বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ।

রামকৃষ্ণ নামে এক ফেরিওয়ালা রাস্তায় ফেরি করতে বেরিয়েছে। অদ্ভুত লোক বটে! ঝুড়িতে তাঁর খাঁটি সোনার সব গহনা—জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য, আনন্দ, সমাধি। সেই অমূল্য সব গহনা সে বিনা পয়সায় দিতে চায়। কিন্তু নেবার লোক নেই। হায়! হায়! করে সে তাই বলছে “সব দেখছি কলায়ের ডালের খদ্দের! টাকা, মেয়েমানুষের রূপ দেখে ভুলে যায়। ঈশ্বরের রূপ দেখলে ব্রহ্মপদ তুচ্ছ হয়। রম্ভা তিলোত্তমা চিতার ভস্ম মনে হয়।” (কথামৃত) কিন্তু কে তাঁর কথা শোনে? সবাই ভাবছে যতসব পাগলের প্রলাপ! ওই সব জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্যের মাটির ঢেলা নিয়ে কি হবে? সংসারের সুরাহা হবে কোনও? তাই সবাই তাঁকে পাগল ভেবে, তাঁর দিকে তির্যক হাসি হেসে, অন্য ফেরিওয়ালাদের পিছনে ছুটেছে। তাদের ঝুড়িতে অনিত্য সব ইমিটেশন জুয়েলারি—ফ্রিজ, টিভি, মোবাইল, মাইক্রোওয়েভ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ওয়াশিং মেশিন, শেয়ার, টাকা, বিদেশি ডিগ্রি, বিদেশি চাকরি আরও হাজারো রকমের কত কী! সকলে বিস্ময়ে এইসব ফেরিওলাদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে। চোখ চকচক করে জিজ্ঞেস করছে “কত দাম!” যারা কিনছে, তাদের দিকে জুলজুল করে চেয়ে ভাবছে “আহা! এরা কত ভাগ্যবান! আমাদের জীবনটাই বৃথা।” আবার কেউ কেউ ঈর্ষায় এইসব ভাগ্যবানদের দিকে তাকিয়ে অন্তরে দগ্ধে মরছে।
ওই পাগল কিন্তু থেমে নেই। আমাদের পিছনে ছুটতে ছুটতে বলছে—”ওরে! ঐসব নকল গহনার মোহে পড়িস নে। সারা জীবনের রক্ত জল করা পরিশ্রমের বিনিময়ে কিনিস না ওইসব মেকি গহনা। পরে পস্তাবি। আগে এইসব আসল রত্ন জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্যের খাঁটি গহনা পরে নে।” তাহলে ওই সব মেকি গহনা ঘরে আনলেও বুঝতে পারবি কোনটা আসল, কোনটা নকল, কোনটা নিত্য আর কোনটা অনিত্য। তখন আর মোহে পড়বি না। ওই সব মেকি গহনা পেলেও অহংকার হবে না, আর হারালে বা না পেলে কোনও দূঃখ হবে না। পাগলের কথায় কিন্তু কারও চৈতন্য নেই। সবাই ভাবছে এ বড় মজার পাগল! কেউ শুনছে না, তবু আমাদের পিছনে ছুটে চলেছে! তাই হাসতে হাসতে আবার সবাই ছুটছে নকল সব ফেরিওলাদের পিছনে।

পাগল কিন্তু থেমে নেই। ভাইপো রামলালকে সম্বোধন করে যেন সকলকে বলছে, “ও রামনেলো! যদি জানতাম জগৎটা সত্যি, তবে তোদের ওই কামারপুকুর সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিতাম।” বলছে, “তাঁর মায়ায় অনিত্যকে মনে হয় নিত্য, আর নিত্যকে মনে হয় অনিত্য। এই সংসার অনিত্য, তাঁর মায়ায় মনে হয় নিত্য। আর ঈশ্বর নিত্য তাঁকে মনে হয় অনিত্য।” পাগল বলছে নিজের দর্শনের কথা “দেখলাম সকলের মুখে মৃত্যুর ছাপ। পাহাড় সমান মাথার খুলি। তার উপরে আমি বসে একা।”
আরও পড়ুন:

যত মত, তত পথ, পর্ব-৭: ঈশ্বরে মনে রেখে সংসার ধর্ম—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৫: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়

