শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


প্রতিমা ও রথীন্দ্রনাথ

রথীন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথে নিবেদিত-প্রাণ। নিজেকে নিয়ে কখনও ভাবেননি। আড়ালে থাকতেই ভালোবাসতেন। ক্ষমতাবান মানুষ। নানা দিকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর, অথচ কোনও কিছু নিয়েই নিরবচ্ছিন্নভাবে চর্চা করেননি। ভালো লিখতেন, ভালো ছবি আঁকতেন। কারুশিল্পেও তাঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এসব নিয়ে ভাবার মতো তাঁর অবকাশ- অবসর ছিল না। পিতৃদেবকে নিয়েই তাঁর সমস্ত ভাবনা ঘুরপাক খেয়েছে।

রথীন্দ্র-পত্নী প্রতিমা দেবী সেবায় পরিচর্যায় রবীন্দ্রনাথকে ‘ভালো’ রেখেছিলেন। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে বৌমার চিরাচরিত সম্পর্ক নয়, কবির কাছে কন্যাতুল্যা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘মামণি’ বলতেন। প্রতিমা দেবী ‘নির্বাণ’ নামে রবীন্দ্রনাথের শেষবেলার দিনগুলি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। বইটি পড়তে পড়তে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কবি‌ তখন প্রবল অসুস্থ। বলা যায় মুমূর্ষু। অপারেশন হয়েছে, দু’দিন আগে। রয়েছেন আচ্ছন্ন হয়ে। সেই সংকট-মুহূর্তের বড়ো মর্মস্পর্শী বর্ণনা রয়েছে প্রতিমা দেবীর ওই বইতে। বইয়ের পাতা থেকে অংশবিশেষ তুলে দেওয়া যেতে পারে, ‘আমি যখন তাঁর কানের কাছে গিয়ে ডাকলুম, ‘আমি এসেছি, আপনার মামণি, তখন একবার প্রসন্নচোখে পূর্বের মতো বিস্তারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, বুঝলুম এবার সত্যি চিনেছেন। জল খাবেন? জিজ্ঞাসা করতে হ্যাঁ-র মতো অস্ফুট উচ্চারণ করলেন, আমি একটু-একটু জল তাঁর মুখে দিতে লাগলুম, ধীরে ধীরে খেলেন। এই আমার হাতে তাঁকে শেষ জলদান।’

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ প্রতিমাকে জানতেন সেই ‘ছোট্ট’ থেকে। গিরীন্দ্রনাথ-কন্যা বিনয়নীর কন্যা তিনি। বিনয়নী দেবী অবনীন্দ্রনাথের বোন। প্রতিমার তখন তিন-চার বছর বয়েস। কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘এই সুন্দর মেয়েটিকে আমি পুত্রবধূ করব।’

মৃণালিনীর ইচ্ছে সে মুহূর্তে পূরণ হয়নি। হয়েছিল অনেক বিপর্যয়ের পর। আকস্মিক মারা যান তিনি। রথীন্দ্রনাথের তখন বছর পনেরো বয়েস। তাঁর পিতা কিশোর-বয়সে বিয়ে দিতে রাজি হননি। বিয়ের বদলে রথীন্দ্রনাথ যাত্রা করছেন বিদেশে, কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার উদ্দেশে। প্রতিমা দেবীর বিবাহ হয় অন্যত্র। দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে নীলানাথের সঙ্গে। বিয়ের মাস দুই পর ঘটে চরম বিপর্যয়‌। যেন সব আলো নিভে যায়। সাঁতার শিখতে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর স্বামীর। প্রতিমা ‘অপয়া’ অপবাদ নিয়ে ফিরে আসেন পিতৃগৃহে।

বিষাদ-প্রতিমার মুখের নিভে যাওয়া আলো পুনরায় জ্বালাতে প্রয়াসী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিদেশ থেকে ফেরার পর রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন প্রতিমার। রবীন্দ্রনাথ পুত্র ও পুত্রবধূকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘গোরা’ উপন্যাসটি। শুধু বধূ করে ঘরে আনেননি তাঁকে, মনের মতো করে কবি গড়েও নিয়েছিলেন। পুত্রবধূকে লেখাপড়া‌ শেখাতে মেম-দিদিমণিও রেখে দিয়েছিলেন।

রথীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি

ক্রমেই প্রতিমা দেবী বাবামশায়ের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর ‘মামণি’র উপর প্রবলভাবে নির্ভর করতেন। প্রতিমার উপস্থিতি কবিকে স্বস্তি দিত, নিশ্চিন্ত করত। পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে কখনও তিনি দার্জিলিংয়ে গিয়েছেন, কখনও ঘাটশিলায়। এমনকি গিয়েছেন বিদেশেও।

প্রতিমা দেবীর মধ্যে গোপনে নীরবে থাকা সাহিত্যমনস্কতা রবীন্দ্রনাথ জাগিয়েও তুলেছিলেন। প্রতিমাকে বলতেন, ‘বউমা, লেখো না।’ প্রতিমা জানাতেন তাঁর অক্ষমতার কথা। বলতেন, ‘গল্প লেখা কি সহজ বাবামশায়,আমি পারব কেন।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে গল্পের প্লট দিয়েছিলেন। সে গল্পের নাম ‘বদনাম’। আড়ষ্ট হাতে গল্পটি লেখার পর রবীন্দ্রনাথ সংশোধন-পরিমার্জন করে দিয়েছিলেন। প্রতিমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে লিখতে হয়। প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি-রচনার বাংলা তর্জমাও করেছিলেন।
প্রতিমা ও রথীন্দ্রনাথ ভালো থাকুক, সে চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই করেছেন। তাঁদের সন্তানহীন জীবনে সন্তান আসুক, আনন্দমুখর হোক, এই ভাবনা থেকে কবি তাঁদের সন্তান গ্রহণেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের তৎপরতায়‌, ব্যবস্থাপনায় দশ মাসের এক গুজরাটি-শিশুকে গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ সেই শিশুকন্যার নাম রেখেছিলেন ‘নন্দিনী’। রবীন্দ্রনাথের শেষ-জীবন আদরের পুপের উপস্থিতিতে ভরে উঠেছিল।

