মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


রথীন্দ্রনাথ।

পিতৃদেব প্রয়োজনে কতখানি কঠোর হতে পারেন, তারও এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল রথীন্দ্রনাথের। একবার পাখি মেরে খুব বকুনি খেয়েছিলেন তিনি। নিজের হাতে গুলতি তৈরি করে শালিক মেরেছিলেন। সে সংবাদ জানার পর খুব রাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রাগের বহিঃপ্রকাশ অন্তত রথীন্দ্রনাথের কাছে সুখকর হয়ে ওঠেনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যায়- অনুচিত কাজ করেছেন। ঠাকুর-পরিবারের জমিদারি-এলাকায় পাখি মারা নিষিদ্ধ ছিল। কবিই সে আদেশ দিয়েছিলেন। আদেশটি অক্ষরে অক্ষরে সবাই মেনে চলত, এমনকি ইংরেজ রাজকর্মচারীরাও।
রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে বালক রথীন্দ্রনাথের প্রতি কঠোর হয়েছেন, তার মানে নিয়মিত বকাঝকা করেছেন, তা নয়। কঠোর হয়েছেন কদাচিৎ। বকাঝকা করলেও দৈহিক শাস্তি কখনও দেননি। রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘আমার তো মনে পড়ে না, বাবার হাতে আমরা কখনো দৈহিক শাস্তি পেয়েছি। মারধর করা ছিল তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ।’ রথীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা থেকে যুবক-বয়স পর্যন্ত সব মিলিয়ে তিনবার বকাঝকা খেয়েছিলেন। কেন তিনি বকুনি খেয়েছিলেন, পিতৃদেবের কাছে তিরস্কৃত হয়েছিলেন, তা বিশদে জানিয়েছেন কবিপুত্র।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০: সুন্দরবনের রক্ষয়িত্রী বনবিবি

রথীন্দ্রনাথ শৈশবে স্নান করতে চাইতেন না। স্নান করা বিভীষিকা মনে হত তাঁর। মা মৃণালিনী স্নান করাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আগাগোড়া কী ঘটেছে, সব লক্ষ করেছিলেন কবি। মুহূর্তে চরম শিক্ষা দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথকে। মুখে কিছু বলেননি, গালমন্দও করেননি। কী করেছিলেন পিতৃদেব, কীভাবে দিয়েছিলেন চরম শিক্ষা, তা নিজেই জানিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ, ‘বাবা দু-হাতে আমাকে ধরে উঠিয়ে দিলেন আলমারির মাথায়। এরপর থেকে আমাকে স্নান করানো নিয়ে মাকে আর বেগ পেতে হয়নি।’

প্রতিমা দেবী, রথীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও অ্যাণ্ডরুজ।

দ্বিতীয় ঘটনাটি শিলাইদহের। পরের দিন দুর্গা-বিসর্জন। সর্বত্র চলেছে সে প্রস্তুতি। পদ্মার অপর পাড়ে পাবনা, সেখানে নৌবাইচ দেখতে যাবেন রথীন্দ্রনাথ, তেমনই ঠিক হল। তিনি নিজে নৌকোর দাঁড় টানবেন, এ সব পরিকল্পনার কথা শুনেও বাধা দেননি রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে গিয়েছিলেন মামা ও ম্যানেজারমশায়। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যায়। নৌবাইচের পর প্রতিমা ভাসানের পালা। একের পর এক প্রতিমা বিসর্জন চলেছে। উৎসবের আনন্দ ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাচ্ছে। ফলে তখুনি ফেরা গেল না। ফিরতে ফিরতে আরও দেরি। চারদিকে তখন গভীর রাতের স্তব্ধতা।

শিলাইদহের ঘাট কোন দিকে, তা আন্দাজ করাই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কষ্টকর হয়ে ওঠে। সঙ্গে বন্দুকধারী বরকন্দাজ এসেছিল। তারা ফাঁকা আওয়াজ করে। শিলাইদহের ঘাট থেকে কেউ সাড়া দেবে, এমন ভেবে নিয়েই এই ফাঁকা আওয়াজ। পর পর বেশ কয়েকটি আওয়াজ। শেষে গুলির আওয়াজে গুলি। পাওয়া গেল সংকেত। শব্দ-সংকেত লক্ষ করেই ঘোরানো হল পানসির মুখ। আওয়াজ যেদিক থেকে আসছে, তা বোঝার চেষ্টা করে কোনওরকমে ঘনঘোর অন্ধকারে শিলাইদহের ঘাটের দিকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছনো গেল।

ঘাটে হ্যারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন উদ্বিগ্ন-চিন্তিত পিতৃদেব। রবীন্দ্রনাথ মুখে একটিও কথা বলেননি। নীরবে দ্রুতপদে কুঠিবাড়ির দিকে এগিয়েছেন। এই নীরবতার মধ্যে যে তিরস্কার লুকিয়ে ছিল, সে তিরস্কার অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই ঘটনার পরে যতদিন শিলাইদহে ছিলাম, বাবা এ বিষয়ে উল্লেখমাত্র করেননি, বকাঝকা তো দূরের কথা! আমার মতো ভুক্তভোগী অপরাধী আরও অনেকে বলতে পারবেন, এইরকম সময়ে বাবার নীরব তিরস্কার, শারীরিক শাস্তির চেয়ে কতগুণ কঠিন বলে মনে হত।’
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৩: কানে ব্যথা? তেল দেবেন কি?

