মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


গুণেন্দ্রনাথের তিন পুত্র : সমরেন্দ্র, অবনীন্দ্র ও গগনেন্দ্র। (বাঁ-দিক থেকে।)

গুণেন্দ্রনাথ‌ ও সৌদামিনী দেবী‌র চার পুত্র। জ্যেষ্ঠপুত্র গগনেন্দ্রনাথ। গগনেন্দ্রনাথ ছাড়াও যথাক্রমে সমরেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও কুমারেন্দ্রনাথ। কনিষ্ঠ পুত্র কুমারেন্দ্রনাথ শৈশবেই মারা গিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে আছে, ‘একটি ভাই ছিল আমার‌‌— সকলের চেয়ে ছোটো, দেখতে রোগা টিঙটিঙে, বড়ো মায়াবী মুখখানি। আমরা ছিলাম তার কাছে পালোয়ান।’ চার পুত্র ছাড়াও গুণেন্দ্রনাথের দুই কন্যা বিনয়িনী ও সুনয়নী। বিনয়িনী-কন্যা প্রতিমার সঙ্গে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছিল।

গুণেন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিলেন মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে। অত্যাধিক মদ্যপানের কারণেই তাঁর সম্ভবত মৃত্যু হয়েছিল, এমনই অনুমান করে থাকেন কেউ কেউ। একাধিক স্মৃতিচর্চায় রয়েছে সে তথ্য।

গুণেন্দ্রনাথ ভালো ছবি আঁকতেন। আর্ট স্কুলেও পড়েছিলেন। বউবাজার অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত আর্ট স্কুলের প্রথম ছাত্র ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ভর্তি হয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। জেঠতুতো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে তার গভীর সখ্য ছিল। দু’জনেই ছবি আঁকায় উৎসাহী ছিলেন। ছবির আঁকার প্রতি এই আনুগত্য-ভালোবাসা হয়তো উভয়ের মধ্যে বাড়তি মানসিক বন্ধন তৈরি করেছিল। স্বল্পায়ু জীবনে ছবি-আঁকায় গুণেন্দ্রনাথ সেভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেননি। তাঁর তিন পুত্র ও কন্যা সুনয়নী ছবি আঁকতেন। হয়তো পিতৃদেবই তাঁদের প্রাণিত করেছিলেন। গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ছবি এঁকে খ্যাতিরশিখর স্পর্শ করেছিলেন। আরেক পুত্র সমরেন্দ্রনাথ‌ সামান্যই ছবি এঁকেছেন। তাঁর ছবির মধ্যেও নিজস্বতা ছিল।

রবীন্দ্রনাথ অকাল প্রয়াত তাঁর ‘গুণদাদা’র কথা জীবনভর মনে রেখেছিলেন। গুণেন্দ্রনাথের উজ্জ্বল স্মৃতি রবীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ‘জীবনস্মৃতি’তে কবি লিখেছেন, ‘তিনিও বাড়িটিকে একেবারে পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। আত্মীয়বন্ধু আশ্রিত-অনুগত অতিথি-অভ্যাগতকে তিনি আপন বিপুল ঔদার্যের দ্ধারা বেষ্টন করিয়া ধরিয়াছিলেন। তাঁহার দক্ষিণের বারান্দায়, তাঁহার দক্ষিণের বাগানে, পুকুরের বাঁধা ঘাটে মাছ ধরিবার সভায়, তিনি মূর্তিমান দাক্ষিণ্যের মতো বিরাজ করিতেন।’

গুণেন্দ্রনাথের প্রাণময় উপস্থিতি, ‘সৌন্দর্যবোধ ও গুণগ্রহিতা’র কথা রবীন্দ্রনাথ কখনও ভুলতে পারেননি। অত্যন্ত স্নেহময় মানুষ ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের জীবনে তাঁর স্নেহের স্পর্শ এক সুদূর প্রসারিত ভূমিকা নিয়েছিল।

জীবজগতের প্রতি গুণেন্দ্রনাথের গভীর ভালোবাসা ছিল। ভালোবেসে অনেক পশুপাখি পুষেছিলেন। রঙিন মাছও পুষেছিলেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথ তখন নিতান্তই শিশু। লাল কালি ফেলে দিয়েছিলেন জলে। লাল জলে লাল মাছ ঘুরে বেড়ালে কেমন লাগে, তা দেখতে চেয়ে তাঁর এই অপকর্ম! শুধু কি মাছ, কত কিছু পুষেছিলেন গুণেন্দ্রনাথ। বারান্দা জুড়ে পাখির খাঁচা তৈরি করিয়েছিলেন। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে অনেক বড় সে-খাঁচাকে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, ‘খাঁচা তো নয় যেন মন্দির।’

