আর লিখতেন। তার পরিবার-জীবনের, দেশের বাড়িঘরেরও খোঁজখবর রাখতেন কবি। মহাদেবের প্রতি সহৃদয়তা প্রতি মুহূর্তেই প্রকাশ পেত। শীতের রাতে কবি কখনই তাকে বাইরে শুতে দিতেন না। বলতেন, ‘ঠাণ্ডা লাগবে।’
কবির ঘরের পাশে একটি ঘর ছিল, সেখানে মহাদেব শুতো। রবীন্দ্রনাথ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে নীরবে এসে তাকে দেখে যেতেন। ঠিকঠাক শুয়েছে কিনা, গায়ে কম্বল দিয়েছে কিনা, সবদিকের তাঁর নজর ছিল। গরমের দিনে ওই ছোট ঘরে নয়, মহাদেব শুতো ঘরের বাইরে, বারান্দায়। কখনও বে-খেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ঘরের বাইরের দরজা জুড়েও মহাদেব শুয়ে পড়ত। রবীন্দ্রনাথ শেষ-রাতে উঠে, বাইরে বেরিয়ে প্রায় দিনই বারান্দার রাখা চেয়ারে বসতেন। যেদিন মহাদেব এ ভাবে শুয়ে থাকত, সেদিন ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও ঘরের বাইরে বেরোতেন না। বসে থাকতেন ঘরে। বেচারা ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক, এমনই মনে মনে হত কবির। ঘরের জানলা খুলে দিতেন, ঘরে বসে খোলা জানলা দিয়ে দেখতেন, রাতের অন্ধকার মুছে যাচ্ছে, আলোর আভা ফুটে উঠছে। মহাদেবকে না ডেকে রবীন্দ্রনাথ ডিঙিয়েও বাইরে যেতে পারতেন। তেমনটি করতেন না কখনো। মহাদেবের কৃতকর্মের জন্য বকাঝকাও করতেন না। শুধু পরে বলতেন, ‘জায়গা রেখে শুতে পারিস না?’
কবির ঘরের পাশে একটি ঘর ছিল, সেখানে মহাদেব শুতো। রবীন্দ্রনাথ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে নীরবে এসে তাকে দেখে যেতেন। ঠিকঠাক শুয়েছে কিনা, গায়ে কম্বল দিয়েছে কিনা, সবদিকের তাঁর নজর ছিল। গরমের দিনে ওই ছোট ঘরে নয়, মহাদেব শুতো ঘরের বাইরে, বারান্দায়। কখনও বে-খেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ঘরের বাইরের দরজা জুড়েও মহাদেব শুয়ে পড়ত। রবীন্দ্রনাথ শেষ-রাতে উঠে, বাইরে বেরিয়ে প্রায় দিনই বারান্দার রাখা চেয়ারে বসতেন। যেদিন মহাদেব এ ভাবে শুয়ে থাকত, সেদিন ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও ঘরের বাইরে বেরোতেন না। বসে থাকতেন ঘরে। বেচারা ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক, এমনই মনে মনে হত কবির। ঘরের জানলা খুলে দিতেন, ঘরে বসে খোলা জানলা দিয়ে দেখতেন, রাতের অন্ধকার মুছে যাচ্ছে, আলোর আভা ফুটে উঠছে। মহাদেবকে না ডেকে রবীন্দ্রনাথ ডিঙিয়েও বাইরে যেতে পারতেন। তেমনটি করতেন না কখনো। মহাদেবের কৃতকর্মের জন্য বকাঝকাও করতেন না। শুধু পরে বলতেন, ‘জায়গা রেখে শুতে পারিস না?’
