রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ। কবিতা লিখতেন তিনি। ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন বড় দার্শনিক, বড় গণিতজ্ঞ, বড় সংগীতজ্ঞ। বাংলা শর্টহ্যান্ডের উদ্ভাবক। আপন কর্মে নিমগ্ন থাকতেন। জাগতিক অনেক বিষয়েই উদাসীন। সেই উদাসীনতা অনেক সময় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠত। দ্বিজেন্দ্রনাথ দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি কোনও কিছুরই খোঁজখবর রাখতেন না। ফলে প্রায়শই বিপদে পড়তেন। লুচি ঘিয়ে নয়, জলে ভাজা হয়, এমন সব কথা তাঁর মুখে লেগেই থাকত।
এ সব শুনে সকলেই হাসত। স্বভাব-উদাসীন মানুষ, অথচ পশু-পাখিদের কথা সবসময়ই ভাবতেন। তারা কী খাবে, তা নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না। প্রতিদিন রুটিন মেনে সেসব খাবার সংগ্রহ করা হত। কত পাখি নিয়ম করে আসত। কাঠবিড়ালি আসত। সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, পশু-পাখিদের সঙ্গে তাঁর কী অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।
এ সব শুনে সকলেই হাসত। স্বভাব-উদাসীন মানুষ, অথচ পশু-পাখিদের কথা সবসময়ই ভাবতেন। তারা কী খাবে, তা নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না। প্রতিদিন রুটিন মেনে সেসব খাবার সংগ্রহ করা হত। কত পাখি নিয়ম করে আসত। কাঠবিড়ালি আসত। সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, পশু-পাখিদের সঙ্গে তাঁর কী অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।
বুনোপাখি আর কাঠবিড়ালিকে দ্বিজেন্দ্রনাথ নিজের হাতে ছোলাছাতু খাওয়াতেন। দুষ্টু কাক, শালিখ পাখির খাবার যাতে না খেয়ে ফেলে, সে ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। কাক ও শালিখ দু-জনকেই চোখে চোখে রাখতেন। হাতে বেত রাখতেন তিনি, প্রয়োজনে কাক তাড়াতে ব্যবহার করতেন। একবার একটা কাক কাঠবিড়ালির বাচ্চাকে ঠুকরে দিয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, কাকটাকে শাস্তি দেবেন। কেমন হবে সে শাস্তির ধরন, স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই, গৃহভৃত্যকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কাকটাকে শাসাতে হবে, কিন্তু প্রাণে মারা যাবে না।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়েসের অনেক ব্যবধান। বলা যায়, পিতৃতুল্য। জীবনের একটা বড় অংশই কেটেছে তাঁর শান্তিনিকেতনে। কবির সঙ্গে প্রায়শই তাঁর দেখা হত। রবীন্দ্রনাথ চলে যেতেন দ্বিজেন্দ্রনাথের গুরুপল্লির বাড়িতে। সে বাড়ির লোকের মুখে মুখে একটি নামও ছিল, ‘নিচু বাংলো’। চারদিকে গাছপালা, মাঝখানে টালির চালের ছোট্ট বাড়ি। সে বাড়ির দাওয়ায় বসে কত কথা, অগ্রজ আর অনুজে। রবীন্দ্রনাথ কখনও তাঁর অবাধ্য হননি। অনেক ব্যাপারেই বড়দার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ যা বলতেন, ভেবেচিন্তে বলতেন।
জগদানন্দ রায়।
কবির কাছে সে কথার মান্যতা ছিল। অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। বড়দার শরণাপন্ন হতে পারলেই মুশকিল-আসান, সমস্যার সমাধান, এমনই হয়তো মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ।
দ্বিজেন্দ্রনাথের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তো আসতেনই, মাঝেমধ্যে চলে আসতেন আশ্রম-শিক্ষক জগদানন্দ রায়, পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী, নেপালচন্দ্র রায় ও রেভারেন্ড এন্ডরুজ। হয়তো-বা দর্শন নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি, কাকে শোনাবেন? কেন, আশ্রম-শিক্ষকদের। ডাক পড়ত তাঁদের। সুধাকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ‘অট্টহাস্যের ঝর্ণা ঝরাইয়া হৃদয়গ্ৰাহী দু-চারটি রসিকতা উপহাসাদির’ পর দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি পড়ে শোনাতেন। সবাই স্তব্ধ হয়ে মনোযোগী ছাত্রের মতো সে প্রবন্ধ শুনত।
দ্বিজেন্দ্রনাথের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তো আসতেনই, মাঝেমধ্যে চলে আসতেন আশ্রম-শিক্ষক জগদানন্দ রায়, পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী, নেপালচন্দ্র রায় ও রেভারেন্ড এন্ডরুজ। হয়তো-বা দর্শন নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি, কাকে শোনাবেন? কেন, আশ্রম-শিক্ষকদের। ডাক পড়ত তাঁদের। সুধাকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ‘অট্টহাস্যের ঝর্ণা ঝরাইয়া হৃদয়গ্ৰাহী দু-চারটি রসিকতা উপহাসাদির’ পর দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি পড়ে শোনাতেন। সবাই স্তব্ধ হয়ে মনোযোগী ছাত্রের মতো সে প্রবন্ধ শুনত।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’