গুণেন্দ্র-পত্নী সৌদামিনী

মস্ত বড় সে-খাঁচার ভেতরে কয়েকটা গাছও ছিল। খাঁচার পাখিরা এ-গাছে সে-গাছে উড়ত, ঘুরত। গাছডালে বসত। পাখিদের জল খাওয়ারও সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। পেল্লায় খাঁচাটি তৈরি হয়েছিল অনেক মিস্ত্রির মেহনতে। দিনের পর দিন কাজ করেছে তারা। তাদের মতো হাতুড়ি- বাটালি নিয়ে কাজ করার সাধ জেগেছিল ছোট্ট অবনীন্দ্রনাথের। সে সাধ পূরণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছে। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় আছে সে বিবরণ, ‘চিনে মিস্ত্রিরা লেগে গেছে কাজে; নানারকম কারুকাজ হচ্ছে কাঠের গায়ে। সারা দিন কাজ করে তারা টুকটাক টুকটাক বাটালি চালিয়ে; দুপুরে খানিকক্ষণের জন্য টিফিন খেতে যায়, আবার এসে কাজে লাগে। আমি দেখি, শখ যায় অমনি করে বাটালি চালাতে। একদিন, মিস্ত্রিরা যেমন যায় তেমনি খেতে গেছে বাইরে, এই ফাঁকে আমি বসে হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে যেই না মেরেছি কাঠের ওপর এক ঠেলা, এই দেখো সেই দাগ, বাটালি একেবারে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের মাঝ দিয়ে চলে গেল অনেকটা অবধি, তখনই আমি বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে দে ছুট সেখান থেকে।’

মিস্ত্রিরা ফিরে আসার পরই তাদের নজরে পড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। সন্দেহের আঙুল ওঠে অবনীন্দ্রনাথের দিকে। তাঁর দস্যিপনার কথা সর্বজনবিদিত। বাবামশায় এসেই অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে বলেছিলেন, ‘দেখি তোর আঙুল।’ ক্ষতচিহ্ন মুহূর্তেই নজরে পড়ে তাঁর। অবনীন্দ্রনাথকে খুব বকুনিও খেতে হয়েছিল।

মিস্ত্রিদের বেশ ক’দিনের পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত খাঁচা তৈরি হয়। সেই খাঁচায় মনের আনন্দে পাখিরা ওড়াউড়ি শুরু করে। আশপাশের ছোটরা পাখির এই ওড়াউড়ি দেখতে ভিড়ও করে। আসতো টুনি সাহেব নামে এক অল্পবয়েসি ফিরিঙ্গি। খুব পাখির শখ ছিল তাঁর। এই তরুণ সাহেবটি মাঝে মাঝেই দু- একটা পাখিও চুরি করত। অবনীন্দ্রনাথের তা নজরেও পড়েছিল। একদিন সেই সাহেবকেই বালক অবনীন্দ্রনাথ খাঁচা খুলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। খাঁচার বাইরে জাল লাগানো ছিল। ফলে গুণেন্দ্রনাথের ভালোবাসার পক্ষীকুল আকাশে উড়ে পালাতে পারেনি। খাঁচার বাইরের জালে আটকে গিয়েছিল। বকুনি জুটেছিল অবনীন্দ্রনাথের। এই রকম বকুনি তাঁকে প্রায়ই খেতে হতো। গুণেন্দ্রনাথ গোলাপি রঙের একটা কাকাতুয়াও পুষেছিলেন। কাকাতুয়াটি খাঁচায় নয়, ছাড়া থাকতো ঘরে। দেয়ালে টাঙানো হরিণের শিংয়ের ওপর গিয়ে মাঝেমধ্যেই বসতো। সকালের দিকে গুণেন্দ্র-পত্নী পান সাজছেন। কাকাতুয়া কাছে গিয়ে পানের বোঁটা খেতো। গুণেন্দ্রনাথ কাকাতুয়াটিকে ভারি যত্নে রাখতেন। ডানার তলায় নিয়ম করে পাউডার মাখাতেন। পাউডার মেখে ঝুঁটি বাগিয়ে একেবারে ‘মেমসাহেব’ সেজে সে বসে থাকতো।