প্রথম আলো, পর্ব-১: বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি জানেন?

কলকাতার পথ-হেঁশেল: যদুকুল ও চপস্টিকস

রথীন্দ্রনাথ আরেকটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ বইতে। শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রাম। সেখানে আছে এক ভাঙাচোরা জীর্ণপ্রায় বাড়ি। বাড়িটি তখনও ছিল, এখনও আছে। বাড়িটি চিপসাহেবের। তিনি ছিলেন এক নীলকর সাহেব। প্রসঙ্গত বলা ভালো, বাড়িটি এখন আরও জীর্ণ হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এই বাড়িতে, বাড়ির লাগোয়া আরণ্যক-পরিবেশে সন্দীপ রায়ের ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ ছবিটির শুটিং হয়েছিল। আমরা প্রসঙ্গান্তরে চলে এসেছি। রথীন্দ্রনাথের ব্যবস্থাপনায় চিপসাহেবের বাড়িতে ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্মিলিত পিকনিকের আসর বসেছিল। পিকনিক গড়ায় অনেক রাত পর্যন্ত। পরের দিন পিকনিকে যাওয়া মাস্টারমশায়রা ক্লাস নেবেন কী, সকলেই ক্লান্তিতে অবসন্ন। কবির কাছে গিয়ে যে ছুটি চাইবেন, তারও উপায় নেই। সকলেই সংকুচিত। শেষে রথীন্দ্রনাথকেই যেতে হয়েছিল। তিনিই ছাত্রদের তরফে এই বনভোজনের ব্যবস্থা করেছেন, তাই আশ্রমের নিয়মভঙ্গের দায় তাঁকেই নিতে হয়। ছুটির আবেদন নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে রথীন্দ্রনাথ পৌঁছলেন পিতৃদেবের কাছে। তিনি অন্য কোনও কথা না বলে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন হল তোদের বনভোজন? খুব মজা করেছিস তো?’

রথীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের সংশোধন।

রথীন্দ্রনাথ কী উত্তর দেবেন! পড়লেন মহাবিপাকে। সেই সংকট-মুহূর্তের কথা তাঁর লেখায় এভাবে এসেছে, ‘মনে মনে কতরকম অজুহাতের কথা ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু বাবার গলার স্বর শুনে সব যেন কোথায় উবে গেল— সুতরাং কোনো সাফাই না গেয়ে দ্রুত প্রস্থান! এর পর জ্ঞাতসারে এমন কিছু কখনো করিনি, যা বাবার বিরক্তির কারণ ঘটাতে পারে।’
কবির তিরস্কারের ভাষা, শাস্তিদানের ভাষাও মৌলিক। নির্লিপ্ততা নয়, নীরবতা। সেই নীরবতা কতখানি স্পর্শময় ও সুদূরপ্রসারিত হতে পারে, তা রথীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি থেকেই বোঝা যায়। প্রহার তো দূরের কথা, রথীন্দ্রনাথকে কদাচিৎ যে তিরস্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার মধ্যেও নিজস্বতা ছিল। নিজের কাজের জগৎকে সরিয়ে রেখে সন্তানের জন্য সময় দিয়েছেন কবি, নিজের মতো করে তাঁকে বড় করে তুলেছেন। দিয়েছিলেন কৃচ্ছ্রসাধনের পাঠ।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

পাখি সব করে রব, পর্ব-২: দুর্লভ পরিযায়ী পাখি ল্যাপউইং

বেলুড়মঠের কয়েকজন সন্ন্যাসীকে নিয়ে নিবেদিতা হিমালয়-ভ্রমণে যাচ্ছেন শুনে অগ্ৰ-পশ্চাত না ভেবেই কবি রথীন্দ্রনাথকে তাঁদের সঙ্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। রথীন্দ্রনাথের কষ্ট হবে জানতেন তিনি, তা সত্ত্বেও পাঠাতে চেয়েছিলেন। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে কিশোর রথীন্দ্রনাথ এমন সব শিক্ষা পাবেন, যা তাঁর আগামীর পাথেয় হয়ে উঠবে, এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন। কৃচ্ছ্রসাধনের, সহিষ্ণুতার পাশাপাশি প্রকৃতি ও মানুষকে চিনবেন, মনে সাহসের সঞ্চার হবে — এসব ভেবেই মৃণালিনী দেবীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুত্রকে রবীন্দ্রনাথ ভ্রমণে পাঠিয়েছিলেন। বৃহত্তর প্রয়োজনের কথা ভেবে স্ত্রীর মতামতকে তিনি প্রাধান্য দেননি।

রথীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি।

পুত্রকে মায়ের গুরুত্ব বোঝাতে, মায়ের প্রতি পুত্রের মনে ভালোবাসা চিরজাগরূক রাখতে রবীন্দ্রনাথের তৎপরতার অবশ্য অন্ত ছিল না। সদ্যপ্রয়াত মৃণালিনী দেবীর ‘সর্বদা-ব্যবহৃত চটিজুতো’ কিশোর রথীন্দ্রনাথের হাতে দিয়ে একটি কথাই তিনি বলেছিলেন। সে কথা বলে নীরবে ঘরে চলে গিয়েছিলেন। তা ছিল বড়ই মর্মস্পর্শী, হৃদয়বিদারক। পুত্রকে বলেছিলেন, ‘এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।’
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content