মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ পিতা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। সন্তানদের প্রতি তিনি কতখানি দায়বদ্ধ ছিলেন, তা নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নির্মলকুমারী মহলানবিশকে কবি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। নির্মলকুমারী ছিলেন প্রসিদ্ধ পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের স্ত্রী। সেবায় পরিচর্যায় রবীন্দ্রনাথের বেলা-শেষের দিনগুলি ভরিয়ে তুলেছিলেন তিনি। আনন্দে, বিষাদে যে নিদারুণ অভিজ্ঞতা, তা তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ বইটিতে। এ বইতে আছে দিন ধরে ধরে ঘটনা-বিবরণ। ক্রমশ কবি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, মর্মস্পর্শী সে বিবরণ আমাদের ভারাক্রান্ত করে, আমরা বেদনার্ত হই।

বইটির প্রথম দিকে রয়েছে নির্মলকুমারীর কবি-সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতা। কবির সঙ্গে আলাপচারিতার সুখস্মৃতি। বড় মনোরম বইয়ের এই অংশটি। কবির জীবন-ভাবনা জানা যায়, উপলব্ধি করা যায় তাঁকে।
আলাপচারিতায় এসেছে কত গুরুগম্ভীর বিষয়। কবি একদিন উপনিষদের প্রসঙ্গ তুললেন। উপনিষদের কয়েকটি শ্লোক নিয়ে তখনই শুরু হয়ে যায় আলোচনা। নির্মলকুমারী কবিকে জানিয়েছিলেন, উপনিষদের ‘পিতা নোহসি’ মন্ত্রটা খুব ভালো লাগে তাঁর। এই ভালো-লাগার কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। ব্যাখ্যা করে নির্মলকুমারী বলেছিলেন, ‘নিজের বাবার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা’ অনুভব করার কথা। নির্মলকুমারীর কথা শুনে রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে গিয়েছিল রানিকে। কবি মেজমেয়ে রানির কথা আগেও বলেছেন নির্মলকুমারীকে। স্মৃতিকাতর হয়ে সেদিনও আবার বলতে শুরু করেছিলেন, ‘তার মৃত্যুর সময় তার মা বেঁচে ছিলেন না। সমস্ত অসুখের মধ্যে আমিই তার সেবা করেছিলুম শেষ পর্যন্ত। তোমরা হয়তো এখন কল্পনাও করতে পারো না আমি আবার কি করে এত বড়ো রোগীর সেবা করতে পারি। কিন্তু সত্যিই পারতুম।’

নির্মলকুমারী মহলানবিশ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভালোবাসার রানির জন্য কী না করেছেন! নিজের মুখেই বলেছেন, সারা রাত তালপাতার পাখার বাতাস করেছন। একটুও ক্লান্ত বোধ করেননি। রানি বাবার হাতে ছাড়া কি ওষুধ, কি পথ্য কিছুই খেত না। সব সময় বাবাকে কাছে চাইত। শ্বশুরমশায়ের টাকায় বিলেতে গিয়ে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন রানির স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ। না, সত্যেন্দ্রনাথের সাফল্য আসেনি। পরীক্ষায় সফল না হয়ে শেষে ফিরে এসেছেন স্বদেশে। সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে রানির সামান্যও তাপ-উত্তাপ ছিল না। তাঁর মন জুড়ে ছিলেন আর কেউ নন, বাবা।

বিয়ের ক-দিন পরই রেণুকার অসুখ ধরা পড়ে। রানিরই ভালো নাম ‘রেণুকা’। রবীন্দ্রনাথ ডাকতেন ওই ‘রানি” নামে। রানির অসুস্থতা যথেষ্ট গুরুতর। বুকে টিবির কীট বাসা বেঁধেছিল। কত ডাক্তার দেখালেন, না, কিছুতেই ভালো হননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে শেষে গেলেন হাওয়া-বদলে, আলমোড়ায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

ওখানে গিয়ে মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠল, রবীন্দ্রনাথ চিন্তামুক্ত মনে, হাসি মুখে জোড়াসাঁকোয় ফিরে এলেন। না, তেমনটি ঘটেনি। অসুস্থতা কমেনি, বরং বেড়েছে। দুঃখ-দুর্দশময় সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নির্মলকুমারীকে জানিয়েছিলেন, কন্যাকে খুশি রাখার জন্য রোজ কবিতা লিখে বিছানার পাশে বসে শোনাতেন। কবিতা শুনে কিছুক্ষণ অন্তত রোগের যন্ত্রণা ভুলে থাকত। এমনভাবেই তাঁর ‘শিশু’ বইটি লেখা। সব কবিতাই রানির অসুখের সময় লিখেছিলেন, আলমোড়ায় বসে।

রেণুকা, কবির 'রানি'।

কন্যাকে কিছুদিন পাহাড়ে রাখার পর রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, ভুল হয়ে গিয়েছে। এই দূর-পাহাড়ে না আনলেই ভালো হত। তাই ফিরে আসবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। রানির শরীরের যা অবস্থা, তাঁকে শুইয়ে আনতে হবে। অনেকগুলো কুলি জোগাড় করেছিলেন কবি। ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো তারাও প্রচুর টাকা চেয়েছিল। যাক টাকা, রেণুকার যেন কষ্ট না হয়!