রবীন্দ্রনাথকে ভালো রাখতে, কবিচিত্তে মানসিক প্রশান্তি জাগিয়ে রাখতে প্রতিমা দেবীর চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। রথীন্দ্রনাথও সর্বক্ষণ তাঁর পিতৃদেবের পাশে থেকেছেন। নিজের লেখা, আঁকা ও শিল্পকর্ম নিয়ে ভুলেও ভাবেননি। তাঁর সব ভাবনাই পিতৃদেবে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর সন্তান-সন্ততিদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। ভালোবাসায় শাসনে প্রত্যাশিত নৈকট্য তৈরি হয়েছিল। সন্তান-সন্ততিরা প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছিলেন। বিশেষত শিলাইদহ বাসকালে তাঁদের জীবন হয়ে উঠেছিল বর্ণময়, আনন্দমুখর। ঘোড়ায় চড়া, মাছ-ধরা, নৌকো বাওয়া, সাঁতার কাটা, কোনও কিছুতেই বাধা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ‌নিজে সাঁতার কাটার কলাকৌশল শিখিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথকে। রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’ বইতে আছে, ‘বাবা নিজেই আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিলেন। তাঁর শেখাবার প্রণালী খুব সহজ। বোটের উপর থেকে একদিন আমাকে নদীর জলে ফেলে দিলেন। খানিকটা হাবুডুবু খেয়ে একদিনেই সাঁতার শেখা হয়ে গেল। বাবা নিজে খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারতেন। গোরাই নদীর এপার ওপার করতে তাকে অনেকবার দেখেছি।’

প্রতিমা দেবী

ছেলেবেলা থেকেই পুত্রের মনে শুভবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। জীবজগতের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করেছিলেন। রথীন্দ্রনাথের তখন বালক-বয়েস। খুবই দুরন্ত, রকমারি বদমাইশি তাঁর করায়ত্ত। একদিন নিজেই একটা গুলতি তৈরি করলেন। সেই গুলতি দিয়ে নিখুঁত নিশানায় মারলেন শালিকপাখি। শালিক মারার কথা জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ খুব রাগ করেছিলেন। পরে তাঁর জমিদারিতে পাখি মারা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণাও করেছিলেন।

রথীন্দ্রনাথের মধ্যে‌ লক্ষ করা যায় পিতার অমোঘ প্রভাব। পিতা-ই তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিলেন। পিতার পাশে থেকেছেন সর্বক্ষণ, এমনকী বিশ্বভারতীর পরিকল্পনাকালেও। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতে যে রবীন্দ্রচর্চার শুরু, তা প্রয়াণের পর দিনে দিনে ত্বরান্বিত হয়েছে। রথীন্দ্রনাথের তৎপরতা ছাড়া আজকের রবীন্দ্রচর্চা কখনও বাস্তব-রূপ পেত না। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। রথীন্দ্রনাথ যৌবনকাল থেকেই পিতার পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে সযত্নে রেখেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে কবির বন্ধু ও অনুরাগীদের কাছ থেকেও তিনি বহু পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে কবির চিঠিপত্রও কপি করে রাখা হতো। শুধু চিঠিপত্র নয়, রথীন্দ্রনাথের তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় রচনা কপি করে প্রেসে পাঠানো হত। ফলে অজস্র মূল পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি সযত্নে রক্ষিতও আছে।

প্রতিমা দেবীর আঁকা ছবি

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী রচনার কাজ রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই শুরু হয়েছিল। চারখণ্ডে সমাপ্ত তাঁর রবীন্দ্রজীবনী রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে আকরগ্রন্থ। পরবর্তীকালে নানা রচনায়, গবেষণাকর্মে ব্যবহৃত বহু তথ্যের উৎস এই মহামূল্যবান গ্রন্থটি। রথীন্দ্রনাথ বিবিধ-বিচিত্র উপাদান সংগ্রহ করে না রাখলে প্রভাতকুমারের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের এমনতরো জীবনী-রচনা ও কবির কর্মকাণ্ডের পরিচয় জ্ঞাপন সম্ভব হতো না।

রবীন্দ্রনাথের ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁর পরিমণ্ডল, প্রিয়জনেরা সাহায্য করেছিলেন। তাঁদের অন্তর উৎসারিত শ্রদ্ধা ও প্রীতিময় সহযোগিতা রবীন্দ্রজীবনে, কর্মকাণ্ডে সহায়ক হয়ে উঠেছিল।‌ যেভাবে পুত্র ও পুত্রবধূ নিজেদের নিবেদন করেছিলেন, তাঁর কোনও তুলনা হয় না। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রতিমা দেবীর দাম্পত্য বন্ধন সূদৃঢ় ছিল না। রবীন্দ্রনাথ জোড়াতালি দিয়ে হলেও সেই সম্পর্ক অটুট রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের
প্রয়াণের পর তাঁদের সম্পর্কে শিথিলতা বড় বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিল।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content