গুণেন্দ্রনাথের পোষা এক আদরের কুকুরের নাম ছিল কামিনী। ভীষণ ভালোবাসতেন তাকে। কী যত্ন! সাবান মাখিয়ে স্নান করাতেন। স্নানান্তে পাউডার, লোমশ শরীরে চিরুনি। পরিচর্যার যেন আর শেষ ছিল না। বালক অবনীন্দ্রনাথের মনে কামিনীর প্রতি এই বাড়াবাড়ি রকমের আদরযত্ন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতো। তাঁর লেখায় রয়েছে খেদোক্তি, ‘বাড়ির ছেলে আমাদেরও অত আদরযত্ন হয় না, যত হয় কামিনীর। সেই কামিনীর কাছে যাই। সে আমার তোয়াক্কাই করে না, লেজ নেড়ে চলে যায় বাবামশায়ের ঘরের দিকে।’

গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুধু কুকুর কামিনী নয়, গুণেন্দ্রনাথের একজোড়া পোষা বাঁদরও ছিল। বাঁদরের প্রতিও তাঁর আদর কম ছিল না। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে স্পেশাল লাল টুকটুকে চিনি‌ মাখানো চেরি আসতো। গুণেন্দ্রনাথ নিজের হাতে একটা একটা করে চেরি খাওয়াতেন বাঁদর দুটিকে। সে দৃশ্যটি সহজভাবে নিতে পারত না বাড়ির ছোটরা। খুব হিংসে হতো। ভাবত, আহা, ওই চেরিগুলো নিজেরা যদি খেতে পারতাম!

গুণেন্দ্রনাথ একটি হরিণও পুষেছিলেন। হরিণটির নাম দিয়েছিলেন ‘গোলাপি’। তাকে দেখভাল করার জন্য একজনকে নিয়োগও করা হয়েছিল। সারাক্ষণই সে চোখে চোখে রাখতো। বাড়ির ছোটরা কোনওভাবে কাছাকাছি চলে গেলে লোকটি হইহই করে ছুটে আসত।

গুণেন্দ্রনাথ ভালোবেসেই বানিয়েছিলেন ছোটখাট এক চিড়িয়াখানা।‌ কত কী যে ছিল! কাঠবিড়ালি-খরগোশও পুষেছিলেন তিনি। অবনীন্দ্রনাথ শৈশবে খরগোশ-কাঠবিড়ালির খাঁচার দরজাও খুলে দিয়েছেন বহুবার।

ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর গুণেন্দ্রনাথ সপরিবারে পলতার এক বাগান বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। বাগানটি ছিল বড় মনোরম। গাছপালা দিয়ে সাজানো। সেই বাগানবাড়িতেও গুণেন্দ্রনাথ অনেক পশুপাখি পুষেছিলেন। সারস- মরাল, এমনকি ময়ূরও ছিল। ঘোড়া-হরিণ কিছুই বাদ যায়নি। গুণেন্দ্রনাথ পলতা থেকে কলকাতায় মাঝেমধ্যেই যেতেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনতেন। একবার কতগুলো সাদা ধবধবে হাঁস নিয়ে এসেছিলেন। হাঁসগুলোকে ছেড়ে দিয়েছিলেন ঝিলের জলে। রাতভর সে-জলেই ছিল তারা। পরের দিন ভোরে হাঁসগুলোকে খাওয়াতে গিয়ে গুণেন্দ্রনাথ তো হতবাক! দেখলেন, সাদা সাদা পালক ছেঁড়া ‘পদ্মের পাপড়ির মতো’ ভাসছে। বুঝতে অসুবিধা হয়নি গুণেন্দ্রনাথের, শেয়ালের কাণ্ড! সব হাঁস শেয়ালের পেটে গিয়েছে, বুঝতে এক মুহুর্তও দেরি হয়নি। মন বেদনাসিক্ত, কষ্টে বুক ফেটে যায়।

পশুপাখিদের প্রতি গুণেন্দ্রনাথের ভালোবাসার সত্যিই তুলনা হয় না! বড় অকালে, অসময়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। পরিবারের সকলেই শোকধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পশু-পাখিদেরও খুব কষ্ট হয়েছিল। তারা আপনজন গুণেন্দ্রনাথকে শুধুই খুঁজে বেড়িয়েছে!

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content