তবু পাগলের কথায় কারও কান নেই। নকল জিনিসে মন এমন মজেছে, আসল বস্তু ঈশ্বরকেই সে অসত্য, অনিত্য বলছে। আমাদের বোঝাবার জন্য হটাৎ সেই পাগল নিজের সামনে একটা গামছা ফেলে আড়াল করে বলছে, “এই দেখ! আমি তোমাদের এত কাছে, কিন্তু আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। তেমনি ঈশ্বর তোমাদের এত কাছে, তবু মায়া আবরণের জন্য তাঁকে দেখতে পাচ্ছ না। তাঁর মহামায়ায় সব মুগ্ধ করে রেখেছেন। ছোট ছেলে চুষিকাঠি নিয়ে ভুলে আছে। যতক্ষণ না ছেলে চুষিকাঠি ফেলে ব্যাকুল হয়ে মায়ের জন্য কাঁদে, ততক্ষণ মা দেখা দেন না। মা ভাবে ও তো বেশ আছে চুষিকাঠি নিয়ে, তাই থাক। কিন্তু ছেলে যখন চুষিকাঠি ফেলে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদে, বলে ”মা যাব”, তখন মা আর স্থির থাকতে পারেন না, কাছে এসে কোলে নেন।”

শুনে কেউ কেউ ভাবছে পাগলের উপমাগুলো ভারী সুন্দর। তবে আমরা হলাম গিয়ে মোদো-মাতালের মতো ভোগে-মাতালের দল। এসব কথা শুনলে আমাদের চলবে? ভোগের নেশা সব কেটে যাবে। তাই চল! চল! এখন থেকে সব পালাই। ওই দেখ! টাকা-পয়সা আরও সব কত ভোগের মালমশলা নিয়ে ফেরিওয়ালাগুলো চলেছে। চল সব ওখানে যাই।

চল পালাই পালাই
ছুটে সেখানে যাই
সব ভোগী-মাতাল
যেথায় জুটেছে ভাই।


পাগল কিন্তু থামছে না। সে বড় নাছোড় পাগল। সকলের পাশে পাশে কানে কানে বলে চলেছে “গুদামে চালের বস্তার যাতে খোঁজ না পায়, তার জন্য গুদামের মালিক ইঁদুরগুলোর জন্য সরায় করে চাল রেখে দেয়। ইঁদুরগুলো ওই চালই কড়র মড়র করে খেয়ে ভুলে থাকে, আসল ঠেকের খবর পায় না। তেমনি বদ্ধজীব ভোগ নিয়েই ব্যস্ত, ঈশ্বরের আনন্দের খোঁজ পায় না।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

রাক্ষসের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ঢুকে গেলেন বেতারকেন্দ্রে

গিরিশচন্দ্র ঘোষকে এই পাগল বলছে, “শিব সেই ব্রহ্মানন্দ সাগরের তিন গোন্ডুষ অমৃত পান করে আনন্দে বেহুঁশ হয়ে শবের মতো পড়ে আছেন, আজন্ম ব্রহ্মচারী ব্রহ্মর্ষি শুকদেব মাত্র এক গোন্ডুষ অমৃত পান করে দেহবোধ বিরহিত হয়ে আনন্দে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, নারদ শুধু দূর থেকে সেই ব্রহ্মানন্দ সাগর দর্শন স্পর্শন করেছিলেন, আর জীব তো তার বাতাস লাগলেই আনন্দে গলে যায়।” ঈশ্বরলাভ, ব্রহ্মানন্দলাভের আনন্দ সমন্ধে পৃথিবীতে এতাবৎকাল সব সিদ্ধপুরুষ, মহাপুরুষ, অবতার মানবদের সব উপমাকে শ্রীরামকৃষ্ণের এই উপমার সামনে অকিঞ্চিৎকর মনে হয়।

রবীন্দ্রনাথ নামে এক পাগল-কবির গায়েও সেই ব্রহ্মানন্দের পুলক-বাতাস লেগেছিল। তাই তাঁর গানে শুনি সেই আনন্দরাগিনী—

গায়ে আমার পুলক লাগে,
চোখে ঘনায় ঘোর—
হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে
রাঙা রাখির ডোর।
আজিকে এই আকাশ তলে
জলে স্থলে ফুলে ফলে
কেমন করে মনোহরণ,
ছড়ালে মন মোর।


