মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঠাকুরবাড়িতে শুধু সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা চলেনি, ব্যবস্থা ছিল শরীরচর্চারও। শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথও সচেতন ছিলেন। সাঁতারে তিনি কতখানি দক্ষ ছিলেন, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’ বইতে আছে সে-বিবরণ। শিলাইদহে অবস্থানকালে ভরা গোরাই নদী সাঁতরে পার হতেন রবীন্দ্রনাথ। পুত্রকে সাঁতার ‌শিখিয়েছিলেন ভিন্নতর পদ্ধতিতে। বোর্টের উপর থেকে একদিন রথীন্দ্রনাথকে নদীর জলে ফেলে দিয়েছিলেন। প্রথমে হাবুডুবু খেয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেদিনই সাঁতার শেখা হয়ে গিয়েছিল তাঁর! রবীন্দ্রনাথ কৈশোরে সেজদা হেমেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। ঠাকুরবাড়ির ছোটদের কথা ভেবে বধূমাতা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ-পরিকল্পনা করেছিলেন। পত্রিকাটির প্রকাশের আড়ালে ছিল তরুণ রবীন্দ্রনাথের বিপুল শ্রম। এই পত্রিকায় জ্ঞানদানন্দিনী ব্যায়ামের উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তার কথা যেমন লিখেছিলেন, তেমনই ব্যায়াম করার পদ্ধতি চিত্র সহযোগে শিখিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘ছেলেবেলা’ বইতে ঠাকুরবাড়ির শরীরচর্চার পুরো না হলেও খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যায়, শুধু হেমেন্দ্রনাথ নন, অম্বু গুহ নামে সেসময়ের এক নামজাদা পালোয়ানও ঠাকুরবাড়িতে শরীরচর্চার নানান কায়দাকানুন, শারীরিক কসরৎ শেখাতেন। হীরা সিং নামে এক পাঞ্জাবি ওস্তাদ কুস্তি ও জিমনাস্টিক শেখাতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মুগুর ভাঁজতন, ডন-বৈঠক করতেন। সন্তরণেও তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। সেসব আয়ত্ত করেছিলেন তাঁর ‌সেজদা হেমেন্দ্রনাথের কাছে। ‘জীবনস্মৃতি’তে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেজদা এসব শেখানোর জন্য তাঁর কাছে ঋণও স্বীকার করেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথের আমলে নিয়মিত মর্নিং ওয়াকে বের হতেন ঠাকুরবাড়ির অনেকে। সকালে উঠে জোড়াসাঁকো থেকে গড়ের মাঠ, আবার কখনও-বা বরানগরে পদব্রজে ভ্রমণ। ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার কাটা, ক্রিকেট খেলা এসব নিয়ে ঠাকুরবাড়ির কিশোর-তরুণদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। ঠাকুরবাড়িতে একটি পুকুর ছিল, সেই পুকুরে সত্যেন্দ্রনাথ ভাইদের সঙ্গে নিয়ে সাঁতারও কাটতেন। কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে হইহই করে মাঝ-পুকুরে যেতেন, যাওয়ার পর সঙ্গীদের কারও কলার ভেলা কেড়ে নেওয়া নিতেন। এই ভাবে নব্য শিক্ষার্থীকে সাঁতারে পারদর্শী করে তোলার চেষ্টা চলত। বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথও সাঁতারে খুবই পারদর্শী ছিলেন। বাড়ির ছোটদের নিয়ে প্রায়শই সাঁতার-আনন্দে মেতে উঠতেন।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয় বিদ্যা-চর্চার পাশাপাশি শরীরচর্চাতেও জোর দিয়েছিলেন। আশ্রম-বিদ্যালয়ের সূচনালগ্নে প্রথম পাঁচজন শিক্ষার্থীর মধ্যে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথও ছিলেন। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, শুধু লেখাপড়াতে নয়, ক্রীড়াচর্চাতেও আশ্রম-ছাত্ররা মনোযোগী ছিলেন। ফুটবলে আগ্ৰহ ছিল সর্বাধিক।‌ তাঁর লেখায় আছে, ‘ফুটবল খেলাতেই আমাদের নেশা জন্মে গিয়েছিল। একবার নাটোরের মহারাজা আশ্রমে বেড়াতে এসে নানারকম খেলার প্রচুর সরঞ্জাম দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ফুটবল কেউ ছাড়তে চাইল না। কয়েকজন ভালো খেলোয়াড়ও তৈরি হল। আমাদের তখন গর্বের বিষয় ছিল, আশপাশের কোনও দলের কাছে ফুটবল খেলে হারিনি।’