রেণুকা শুয়ে রইল খাটে। কুলিরা কাঁধে করে পাহাড় থেকে নামাল তাঁকে। রাস্তা তো খুব কম নয়, সোজা এলে আশি মাইলের কম নয়। পাহাড়ের পায়ে চলা পথ দিয়ে এলে তিরিশ-বত্রিশ মাইলের পর কাঠগুদাম স্টেশন। অনেক পরিশ্রম, ঘাম ঝরানো, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে শেষে কাঠগুদাম স্টেশনে পৌঁছনো গেল। ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে চলে গিয়েছে। কী করবেন, কী করা উচিত রবীন্দ্রনাথ ভেবে কূলকিনারা পেলেন না। কন্যা তখন পথশ্রমে বেশ ক্লান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

মেয়ে অসুস্থ জানানোর পরও রাতটুকু কাটানোর মতো আশেপাশের হোটেলে জায়গা মেলেনি কবির। কী না কী হয়েছে, সাতপাঁচ ভেবে তারা বোধহয় আতঙ্কিত হয়েছিল, সেকারণেই এ ভাবে উপেক্ষা করেছিল। রানির কাছে বসে থেকেই সে রাত কবি কাটিয়েছিলেন এক এঁদো ধরমশালায়। নিদারুণ অভিজ্ঞতা, দুঃখের, যন্ত্রণার যেন শেষ নেই, সে কথাই কবি নির্মলকুমারীকে শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘পরদিন রেলে তো রওনা হওয়া গেল, কিন্তু যাত্রা ফুরোবার আগেই আর এক বিপদ। মাঝখানে কোন একটা স্টেশনে ঠিক মনে নেই, বোধ হয় মোগলসরাই হবে, গাড়ি থামতে রানির জন্য একটু দুধ জোগাড় করতে নেমেছি — বেঞ্চির উপরে আমার মানিব্যাগটা রেখে গিয়েছি তখনই ফিরে আসব বলে, এসে দেখি আমার টাকার থলিটি অন্তর্হিত, নিয়েছে খুঁজে বের করবার চেষ্টা বৃথা।’
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৮: ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

এমন ঘটলে কার না রাগ হয়! রবীন্দ্রনাথেরও অত্যন্ত রাগ হয়েছিল। রাগ বাড়তেই থাকে। শেষে নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কীভাবে সেদিনের রাগ পশমিত করেছিলেন, সে কথাও কবি নির্মলকুমারীকে জানিয়েছিলেন, ‘টাকাটা যে নিয়েছে সে চুরি করে নেয়নি, আমি নিজে ইচ্ছাপূর্বক তাকে দান করলুম। হয়তো আমার চেয়েও তার ওটার বেশি প্রয়োজন। তাই আমি দানই করেছি।’

এই ভাবেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, সে কথা বলার পর নির্মলকুমারীকে ‘পিতা নোহসি’ মন্ত্রের গুরুত্ব কতখানি, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন রানি তাঁকে কত গভীরভাবে ভালোবাসত, সে কথা। হৃদয়বিদারক কত স্মৃতি কবির মনে পড়ে যাচ্ছিল, হয়তো-বা চোখের কোণ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। যেদিন রানি চলে গেল সেই বেদনা-বিধুর দিনটির কথা ভারাক্রান্ত মনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন নির্মলকুমারীকে। বলতে বলতে কবির দু-চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিল।

নির্মলকুমারী মহলানবিশ কবির মুখের কথাকে তাঁর লেখায়, ‘বাইশে শ্রাবণ’ বইতে ধরে রেখেছেন। নির্মলকুমারীর লিখে রাখা কবির মুখের কথা থেকে একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে, ‘আমি মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ল। তার জীবনের চরম মুহূর্তে কেন সে ‘পিতা নোহসি’ স্মরণ করল, তার ঠিক মানেটা আমি বুঝতে পারলুম। তার বাবাই যে তার জীবনের সব ছিল, তাই মৃত্যুর হাতে যখন আত্মসমর্পণ করতে হল, তখনও সেই বাবার হাত ধরে সে দরজাটুকু পার হয়ে যেতে চেয়েছিল। তখনও তার বাবাই একমাত্র ভরসা এবং আশ্রয়।’

রেণুকার স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।

বড় মর্মস্পর্শী, নির্মলকুমারীর লিখে রাখা কবির কণ্ঠ-নিঃসৃত এই কথাগুলি পড়ে বা শুনে যে কোনো পাঠকেরই মন খারাপ হয়ে যাবে। কবির দুঃখ তাঁকেও ছুঁয়ে যাবে। নির্মলকুমারীর মুখে ‘পিতা নোহসি’ মন্ত্রটি শুনে কবি ভিতরে ভিতরে আলোড়িত হয়েছিলেন, কেন এই আলোড়ন, তা রবীন্দ্রনাথই স্বয়ং জানিয়েছিলেন। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল রানির কথা, রানি ক্ষীণ গলায় বলে চলেছে, ‘বাবা পিতা নোহসি বলো।’ পিতা রবীন্দ্রনাথের কত কষ্ট বুকে চেপে রেখেছিলেন, লালন করেছিলেন জীবনভর, তা আমরা বুঝতে পারি। চেপে রাখা কষ্ট কবির কণ্ঠে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল। যন্ত্রণাদীর্ণ, বেদনায় ক্ষতবিক্ষত কবি জানিয়েছিলেন রানির মর্মস্পর্শী কণ্ঠস্বর মাঝেমধ্যেই শুনতে পান তিনি, ‘বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো। তার সেই শেষ কথা যখন-তখন আমি শুনতে পাই — বাবা, পিতা নোহসি বলো।’

কবির যন্ত্রণার তীব্রতা আমাদের ছুঁয়ে যায়। বড় সাহিত্যিক তিনি, বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ-সম্মানের অধিকারী। শুধু সাহিত্যিক হিসেবে বড় নন, পিতা হিসেবেও তিনি ছিলেন অনেক অনেক বড়, অতুলনীয়।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content