দ্বিজেন্দ্রনাথের আহ্বানে মাঝেমধ্যেই আশ্রমের শিক্ষকরা আসতেন নিচু বাংলোর বাড়িতে। সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর লেখায় আছে, ‘বৃহৎ প্রান্তরের মধ্যে নিরিবিলি একটি কুঞ্জবন-নিভ বাগানের কুটিরে, জনাকয়েক শান্ত প্রকৃতি রসগ্ৰাহী পরিবেষ্টিত হইয়া, বৃদ্ধ দ্বিজেন্দ্রনাথ টেবিলের কয়েকটি মোমবাতি জ্বালাইয়া সন্ধ্যায় গীতা সম্বন্ধে নিজের পাঠ সকলকে পড়িয়া শোনাইতেন— সে দৃশ্য যে কতটা অভাবনীয়, সেটা ভাষায় বিশ্লেষণ করিয়া বলা শক্ত।’ এমনই একদিন প্রবন্ধ পাঠ চলছিল, শ্রোতারা তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। প্রবন্ধ-পাঠ সবে শেষ হয়েছে, তখনও রেশ রয়ে গিয়েছে সকলের মনে। পঠিত প্রবন্ধ নিয়ে সবাই ভাবছেন। ঠিক তখনই দ্বিজেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন জগদানন্দকে, তিনি উপহার পেয়েছেন কিনা! জিজ্ঞাসা করেই তিনি খুব হাসলেন, জগদানন্দও ‘পেয়েছি’ বলে শব্দ করে হাসলেন।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৬: ঈল মাছের এই রহস্য নিশ্চয়ই একদিন উদঘাটন হবে
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩০: প্রচুর প্রোটিন, তাই যতখুশি ডাল খান?
দ্বিজেন্দ্রনাথের মুখে আবারও হাসি, ‘অট্টহাস্যের ফোয়ারা’। হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, ভালো লেগেছে কিনা। জগদানন্দ প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘বেশ উপহার, ভারী মিষ্টি।’ আবার হাসি, দু-জনেই হো-হো করে হাসতে শুরু করলেন। ব্যাপার কী, কেন এই হাসাহাসি? উপস্থিত সকলেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন। কী রহস্য? সে রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সকলেই মরিয়া হয়ে উঠলেন। শেষে জানা গেল, অঙ্কের ক্লাসে এক বিচ্ছু ছেলে খুব অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। জগদানন্দ অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। দিয়েছিলেন ছেলেটির কান মুলে। ঠিক তখনই ক্লাসের বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। সেই কানমলার দৃশ্য চোখ এড়িয়ে যায়নি তাঁর। দ্বিজেন্দ্রনাথ ‘কর্ণমর্দন কাণ্ড’ আড়াল থেকে দেখে মুখে কিছু না বলে ফিরে এসেছিলেন নিজের বাড়িতে, নিচু বাংলোয়।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।
জগদানন্দ রায়ের হাতে কানমলা খাওয়া, ছাত্রদের কাছে ছিল বড়সড় প্রাপ্তি। তাঁর কাছে কানমলা খেলে ছাত্রদের আনন্দই হত। যে কানমলা খেত, সে নিজেকে ধন্য মনে করত। এমন হলে অঙ্ক শেখানোর জন্য অবসর-সময়ে মাস্টারমশায় আলাদা করে ডাকবেন। জগদানন্দ রায় শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দারুণ। স্নেহময় ও কর্তব্যপরায়ণ। ছাত্রদের মধ্যে তাঁর খুব জনপ্রিয়তা ছিল। এসব দ্বিজেন্দ্রনাথ জানতেন। ছাত্রকে পেটাচ্ছেন, কান মুলে দিচ্ছেন—এ সব দেখেও তিনি কিছু মুখে বলেননি। বলবেনই বা কেন, জগদানন্দ যে খুব ভালো শিক্ষক, তা তো আর দ্বিজেন্দ্রনাথের অজানা ছিল না! তাই ফিরে এসেই মজা করে পদ্য লিখলেন। লিখেই খামে ভরে কাজের লোকের মারফত জগদানন্দবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পদ্যটি ছিল এ রকম, ‘শুনহ জগদানন্দ দাদা,/গাধাকে পিটিয়ে না হয় অশ্ব,/ অশ্বেরে পিটিলে হয় গাধা।’
সব রহস্যের নিষ্পত্তি করলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ নিজে। জোরে জোরে পদ্যটা পড়ে শোনালেন তিনি। উপস্থিত ছিলেন আশ্রম-বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক। দ্বিজেন্দ্রনাথ জগদানন্দ রায়কে কী ‘উপহার’ পাঠিয়েছিলেন, তা জানার পর সমবেত শিক্ষকমণ্ডলীও উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন।
সব রহস্যের নিষ্পত্তি করলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ নিজে। জোরে জোরে পদ্যটা পড়ে শোনালেন তিনি। উপস্থিত ছিলেন আশ্রম-বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক। দ্বিজেন্দ্রনাথ জগদানন্দ রায়কে কী ‘উপহার’ পাঠিয়েছিলেন, তা জানার পর সমবেত শিক্ষকমণ্ডলীও উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।