আশ্রম-বিদ্যালয়ে কুস্তি শেখানোরও ব্যবস্থা ছিল। এক পাঞ্জাবি পালোয়ান কুস্তি শেখাতেন। জুজুৎসু নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবল আগ্রহ ছিল। শেখানো হতো আশ্রম-বিদ্যালয়ে। জাপানি-প্রশিক্ষক সানোসান জুজুৎসুর প্রশিক্ষণ দিতেন। সানোসানের কাছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ জুজুৎসু ভালোই রপ্ত করেছিলেন। শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পুত্র সন্তোষচন্দ্রের সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের গভীর সখ্য ছিল। সন্তোষচন্দ্র ছিলেন রথীন্দ্রনাথের জুজুৎসু-শিক্ষার একান্ত সঙ্গী। তরুণ বয়সে রথীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল ইংরেজদের তাড়াতে গেলে জুজুৎসু-শেখার প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথও জুজুৎসু শিখিয়ে পরাধীন দেশের ছেলেদের সাহসিকতার পাঠ দিতে চেয়েছিলেন। সানোসানের কাছ থেকে অর্জিত সাহসিকতার পাঠ কাজে লাগিয়ে রথীন্দ্রনাথ একসময় অনুশীলন সমিতি সদস্যদের জুজুৎসু শিখিয়েছেন। কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে ছিল আখড়া। জুজুৎসুর প্যাঁচে সাহেব-কুপোকাতের ইচ্ছে জেগেছিল রথীন্দ্রনাথের মনে। বর্ধমান স্টেশনে রেলগাড়ির কামরায় এক সাহেবকে জুজুৎসুর প্যাঁচে কাবু করার জন্য এগিয়েও শেষ পর্যন্ত করতে পারেননি। প্রথমে যে সাহেব ‘ঘুষি বাগিয়ে’ এসেছিল, পরে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, হয়তো জুজুৎসুর আতঙ্কেই ‘ক্ষমাভিক্ষা’ করেছিল। ফলে সাহেব-কুপোকাতের ইচ্ছে আর সত্যি হয়ে ওঠেনি।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ জুজুৎসু-প্রশিক্ষক সানোসানকে বেশিদিন শান্তিনিকেতনে রাখতে পারেননি। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেই‌ তার ব্যয়ভার বহন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। বছরখানেক ছিলেন শান্তিনিকেতনে। তিনি চলে গেলেও জুজুৎসু নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে আগ্ৰহ রয়ে গিয়েছিল। জীবনের শেষ পর্যায় তা পুনরায় ফলপ্রসূ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের তখন সত্তরের কাছাকাছি বয়েস। কানাডা থেকে জাপানে গিয়েছিলেন। জাপানে তাঁর সম্মানে আয়োজিত জুজুৎসু-প্রদর্শন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। যিনি অভূতপূর্ব শারীরিক কসরৎ দেখিয়েছিলেন, সেই নোকুজো তাকাগাকিকে শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু শেখানোর দায়িত্ব নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শুধু শান্তিনিকেতনে নয়, বঙ্গের ছেলেমেয়েরা জুজুৎসু শিখুক। ‘আত্মরক্ষার সহজ অস্ত্র’টি বাঙালির করায়ত্ত হোক।