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’
প্রয়োজনে মহাদেবকে কবি বকেওছেন। সেই বকার মধ্যেও স্নেহময়তা জড়িয়ে থাকত। একটি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। ঘটনাটি সুধীরচন্দ্র করকে মহাদেব নিজেই বলেছিল, সুধীরচন্দ্র তা লিখে রেখেছেন তাঁর ‘কবিকথা’ বইতে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন আপন খেয়ালে পরপর কয়েকটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবি আঁকতে আঁকতে বোধহয় একটু ক্লান্ত হয়েই পড়েছিলেন। একঘেয়েমি কাটাতে টেবিল-চেয়ার ছেড়ে উঠে একটু কাছে কোথাও গিয়েছিলেন। তখনই ঘটে সেই অঘটন।
কাজের মানুষ মহাদেব। এই সুযোগটিকে কাজে লাগায় সে। অন্য সময় তো ফাঁকা পাওয়া যায় না, এই অবসরে রবীন্দ্রনাথের টেবিল গুছিয়ে রাখতে তৎপর হয়। ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে কাগজের তলায় যে রঙের বাটি ছিল, তা বে-খেয়াল উল্টে ফেলে। সব রং গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁকা ছবিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। একটি-দুটি নয়, পাঁচ-ছ’খানা ছবি। সব ক’টা ছবির অবস্থাই তখন যা-তা। দেখে আঁতকে ওঠে সে। নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়, তিরস্কার করে।
সুধীরচন্দ্রের একটি বই।
মহাদেব পুরো ঘটনাটি গোপন করে যেতে পারত। কেউ দেখেনি, পরে বানিয়ে কিছু না হয় বলে দিত! তা না করে তখুনি দৌড়ে গিয়েছিল কবির সেক্রেটারি অনিল চন্দের কাছে। তিনি ‘হায় হায়’ করে ছুটে এসেছিলেন। সব দেখে তখনই অনিল চন্দ রবীন্দ্রনাথের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। পিছু পিছু মহাদেবও গেল। তার অবস্থা তখন আর কহতব্য নয়। ভয়ে কাঁপছিল সে। এই থরহরিকম্প অবস্থা অনিল চন্দের চোখ এড়িয়ে যায়নি। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে, চোখ মুখ আতঙ্কে শুকিয়ে গেছে। কবিকে অনিল চন্দ তখনই বলছিলেন সে কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘ভয় পাচ্ছে কেন? ওর কি দোষ? দোষ তো আমার। মনের ভুলে রঙের বাটিটা ওখানে রেখে চলে এসেছিলাম।’
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?
কবির মুখে এমন কথা শুনে মহাদেবের বুকে সাহস আসে। মহাদেব কাছে যেতেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওখানে একটু সাবধানে ঝাড়পোঁছ করিস। সব সময় খেয়াল থাকে না, কোথায় কী রাখি!’
অতীব সাধারণ মানুষজনের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ মিশতেন। কত কথা হত, মজা করতেন। একদিন কবি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ। চারপাশ জ্যোৎস্নায় প্লাবিত। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই কবি ডাকলেন মহাদেবকে। অতীব অনুগত ভৃত্য। কাঁচুমাচু মুখে সে আসতেই কবি বলেছিলেন, ‘শোন, চাঁদটাকে ঢেকে দে তো। ঘুম আসছে না!’
অতীব সাধারণ মানুষজনের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ মিশতেন। কত কথা হত, মজা করতেন। একদিন কবি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ। চারপাশ জ্যোৎস্নায় প্লাবিত। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই কবি ডাকলেন মহাদেবকে। অতীব অনুগত ভৃত্য। কাঁচুমাচু মুখে সে আসতেই কবি বলেছিলেন, ‘শোন, চাঁদটাকে ঢেকে দে তো। ঘুম আসছে না!’
রবীন্দ্রনাথ।
মহাদেব পড়েছিল মহাফ্যাসাদে। ওই দূরে গাছের মাথায় চাঁদ, কী করে তাকে ঢাকবে! দিশেহারা, বিভ্রান্ত। মাথা চুলকতে লেগেছিল সে। রবীন্দ্রনাথ হেসে তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘কী হল? পারবি নে? এক কাজ কর।’ বলে একটু তাকালেন মহাদেবের দিকে। বিপন্নতা তার চোখে মুখে। কবি বললেন, ‘যা, এবার জানালাটা বন্ধ করে দে।’ তাড়াতাড়ি গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছিল মহাদেব। ঘরময় শুধুই অন্ধকার।
‘এবার সত্যিই চাঁদ ঢাকা পড়ল’, হেসে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মহাদেবের মুখেও হাসি। কবির রসিকতা বুঝতে পেরেছে সে। অত বড়ো কবি, আকাশ-ছোঁয়া তাঁর খ্যাতি। ভাবলে মনে বিস্ময় জাগে, এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে মিশতেন, ভালোবাসতেন।
‘এবার সত্যিই চাঁদ ঢাকা পড়ল’, হেসে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মহাদেবের মুখেও হাসি। কবির রসিকতা বুঝতে পেরেছে সে। অত বড়ো কবি, আকাশ-ছোঁয়া তাঁর খ্যাতি। ভাবলে মনে বিস্ময় জাগে, এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে মিশতেন, ভালোবাসতেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।