আর একবার যদি কেউ এই আনন্দ-বাতাসের স্পর্শ পায়, তবে সে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায় সেই আনন্দের জন্যে, ঈশ্বরের এক বিন্দু প্রেমের জন্যে। রবীন্দ্রনাথের বহু গানে শুনি সেই করুন আকুতি ও কাতর প্রার্থনা—

শূন্য প্রাণ কাঁদে সদা—প্রাণেশ্বর,
দীনবন্ধু, দয়াসিন্ধু
প্রেমবিন্দু কাতরে করো দান।
কোরো না সখা, কোরো না
চির নিস্ফল এ জীবন
প্রভু জনমে মরণে তুমি গতি,
চরণে দাও স্থান।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১১: কোচবিহারের সব থেকে জনপ্রিয় মন্দির বাণেশ্বর শিব মন্দির

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

মহামানবেরা যেহেতু স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেরাই আনন্দ ভোগ করে সন্তুষ্ট হন না, তাঁদের আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান, তাই দেখি সেই প্রেমবিন্দু থেকে উত্থিত আনন্দ-বাতাসের ভাগ সকলকে দেওয়ার জন্য সারাজীবন ধরে রবীন্দ্রনাথ হাজারো গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নৃত্যনাট্যে সেই ঈশ্বর বা ব্রহ্মানন্দের বন্দনা করেছেন ও আমাদের আহ্বান করেছেন সেই আনন্দ আস্বাদ করতে। কিন্তু আমরা কুম্ভকর্ণের মতো অচৈতন্য-ঘুমে আচ্ছন্ন। আর ঘুম ভাঙলেই ভোগের পাঁকের মধ্যে মুখ গুঁজে কোঁত কোঁত করে শূওরের মতো পাঁক গিলছি। স্বামীজী তাই আমাদের মতো ভোগী মানুষদের সম্মন্ধে বলেছিলেন, “ভোগী মানুষ শুয়োরের মতো। শুয়োর যেমন ভাবে, আহা! সারা পৃথিবীটা যদি বিষ্ঠায় ভরে যেত তবে সারাক্ষণ কেমন আনন্দ করে খেতাম।” আমাদের চৈতন্য হবে কী করে!

ওদিকে ওই রামকৃষ্ণ নামে দিব্য-পাগল থেমে নেই, পাগলের অশেষ চিন্তা আমাদের জন্য। কারণ দিব্যন্মাদ তিনি দেখছেন বস্তু-উন্মাদ ও ভোগ-উন্মাদ আমরা ক্ষেপার মতো আনন্দের পরশপাথর খুঁজে ফিরছি, কিন্তু জানি না আমাদের অন্তরেই আনন্দের পূর্নঘট বসানো। আমাদের অবস্থা দেখে তিনি অবাক! ভাবছেন এরা সকলে নিত্য ও অনন্ত আনন্দ ছেড়ে অনিত্য টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি, খ্যাতি-ক্ষমতা এসবের জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আলোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্ধকারের দিকে ছুটে চলেছে, প্রকৃত আনন্দের সন্ধান ছেড়ে সুধা ফেলে খাচ্ছে হলাহল — এদের তিনি কিভাবে ফেরাবেন? ঝাউতলায় গিয়ে ব্যথিত হয়ে বলছেন, “কলকাতার লোকগুলো দেখছি পাঁকের মধ্যে কিলবিল করছে, আবার ওর মধ্যেই আনন্দ!” তাই দেখি তাঁর সারা জীবনব্যাপি সাধনা ও একমাত্র চেস্টা কিভাবে তিনি আমাদের মনকে অনিত্য থেকে নিত্যে, নিরানন্দ থেকে আনন্দে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে ফিরিয়ে দেবেন। আর তাই স্থূলদেহ ছেড়ে যাবার আগে সকলের জন্যে তাঁর আন্তরিক শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ “তোমাদের চৈতন্য হোক”।—চলবে।
* সুসময় রায় চৌধুরী (Susamay Roy Chowdhury) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজি সাহিত্যে সাম্মানিক ও সাংবাদিকতায় এমএ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ১. শিক্ষায় জীবন গঠন ও আনন্দলাভ—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, ২. শ্রীরামকৃষ্ণ-আলোয় সবার জীবন, ৩. শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান—প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিতব্য: ১. জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ, ২. কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ?, ৩. কে তুমি বিবেকানন্দ?, ৪. জন্মানতরবাদ—ভারতীয় শাস্ত্র ও ঋষি, মহামানবেরা।

Skip to content