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ রেখেছিলেন তাকাগাকি। কয়েক মাস পরই তিনি শান্তিনিকেতনে চলে এসেছিলেন। তাঁর আগমন-বার্তা জানার পর তাঁকে কীভাবে সংবর্ধনা জানানো হবে, সে পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথ আগেভাগেই করে রেখেছিলেন। জুজুৎসু শেখানোর জন্য একটি টিনচালের ঘর তৈরি করা হয়েছিল। তাকাগাকির সে-ঘর পছন্দ হয়নি। কোথায় জুজুৎসু শেখানো হবে, শেষে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে স্থান নির্বাচন করা‌ হয়। সিংহ সদনের‌ একটি হলঘরে তাকাগাকি নিয়মিত জুজুৎসু শেখাতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শুধু নয়, অধ্যাপক-কর্মীদের মধ্যে জুজুৎসু শেখা নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। মেয়েদের জুজুৎসা শেখা নিয়ে কয়েকজন‌ আশ্রমিক আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁদের আপত্তি অবশ্য ঢোপে টেঁকেনি। জুজুৎসু শিখে মেয়েদের কত রকমের শারীরিক সমস্যার হতে পারে, সে-ফিরিস্তি দিতে গুরুদেবের কাছেও তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিল! ররীন্দ্রনাথ আর এ-বিষয়ে কী বুঝবেন! বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। শেষে আশ্রম-পরিদর্শনে আসা কয়েকজন ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন কবি‌। ডাক্তাররা তাকাগাকির জুজুৎসু-প্রদর্শন, মেয়েদের-প্রর্দশন দেখে জানিয়েছেন তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত। স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, জুজুৎসু শিখলে মেয়েদের কোনও শারীরিক ক্ষতি হবে না। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, মেয়েরা জোরকদমে, মহানন্দে অনুশীলন চালিয়েছে।

আশ্রমের জুজুৎসু-শিক্ষার্থীরা নিয়মিত জুজুৎসু- প্রদর্শন করত। কলকাতাতেও করেছে। নিউ এম্পোয়ার মঞ্চে তাকাগাকি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে জুজুৎসু প্রদর্শন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে লিখে দিয়েছিলেন উদ্দীপনাময় এই গানটি, ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান/ সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মান।’

আশ্রম-বিদ্যালয়ে তখন চরম অর্থ-সংকট। সেই টানাটানির সংসারে খ্যাতিমান ভিনদেশি অতিথিকে রাখা‌ ক্রমেই দুরূহ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ শেষে নিরুপায় হয়ে চিঠি লিখেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুকে, বিধানচন্দ্র রায়কে। চেয়েছিলেন পৌরশিক্ষা বিভাগে তাকাগাকিকে নিযুক্ত করা হোক।

জুজুৎসু শিক্ষা : শান্তিনিকেতনে আশ্রম-বিদ্যালয়ে

এই অনুরোধপত্র প্রেরণের কয়েকদিন পরেই কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র হয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। সুভাষচন্দ্র ও বিধানচন্দ্র কবির অনুরোধ রাখতে কতখানি তৎপর হয়েছিলেন, সে অনুরোধ-রক্ষা তাঁদের সাধ্যের মধ্যে ছিল কিনা, তা আমাদের জানা নেই। পরে তাঁরা প্রত্যুত্তরে কী লিখেছিলেন, তেমন কোনও চিঠিরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। শুধু এইটুকু জানা আছে, তাকাগাকিকে এদেশে রাখা, দেশের ছেলেমেয়েদের উজ্জীবিত ও প্রাণচঞ্চল করে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথ জুজুৎসুচর্চার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, পরিকল্পনা করেছিলেন, তা সফল হয়নি। তাকাগাকি দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ শৈশব-বাল্যের দিনগুলিতেই বুঝেছিলেন, শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা। ঠাকুরবাড়িতে যে শরীরচর্চার আবহাওয়া ছিল, তা জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতন পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। বাধাবিঘ্ন ও বাস্তব সমস্যাকে অতিক্রম করেও শরীরচর্চার সেই ধারা ‌অক্ষুণ্ণ ছিল।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content